করোনা পরবর্তী সময়ে মানুষ যখন স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে শুরু করেছিল, ঠিক সেই সময় ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধ পৃথিবীব্যাপী এক নতুন সংকট সৃষ্টি করেছে। সেই সংকট হচ্ছে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা, যার প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রব্যমূল্যের অসহনীয় বৃদ্ধি হয়েছে। ফলে, বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারের দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি মানুষের জীবন ও জীবিকাকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করেছে। মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্তের মানুষ জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করতে অসহনীয় বেগ পাচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে বাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হলেও এর প্রভাব বাজারে খুব বেশি দেখা যাচ্ছে না।
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে যেসব পণ্য বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে সেসব পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের দাম বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে সরকারকে বারবার অভ্যন্তরীণ মুদ্রার মানের অবমূল্যায়ন করতে হয়েছে। তাছাড়া, আমদানি পণ্যের দাম পরিশোধ করতে গিয়ে দেশে ডলারের ঘাটতি দেখা দিয়েছিল কিছু দিন আগে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু কার্যকর পদক্ষেপের কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে শঙ্কা কেটেছে। তবে, এসব বিষয়ের প্রভাবে বাজারে দ্রব্যমূল্যের এমন ঊর্ধ্বগতি সমাজে এক ধরনের অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
এই অস্বস্তিকর পরিস্থিতি চলমান অবস্থায় ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে রোজা শুরু হয়েছে। অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে এ কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, দেশে রোজার সময়ে এক প্রকার অসাধু ব্যবসায়ী অতিরিক্ত মুনাফা লাভের আশায় বাজারে কৃত্রিমভাবে দ্রব্যের সংকট তৈরি করে দাম বাড়িয়ে দেয়। সেই অবস্থা এবারও হতে চলেছে। রোজাকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যে বাজারে আরেক দফা নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে দেশের সব বাজারে প্রশাসনের মোবাইল কোর্ট পরিচালনার সক্ষমতা নেই। ফলে, মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে দেশব্যাপী বাজার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। যখন কোনও বাজারে মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হয়, তখন সেই বাজারে কিছুটা উন্নতি লক্ষ করা গেলেও অন্য জায়গায় একই অবস্থা বিরাজমান থাকে। মোবাইল কোর্টের সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজন ব্যবসায়ীদের সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। যদিও ব্যবসায়ীদের কেন্দ্রীয় সংগঠনের নেতৃবৃন্দ বাজারে কৃত্রিমভাবে দ্রব্যের সংকট তৈরি না করতে ব্যবসায়ীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু তাদের এই আহ্বানে ব্যবসায়ীরা কতটা সায় দেবে সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। তাছাড়া ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সিন্ডিকেট বিভিন্নভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। সেই সিন্ডিকেটগুলোকে যদি আমরা ভাঙতে না পারি তাহলে বাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কঠিন।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতির আরেকটা কারণ হচ্ছে ক্রেতাদের মধ্যে ঐক্য না থাকা। তাছাড়া, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণের জন্য যে বিভাগটি রয়েছে সে বিভাগের কার্যক্রমকে আরও বেগবান করতে হবে। ক্রেতারা অনেকেই জানে না যে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ বিভাগে অভিযোগ দায়ের করা হলে সেখান থেকে প্রতিকার পাওয়া যায়। তাছাড়াও ক্রেতাদের মধ্যে যদি ঐক্য থাকতো তাহলে ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতো। আমরা যদি সাম্প্রতিক সময়ের বাজারের চিত্র বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখা যাবে কোনও কারণ ছাড়াই কিছু পণ্যের অসম্ভব মূল্য বৃদ্ধি হয়েছে।
গত তিন মাস আগেও বাজারে খাসির মাংসের মূল্য ছিল প্রতি কেজি ৮০০ টাকা, যা বর্তমানে ১০৫০/১১০০ টাকায় ছাড়িয়েছে। এই মূল্যবৃদ্ধির কোনও সদুত্তর ব্যবসায়ীরা দিতে পারে না। কারণ, বাংলাদেশ বিদেশ থেকে খাসি আমদানি করে না। দেশের মাটিতে প্রতিপালিত ছাগলের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ খাসির মাংসের চাহিদা মেটানো হয়। ফলে, আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি কিংবা ডলারের মূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে খাসির মাংসের কোনও সংযোগ নেই।
ফলে কেন প্রতি কেজি খাসির মাংসে প্রায় ৩০০ টাকা বৃদ্ধি হলো এর কোনও সদুত্তর যেমন ক্রেতার কাছে নেই, ঠিক তেমনিভাবে বিক্রেতাদের কাছেও নেই। বিক্রেতারা নিজের মতো করে একটা পরিস্থিতি তৈরি করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করছে। ক্রেতাদের মধ্যে যদি ঐক্য থাকতো এবং ক্রেতারা যদি দুই সপ্তাহ খাসির মাংস কেনা থেকে বিরত থাকতো, তাহলে বাজারে খাসির মাংসের মূল্য এমনিতেই কমে যেত। একই পরিস্থিতি দেশি মুরগির দামের ক্ষেত্রে। তিন মাস আগে প্রতি কেজি দেশি মুরগির দাম ছিল ৩৪০ থেকে ৩৫০ টাকা, যা এখন বেড়ে ৫০০ টাকা হয়েছে। এমনকি বাজারে পর্যাপ্ত দেশি মুরগি পাওয়া যাচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো আমরা কি দেশি মুরগি বিদেশ থেকে আমদানি করি? যদি তা না করা হয়ে থাকে তাহলে বাজারে দেশি মুরগির দাম বাড়লো কেন? বিষয়টি এমনও নয় যে দেশি মুরগিকে বিভিন্ন ধরনের ফিড খাওয়ানো হয়। সবকিছুর মূলে রয়েছে ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট। তারা যা খুশি তাই করছে, যেখানে ক্রেতাদের বলার কোনও সুযোগ নেই।
ক্রেতা অধিকার সংরক্ষণ সংক্রান্ত যেসব বিভাগ রয়েছে তাদের আরও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে এবং ক্রেতাদের মধ্যে ঐক্য বাড়াতে হবে।
বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষের আমিষের প্রধান উৎস ব্রয়লার মুরগি, সিলভার কাপ এবং পাঙ্গাশ মাছ। কিন্তু ব্রয়লার মুরগি এবং এসব মাছের বাজারে ব্যাপক মূল্য বৃদ্ধি হয়েছে। কয়েক মাস আগে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগির দাম ছিল ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা। বর্তমানে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগির দাম হয়েছে ২৪০ থেকে ২৬০ টাকা। একই ধরনের মূল্য বৃদ্ধি হয়েছে পাঙ্গাশ কিংবা সিলভার কাপ মাছের ক্ষেত্রে। ফলে, মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষ নিজেদের আমিষের চাহিদা মেটাতে পারছে না। এটি একদিকে যেমন মানুষের ওপর মনস্তাত্ত্বিক চাপ বাড়াবে, একই সাথে আমিষের ঘাটতির কারণে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমতে শুরু করবে, যা ভবিষ্যতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য একটি বড় হুমকি হতে পারে।
বেশ কয়েক দিন আগে একজন ব্যক্তির গল্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল। সেই গল্পে একজন ক্রেতাকে রাতের ঢাকার কাওরান বাজারে মুরগির গলা-গিলা-কলিজা কিনতে দেখা গেছে। কেন শুধু গলা-গিলা-কলিজা কিনছেন একজন সাংবাদিকের এই প্রশ্নের উত্তরে তাকে বলতে দেখা গেছে, ‘আগে গোটা ব্রয়লার মুরগি কিনতাম। কিন্তু এখন আর সেটা কেনার সামর্থ্য আমার নেই বিধায় গলা-গিলা-কলিজা দিয়েই কাজ চালিয়ে নিতে হচ্ছে’। একই সঙ্গে সেই ব্যক্তিকে দুই পিস মাংস কিনতেও দেখা গেছে। সাংবাদিক যখন তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন কেন দুই পিস মাংস কিনলেন, তিনি তখন বলেছিলেন, ‘আমার ঘরে একটি সন্তান রয়েছে। তার গলা-গিলা-কলিজা দিয়ে চলবে না। সে মাংস খেতে চাইবে। তাই তার জন্য আমাকে দুই পিস মাংস নিতে হচ্ছে’। এটি শুধু একজন পিতার অবস্থা নয়। বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সেই ব্যক্তি বাংলাদেশের একটা অংশের পিতাদের প্রতিনিধিত্ব করছেন। এমনকি যারা চাকরি করছেন তাদের জীবনও অনেক কঠিন হয়ে গেছে।
তবে সরকারের পক্ষ থেকে বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। আমরা আশা করি সরকার প্রশাসনের মাধ্যমে কিছু দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, যার মাধ্যমে বাজারে মূল্য বৃদ্ধি কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে থাকবে। বাজার নিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন উদ্যোগের সঙ্গে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী রোজার সময় এক কোটি পরিবারকে ১৫ টাকা কেজিতে চাল সরবরাহের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। সরকারের মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে খেটে খাওয়া মানুষের জীবিকা ও নির্বাহ করা কিছুটা হলেও সহজ হবে। একটি জিনিস আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে করোনা পরবর্তী সময়ে ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধের ফলে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই ধরনের অবস্থা তৈরি হয়েছে। অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থা এখনও বেশ ভালো রয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বের কারণে বাংলাদেশের মানুষ এখন পর্যন্ত বৈশ্বিক অর্থনীতির মন্দার সর্বোচ্চ নেতিবাচক প্রভাব বুঝতে পারেনি।
তবে, এই ধরনের অবস্থায় শুধু সরকারের মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। সরকারের পাশাপাশি জনগণ ও ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসতে হবে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই পরিস্থিতি মোকাবিলা সম্ভব। তবে যেহেতু ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে সংসদের দ্বাদশ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, এই কয়েক মাস বর্তমান সরকারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি গোষ্ঠী দেশে এবং বিদেশে বিভিন্ন ধরনের ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সরকারকে বেকায়দায় ফেলবার চেষ্টা করে চলেছে। একই সঙ্গে সরকার সম্পর্কে জনগণের মধ্যে এক ধরনের নেতিবাচক মনোভাব তৈরির জন্য কাজ করছে। বাজারে দ্রব্যমূলের ঊর্ধ্বগতি জনগণের মধ্যে সরকার সম্পর্কে একটা নেতিবাচক ধারণা তৈরিতে সহায়তা করতে পারে। এ বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনা করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অবশ্যই এমন সিদ্ধান্ত নেবেন যাতে বাজারে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা যায়। পাশাপাশি ক্রেতাদের ঐক্য এবং ব্যবসায়ীদের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বাজার নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করতে পারে।
লেখক: অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।