X
বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪
১৮ বৈশাখ ১৪৩১

সড়ক সুশাসন

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
২২ মার্চ ২০২৩, ১৭:৩২আপডেট : ২২ মার্চ ২০২৩, ১৭:৩২

পথে পথে বলি হচ্ছে মানুষ। বলতে গেলে এক প্রকার গণহারে হত্যা চলছে। প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি হয়। গত রবিবার পদ্মা সেতুর এক্সপ্রেসওয়েতে ইমাদ পরিবহন নামের এক বাস দুর্ঘটনায় ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। এটিই শেষ নয়। ওই দিন এবং আজ পর্যন্ত প্রতিদিনই সড়কে প্রাণহানি ঘটছে।

মৃত্যু আর আহতদের সংখ্যা দিয়ে আর ভাবা যাচ্ছে না। সড়ক দুর্ঘটনার নতুন নতুন পরিসংখ্যান আসে, কিন্তু পরিত্রাণ মেলে না। যা স্বাভাবিক, যা অহরহ ঘটে তা নিয়ে সমাজে কোনও ভাবনাও তৈরি হয় না। সড়ক দুর্ঘটনা এবং তাতে প্রাণহানি খুব স্বাভাবিক বিষয় এখন বাংলাদেশে। তাই সরকার নির্বিকার, পরিবহন খাতের লোকজন নিশ্চিন্ত মনে এসব মেনে নিয়েছেন। বরং সড়ক দুর্ঘটনার ভিকটিমরা, তাদের পরিবারের লোকজনকেই এখন সব দায় নিতে হচ্ছে। আমরা যতই বলি না কেন, একশ্রেণির চালকের বেপরোয়া মনোভাবের জন্য, গাড়ির ফিটনেস না থাকায়, নিয়ম না মানায় দুর্ঘটনা কমানো যাচ্ছে না, তার কোনও মূল্য নেই।

ইমাদ পরিবহনের সেই বাসের চলাচলের অনুমতি ছিল না। ছিল না ফিটনেস সনদও। তারপরও সেটি নিয়মিত ঢাকা থেকে খুলনার পথে যাত্রী পরিবহন করছিল। এমন শত শত বাস পদ্মা সেতু হয়ে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় অবৈধভাবে চলাচল করছে। এরমধ্যে বড় বড় পরিবহন কোম্পানির বাসও আছে।

সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে যারা একটু কথাবার্তা বলে, আন্দোলন করার চেষ্টা করে তারাই এখন পরিবহন খাতের মালিক-শ্রমিক মাফিয়া গোষ্ঠী ও সরকারের লোকজনের চক্ষুশূল। ফলে আমরা বেশ বুঝতে পারি এখন, এই যে প্রতিদিন এত এত দুর্ঘটনা হয়, মানুষ নিহত আহত হয়, এর সব দায় প্রকৃতপক্ষে পথচারী, সাধারণ যাত্রী, ক্ষুদ্র ভ্যান জাতীয় পরিবহনের, প্রাইভেটকার আর মাইক্রোবাসের। বড় বাস, ট্রাকচালকরা আর তাদের মালিকরা এবং সরকারি কর্তৃপক্ষ আসলে নিষ্পাপ প্রতিটি ঘটনায়।

অনেকেই ভাবতে পারেন, প্রশ্নও করেন যে জাতি যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করতে পারে, খাদ্য ও পুষ্টিতে সাফল্য দেখাতে পারে, বিশ্বব্যাংকের বিরোধিতা সত্ত্বেও পদ্মা সেতু করতে পারে, সে জাতি কেন পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা আনতে পারে না? উত্তর আছে। কেন সড়কে শৃঙ্খলা আসে না, দুর্ঘটনা কমে না, এর প্রধান কারণ হলো যে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সড়ক দুর্ঘটনায় অতি সাধারণ যাত্রী ও পথচারী মানুষ মারা যায়, তাই রাষ্ট্র, সরকার, পরিবহন খাত কারও কিছু আসে যায় না। পরিবহন খাতের যারা মারা যায় তারাও আসলে দরিদ্র পরিবহন শ্রমিক। তাই এই নিয়ে চিন্তাও করাও হয় না।

আরেকটা বড় কারণ রাজনীতি। সড়ক পরিবহন খাতকে রাজনীতিতে ব্যবহার করা যায়। বিরোধী দলের কর্মসূচি ভেস্তে দিতে পরিবহন ধর্মঘট ডাকানো যায়, সড়ক পথ অচল করে দেওয়া যায়। এটিই একমাত্র ব্যবসা যে খাতে নৈরাজ্যের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ সড়ক গণপরিবহনের মালিক, শ্রমিক ও রাজনীতি। এই নৈরাজ্যের পক্ষে অবস্থান নিতে ডান, বাম, অতি ডান ও বাম, ক্ষমতাসীন আর ক্ষমতার বাইরের রাজনীতির কোনও বিরোধ নেই।

এমন কোনও দিন নেই, যেদিন দেশের কোনও না কোনও এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনা না ঘটছে। প্রতিদিনই দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। মানুষ আহত হয়ে চিরতরে পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে। নিহত ও আহত হওয়া এসব মানুষের কী দুর্দশা, তা কেউ জানে না। প্রশ্নটা সড়ক নিরাপত্তার এবং সেটা নিয়ে ভাবনা কম। কারণ, একটা অংশ, যারা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী, তারা এই খাতে চাঁদাবাজি সংস্কৃতি জিইয়ে কোনও আইনকেই কার্যকর করতে দিচ্ছে না। এবং এদের সাথে আছে ক্ষমতার কেন্দ্রের সম্পর্ক।

দুর্ঘটনার সিংহভাগই অদক্ষ চালক, বেপরোয়া যান চালনা এবং সড়কের নিয়ম-নীতি না মানার কারণে ঘটে থাকে। এই যে ইমাদ পরিবহনের বাসটির ফিটনেস ছিল না, রাস্তায় চলাচলের অনুমতি ছিল না, অতিরিক্ত সময় ধরে গাড়ি চালানোয় চালক স্বাভাবিক অবস্থায় ছিলেন না, এ জন্য এই বাস মালিকের কোথাও কোনও জবাবদিহি করতে হবে না, কারণ, তার পাশে আছে ক্ষমতাধর পরিবহন মালিক শ্রমিক নেতারা। বাসটি কীভাবে সড়কে এলো, চললো– সে জন্য কোনও জবাবদিহি করতে হবে না পুলিশ ও সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষকে। ঘুরেফিরে সেই কথাটিই আসে, কারণ এসব অন্যায়, অনিয়ম আর দুর্বৃত্তপনার ভিকটিম অতি সাধারণ মানুষ। সড়ক দুর্ঘটনায় একটি পরিবারের উপার্জনক্ষম কোন সদস্য মৃত্যু বা পঙ্গুত্বের শিকার হলে সে পরিবারটি কি শোচনীয় ও অশেষ দুর্ভোগের মধ্যে পড়ে, তা তারা ছাড়া আর কারও পক্ষে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। যাদের ভাববার কথা তারা উপলব্ধি করতেও চান না।

পৃথিবীর যেসব দেশে সড়ক নিরাপদ রাখার জন্য কোনও আচরণবিধি বা কোড নেই, বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে যে আইন করা হয়, তা আজও বাস্তবায়ন করা হয়নি পরিবহন মাস্তানির কারণে। আমরা বড় রাস্তা করছি, কিন্তু সড়ক সুশাসন কায়েমের অনিচ্ছায় সব শেষ হয়ে যাচ্ছে। নজরদারির ওপর নজরদারির প্রয়োজন। কিন্তু কে করবে সেটা?

সড়ক পরিবহনের মালিক শ্রমিক নেতারা যা করতে চান সবই পারেন বিনা বাধায়, বরং দেখা যায় তাদের প্রতি আছে ক্ষমতা কাঠামোর প্রশ্রয়। ক্ষমতা কাঠামোকে ব্যবহার করে মালিক-শ্রমিক ঐক্যবদ্ধ হয়ে পুরো সিস্টেমকেই নিজেদের করায়ত্ত করেছে। এ কারণে যানবাহন নিয়ন্ত্রণের যেসব একেবারে মৌলিক পদ্ধতি, সেগুলোই প্রয়োগ করা সম্ভব হচ্ছে না। কোনও আইন বা নীতি বাস্তবায়ন করতে গেলেই পরিবহন ধর্মঘট করে যাত্রীদের জিম্মি করার কৌশল নেয় পরিবহন মাফিয়া গোষ্ঠী। বাংলাদেশে আর কোনও খাত নেই যেখানে নৈরাজ্যের পক্ষে এমন শক্তিশালী রাজনীতি আছে। পথচারী ও যাত্রী, উভয়কেই মানুষের পর্যায়ে বিবেচনা না করার মাস্তানতন্ত্রের হাত থেকে সড়ক পরিবহন খাতকে মুক্ত করার অপেক্ষায় পুরো জাতি।

লেখক: সাংবাদিক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ইজিবাইক ছিনতাইয়ের সময় স্থানীয়দের পিটুনিতে একজনের মৃত্যু
ইজিবাইক ছিনতাইয়ের সময় স্থানীয়দের পিটুনিতে একজনের মৃত্যু
স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে শ্রমিকরাও অংশীদার হবে: এমপি কামাল
স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে শ্রমিকরাও অংশীদার হবে: এমপি কামাল
মোস্তাফিজের শেষ ম্যাচে চেন্নাইয়ের হার
মোস্তাফিজের শেষ ম্যাচে চেন্নাইয়ের হার
তীব্র তাপপ্রবাহ যেখানে আশীর্বাদ
তীব্র তাপপ্রবাহ যেখানে আশীর্বাদ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ