X
শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪
২০ বৈশাখ ১৪৩১

নারী দিবস কি শুধুই নারী এবং একটি বিশেষ শ্রেণির জন্য?

জোবাইদা নাসরীন
০৮ মার্চ ২০২৩, ১৫:০২আপডেট : ০৮ মার্চ ২০২৩, ১৫:০২

প্রতিবছরের মতো এবারও পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এবার আয়োজন কিছুটা কম। কারণ, এর আগের দিন ছিল শবে বরাত।

এ দিবসটি নিয়ে গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও বেশ আলোচনা-সমালোচনা হয়। কোনও কোনও পত্রিকায় এই দিবসটি নিয়ে নানা ধরনের গোলটেবিল বৈঠক, ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয়। এদিন পরিবার এবং কর্মক্ষেত্রে নারীদের ফুল দিয়ে, উপহার দিয়ে অনেকেই শুভেচ্ছা ও কৃতজ্ঞতা জানান। কোনও কোনও প্রতিষ্ঠান এই ৮ মার্চে নারীদের প্রতীকী আফিসের দায়িত্ব দেয়, মিডিয়া হাউজগুলো ব্যস্ত হয়ে পড়ে ‘সফল নারী’ কিংবা ‘চ্যালেঞ্জিং কাজে’ নারীদের খোঁজ করতে। নারীরাই বলেন এই দিবস নিয়ে কথা, নারীদের কথা।

একবার আমার ক্লাসে শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, নারী দিবস কী? বেশ কয়েকজন আগ্রহ জানালো বলার জন্য। আমি দেখলাম মাত্র দুই শিক্ষার্থী বলতে পেরেছে এই দিবসটির ইতিহাস। বাকিদের কেউ কেউ বলেছেন, এই দিনে নারীরা বেগুনি শাড়ি পরে, আবার দুই একজন বলছেন নারীদের ক্ষমতায়নের দিবস।

তবে এই দিবস এলেই কেউ কেউ প্রশ্ন তোলেন কেন একদিন শুধু নারীর জন্য থাকবে? প্রতিটি দিনই তো নারীর। আবার অনেক ছেলেদেরই ‘মজাচ্ছলে’ বলতে শুনি, একদিন মাত্র নারীদের আর বাকি দিনগুলো পুরুষের।

সব বিষয়কে সামনে রেখে আসলে কয়েকটি প্রশ্ন হাজির করতে চাই। কেন নারী দিবস সম্পর্ক মানুষজনের এই ধরনের ধারণা? কী কী বিষয় এই ধরনের ধারণার সঙ্গে যুক্ত থাকছে? এবং কীভাবে একটি বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী দিনটি এভাবে হাজির হচ্ছে?

এই দিনটি বেনিয়াদের দখলে যাওয়ার পর থেকে হয়তো অনেকের মনেই স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে যে এই দিনে মেয়েরা বেগুনি শাড়ি পরবে এবং এটি না হলে মনে হয় নারী দিবস পালন করা যাবে না।

তার পরের প্রসঙ্গে আসি। এটি কি আসলে নারীর জন্যই বিশেষ দিন। আটই মার্চের ইতিহাস কিন্তু তা বলে না। এটি আসরে নারী-পুরুষ এবং অন্যান্য লিঙ্গের জন্য একটি স্মরণীয় প্রতিবাদী দিন। এই দিনটিকে  মানুষকে স্মরণে রাখতে হবে, কারণ এই দিনটিতে এটি অন্যায় এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন নারীরা। ১৮৫৭ সালে কর্মক্ষেত্রে মজুরি বৈষম্য, কর্মঘণ্টা নির্দিষ্টকরণ  এবং কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের রাস্তায় নেমেছিলেন সুতা কারখানার নারী শ্রমিকেরা। সেই নারী শ্রমিকদের প্রতি সম্মান  প্রদর্শনের জন্য মূলত এই নারী দিবস। ১৯০৯ সালে ২৮ ফেব্রুয়ারি প্রথম আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করা হয়।

কিন্তু পাঠক লক্ষ করুন, যাদের শ্রম এবং প্রতিবাদের প্রতি শ্রদ্ধার জন্য এই দিবস তারা এই দিবসের কোথাও নেই। সেই ইতিহাসের নির্মাতা শ্রমজীবী নারীদের আমরা কোথাও দেখি না। না পাই তাদের গণমাধ্যমে, না পাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আলাপচারিতায়। শ্রমজীবী মানুষদের অনুপস্থিতিতে এই দিবসের মূল জায়গা থেকে আমরা অনেকখানি সরে পড়েছি।


প্রতিবছরই আন্তর্জাতিকভাবে এই দিবসটিকে কেন্দ্র করে একটি থিম ঠিক করা হয়। এবারের থিম হলো ‘ডিজিটাল প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন: জেন্ডার বৈষম্য করবে নিরসন’। প্রযুক্তি কিন্তু  উচ্চবিত্তের কাছেই আছে তা কিন্তু নয়, প্রযুক্তি নিম্নবিত্ত নারীর কাছেও আছে। আবার প্রযুক্তির সহজলভ্যতার প্রশ্নে শ্রেণি বিষয়টিও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই একটি বিশেষ শ্রেণিকে বাদ দিয়ে শুধু উচ্চবিত্ত নারীদের নিয়ে নারী দিবসের থিমকে আলোকিত করা কোনোভাবেই নারীর দিবসের মূল ইতিহাসের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

এখানে আরেকটি বিষয়ও বলা প্রয়োজন যে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার ২০১৯ সালে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণের হার ৩৮ শতাংশ এবং তার বেশিরভাগই হলো পোশাকশিল্পের সঙ্গে যুক্ত। প্রশ্ন করুন নিজেকেই, বাংলাদেশে সরকারি এবং বেসরকারিভাবে উদযাপিত নারী দিবসে কেন শ্রমিক নারীদের যুক্ততা থাকে না, কিংবা তাদের যুক্ত করা হয় না? এই দিবসটিকে কেন্দ্র করে এনজিওগুলো প্রচুর অর্থ খরচ করেন, কিন্তু শ্রমিক নারীরা কোথাও নেই। আমি নিশ্চিতভাবেই জানি বাংলাদেশের বেশিরভাগ শ্রমিক নারীই এই দিবসটি নিয়ে জানে না। এভাবে শ্রমিক নারীরা এই দিনটির ইতিহাস নির্মাতা হলেও নারী দিবসটি তাদের কাছ থেকে ছিনতাই হয়ে গেছে।  

অন্যান্যবারের মতো এবারও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই দিবসকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন কোম্পানির  প্রচার করা নানা ধরনের স্লোগান এবং বার্তা নিয়েও চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। বিশেষ করে  বিভিন্ন কোম্পানির ‘আমি নারী, আমি সব পারি’ কিংবা ‘ঘর সামলাই, ব্যবসায়ও সামলাই’– এই বিষয়গুলো নিয়ে ব্যাপক তর্কবিতর্ক হচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন নারীকেই কেন সব পারতে হবে? কিন্তু সেসব আলোচনার কোথাও নেই এই দিবসটির নির্মাতা শ্রমজীবী নারীরা।

আর এটিও স্পষ্ট করে জানাতে চাই, ৮ মার্চ নারী দিবস হলেও এটি শুধু নারীর জন্য নয়। এই ইতিহাসকে নারী পুরুষ এবং অন্যান্য লিঙ্গের সব মানুষের। এই দিবসটি সব শ্রেণির। কারণ, আমাদের কাছে এই দিবসটি নিপীড়ন, বৈষম্য, শ্রমঘণ্টা, শ্রম চুক্তিসহ সব বিষয়ে দুনিয়াজুড়ে জারি থাকা বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের স্মারক। তাই বেনিয়াদের হাতে তুলে না দিয়ে, করপোরেট মিডিয়ার শ্রেণিভিত্তিক নারীর উপস্থাপনকে প্রাধান্য না দিয়ে বরং দিনটি যে সবার, সেই বিষয় নিয়েই কথা বলি। এই দিনটি শুধু একটি দিন নয় বরং এই দিনটিই যেন প্রতিদিন হয় এবং  নিপীড়ন, বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলার অনুপ্রেরণা, সেই বিষয়ে আমরা যেন মনোযোগী হই।

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

ইমেইল: [email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জাকিরের বিস্ফোরক ব্যাটিংয়ে প্রাইম ব্যাংকের বড় জয়
জাকিরের বিস্ফোরক ব্যাটিংয়ে প্রাইম ব্যাংকের বড় জয়
অবশেষে মোংলায় ঝরলো কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি
অবশেষে মোংলায় ঝরলো কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি
‘দেওরা’ সফলতার পর ‘মা লো মা’ চমক
‘দেওরা’ সফলতার পর ‘মা লো মা’ চমক
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আম্পায়ার তালিকায় সৈকত
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আম্পায়ার তালিকায় সৈকত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ