X
সোমবার, ০৬ মে ২০২৪
২২ বৈশাখ ১৪৩১

সৌদি আরব ও ইরানের কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় চীনের প্রভাব বাড়বে

শেখ শাহরিয়ার জামান
১২ মার্চ ২০২৩, ২০:৫৪আপডেট : ১২ মার্চ ২০২৩, ২২:০৬

চীনের মধ্যস্থতায় সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে পুনরায় কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। দুই বছর ধরে ত্রিপক্ষীয় আলোচনা চলছিল এবং এর চূড়ান্ত রূপ পায় ১০ মার্চ বেইজিংয়ে আলোচনার পরে যখন একটি চুক্তি সই হয়। চুক্তি অনুযায়ী দুই মাসের মধ্যে দূতাবাস খুলবে দুই দেশ এবং রাষ্ট্রদূত নিয়োগ দেবে। এছাড়া উভয় দেশ একে-অপরের সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে এবং অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাবে না।

২০১৬ থেকে সুন্নি-প্রধান সৌদি আরব এবং শিয়া-প্রধান ইরানের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন রয়েছে। এর আগে থেকেই দুই দেশের মধ্যে অস্থিরতা বিরাজ করছিল। মধ্যপ্রাচ্যের ওই দুই প্রভাবশালী রাষ্ট্রের মধ্যে উত্তেজনা গোটা অঞ্চলে বিভিন্ন দেশে অনুভূত হয়েছে এবং হচ্ছে। দুই দেশের মধ্যে প্রক্সি যুদ্ধের কারণে অশান্ত পরিস্থিতি বিরাজ করছে ইয়েমেনসহ অন্যান্য দেশে। এ প্রেক্ষাপটে চীনের মধ্যস্থতায় দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ গোটা দুনিয়ার নজর কেড়েছে।

চীনের সেন্ট্রাল ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিশনের পরিচালক ওয়াং ই-য়ের উপস্থিতিতে সৌদি আরবের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মোসাইদ বিন আহমেদ আল-আইবান এবং ইরানের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা আলি সামখানি চুক্তি সই করেন। চুক্তি সইয়ের পরে ওয়াং-ই বলেন, এটি সংলাপের জয়, শান্তির জয় এবং অস্থির বিশ্বে এটি একটি ভালো সংবাদ। নির্ভরযোগ্য এবং বিশ্বস্ত মধ্যস্থতাকারী হিসেবে চীন তার দায়িত্ব পালন করেছে এবং এ ধরনের গঠনমূলক দায়িত্ব চীন ভবিষ্যতেও পালন করবে এবং নিজেকে একটি দায়িত্বশীল দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবে।

চীনের এই উদ্যোগের প্রভাব স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে সারা পৃথিবীতে অনুভূত হবে।

স্বল্পমেয়াদি প্রভাব
রিয়াদ ও তেহরানের মতো বড় দুটি দেশের মধ্যে বিবাদ মীমাংসায় চীনের ভূমিকা বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে একটি বড় ঘটনা। এর আগে কখনও চীন এ ধরনের বড় ভূমিকা পালন করেনি। এর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যসহ বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে চীনের প্রভাব এবং সম্মান আরও বৃদ্ধি পাবে। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং গত বছরের ডিসেম্বরে সৌদি আরব সফর করেন এবং সেখানে গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিলের ছয় সদস্য রাষ্ট্রের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে রিয়াদে বৈঠকে করেন। এর ফলে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন প্রভাব কিছুটা হলেও ক্ষুণ্ন হয়েছে।

এখনও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর এক নম্বর অর্থনীতি এবং সামরিক শক্তির দিক থেকে প্রথম। তাদের সামরিক বাজেট পৃথিবীর যেকোনও দেশের থেকে বেশি। তাদের বৈশ্বিক প্রভাব বলয় যথেষ্ট মজবুত কিন্তু চীন তাদের ঘাড়ের ওপর নিশ্বাস ফেলছে, যা বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে। চীন সামরিক শক্তি প্রদর্শন করার পরিবর্তে শান্তি প্রতিষ্ঠা, সংলাপ, স্থিতিশীলতাসহ অন্যান্য কোমল শক্তির (সফট পাওয়ার) ওপর বেশি জোর দিচ্ছে। সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে বিরোধ মীমাংসা এর একটি বড় উদাহরণ।

চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য একমাত্র চীনই ১২-দফা প্রস্তাব পেশ করেছে। সফল মধ্যস্থতাকারী হিসেবে চীন এখন অনেক বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারবে বলে আশা করা হচ্ছে। আগামী এপ্রিল অথবা মে মাসে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের মস্কো সফর করার সম্ভাবনা আছে। আশা করা হচ্ছে, যুদ্ধ বন্ধে সে সময় আলোচনা হতে পারে।

মধ্য মেয়াদে প্রভাব
চীনের আকাঙ্ক্ষা হচ্ছে বিশ্বের এক নম্বর শক্তিধর দেশ হওয়া এবং তারা তাদের বৈশ্বিক অবস্থান আরও সংহত করার চেষ্টা করবে। বেইজিং বর্তমানে তাদের সম্পর্কে যে ন্যারেটিভ দেয়, সেটি হচ্ছে তারা একটি দায়িত্বশীল দেশ এবং ঠান্ডা মাথায় সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষমতা রাখে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে চীনের একটি বেলুনকে গুলি করে ভূপাতিত করা হয়। ওই সময়ে চীনের বক্তব্য ছিল, বেলুনটি আবহাওয়া সংক্রান্ত তথ্যের কাজ করছিল এবং গুলি করে ভূপাতিত করে ওয়াশিংটন প্রমাণ করেছে তারা ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষমতা রাখে না ওই দেশের রাজনৈতিক দল, মিডিয়া, সুশীল সমাজসহ অন্যান্য পারিপার্শ্বিক চাপে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সরকারে বিজ্ঞতার অভাব অনেক সময় দেখা যায়। রাজনৈতিক দল, মিডিয়া, সুশীল সমাজসহ অন্যান্য পারিপার্শ্বিক চাপ থেকে মুক্ত রয়েছে চীন এবং সে কারণে তারা অনেক ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষমতা রাখে এবং এ ধরনের ন্যারেটিভ তারা এখন প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রচারণা চালাবে।

দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব
একটি প্রতিষ্ঠিত শক্তিধর (সুপার পাওয়ার) রাষ্ট্রকে যখন আকাঙ্ক্ষাকারী শক্তিধর (এসপায়ারিং পাওয়ার) রাষ্ট্র চ্যালেঞ্জ করে তখন গোটা বিশ্বে একটি অস্থিরতা দেখা দেয়। ভবিষ্যতে চীনকে মোকাবিলা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি বলবৎ থাকবে। অন্যদিকে চীন চাইবে তাদের প্রভাব বলয়ের বিস্তৃতি এবং এজন্য বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) পাশাপাশি তারা গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (জিডিআই) এবং গ্লোবাল সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভকে (জিএসআই) আরও জনপ্রিয় করার চেষ্টা চালাবে। চীনের উদ্যোগের একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বহুপাক্ষিক ব্যবস্থার ওপর জোর দেওয়া এবং সবাইকে নিয়ে অগ্রসর হওয়া। এখানে লক্ষণীয় যে গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ অনেকটা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অনুকরণে করা। কিন্তু গ্লোবাল সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভটি নতুন একটি ধারণা, যেখানে শক্তিশালী বহুপাক্ষিক ব্যবস্থার মাধ্যমে নিরাপত্তা নিশ্চিতের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে সাধারণভাবে বলা যায়, ওয়াশিংটন কনসেনসাস এবং বেইজিং কনসেনসাসের মধ্যে মতবাদের যে দ্বন্দ্ব সেটি সামনের দিনগুলোতে অব্যাহত থাকবে।

বাংলাদেশের ওপর প্রভাব
সৌদি আরব ও ইরানের বিবাদ মীমাংসার কারণে মধ্যপ্রাচ্য সংক্রান্ত বিষয়াদিতে উপকৃত হবে বাংলাদেশ। কিন্তু বৃহৎ শক্তির দ্বন্দ্ব আগের থেকে প্রকট হবে বলে প্রতীয়মান হয় এবং এ কারণে ভারসাম্য নীতি বজায় রাখা আরও কঠিন হবে।

ইরানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অনেক পুরনো কিন্তু সৌদি আরবের সঙ্গে দেশটির বিরোধের কারণে অনেক সময়ে সহযোগিতার উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হয়নি। একই ধরনের ঘটনায় ২০১৭ সালে কাতারের সঙ্গে সৌদি আরব বিরোধ তুঙ্গে ছিল এবং ওই সময়ে বিবদমান একটি পক্ষের সঙ্গে সম্পর্ক শিথিল করার জন্য আরেকটি পক্ষ বাংলাদেশের ওপর চাপ দিয়েছিল। ২০২১ সালে রিয়াদ ও দোহার মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার পরে এ ধরনের চাপ দেওয়া হয়নি। একইভাবে আশা করা যায়, ইরানের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার ফলে তেহরানের সঙ্গে সহযোগিতা বৃদ্ধি করা বাংলাদেশের জন্য সহজ হবে।

দুই বৃহৎ শক্তির দ্বন্দ্ব চলমান রয়েছে এবং সামনের দিনগুলোতে অব্যাহত থাকবে বা আরও বেশি ঘনীভূত হওয়ার আশঙ্কা আছে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীন উভয়ই বাংলাদেশকে তাদের পাশে চাইবে এটি স্বাভাবিক ঘটনা। এক্ষেত্রে বাংলাদেশকে ক্রমাগত ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান বজায় রাখার প্রয়াস চালাতে হবে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ যেকোনও ধরনের আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে আগ্রহ প্রদর্শন করেছে এবং যেকোনও নিরাপত্তা বা প্রতিরক্ষা বলয়ে যুক্ত হতে চায়নি। এ ধারা সামনের দিনগুলোতে অব্যাহত থাকবে বলে আশা করা যায়। যদিও জাপানের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তির ফলাফল কী হবে সেটি আগাম বলা মুশকিল। কারণ, টোকিও চার জাতি নিরাপত্তা জোট কোয়াডের সদস্য।

রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে চীন মধ্যস্থতা করছে। ইতোমধ্যে চীনের উদ্যোগে ত্রিপক্ষীয় বেশ কয়েকটি বৈঠক হয়েছে। মধ্যস্থতাকারী হিসাবে বেইজিংয়ের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির কারণে এখন বাংলাদেশ আশা করছে, চীন এ বিষয়ে আরও উদ্যোগী হবে এবং ওই সমস্যা সমাধানে আরও বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে।

লেখক: বিশেষ প্রতিনিধি, বাংলা ট্রিবিউন

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
লখনউকে বড় হারের লজ্জা দিয়ে শীর্ষে কলকাতা
লখনউকে বড় হারের লজ্জা দিয়ে শীর্ষে কলকাতা
ন্যাশনাল ব্যাংকে নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন, নিয়োগ পেলেন ১০ জন 
ন্যাশনাল ব্যাংকে নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন, নিয়োগ পেলেন ১০ জন 
স্বস্তির জয়ে শিরোপার লড়াইয়ে ফিরলো লিভারপুল
স্বস্তির জয়ে শিরোপার লড়াইয়ে ফিরলো লিভারপুল
ফিলিস্তিনে যুদ্ধাপরাধে দায়ীদের জবাবদিহি চায় ঢাকা
ফিলিস্তিনে যুদ্ধাপরাধে দায়ীদের জবাবদিহি চায় ঢাকা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ