X
বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪
১৯ বৈশাখ ১৪৩১

কর ফাঁকি ও করদাতার আত্মহরণ ঠেকানো জরুরি

মোহাম্মদ সিরাজ উদ্দিন
০৯ মে ২০২৩, ২০:০৪আপডেট : ০৯ মে ২০২৩, ২০:০৪

শিরোনামে যাওয়ার আগে করযোগ্য করদাতা চিহ্নিতকরণে আমাদের দুর্বলতাগুলোর কথা বলা দরকার। একজন নাগরিক কখন করযোগ্য হবেন, আর কখন করযোগ্য হবেন না; তা আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪-এর ৭৫-এ ধারা ও অর্থ আইনে চিহ্নিত করা হয়েছে। দুই জায়গায় নীতিগতভাবে কিছু ত্রুটি থাকলেও তা মেনেই আয়কর হিসাব করা হয়। বিগত অর্থবছরে ২০২২-২৩ অর্থ আইনে ৩৮ বা ৪০টি খাতের সেবা নিতে গেলেই আয়কর রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এর পেছনের যুক্তি ছিল এতে করদাতার সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। আসলে কী তা হয়েছে? বরং এই যুক্তিটা তেমন কাজে দেয়নি। বিগত বছরের রিটার্ন জমার পর্যালোচনা করলে তার চিত্র স্পষ্ট। রিটার্ন জমা পড়ার সংখ্যা কিছুটা বাড়ছে বটে, রাজস্ব বৃদ্ধি পায়নি, বরং নাগরিক হয়রানি বাড়ছে কিছুটা। যারা বাধ্যতামূলকভাবে আয়কর রিটার্ন জমা দিচ্ছেন তাদের অধিকাংশই শূন্য রিটার্ন জমা দিচ্ছেন। যার ফলে রাজস্ব আয় কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় অর্জিত হয়নি।

অন্যদিকে যারা বর্তমান কর আইনে করযোগ্য তাদের অনেকে আগের মতো কর ফাঁকি দেওয়ার পথেই আছেন, বরং নতুন নতুন পথ আবিষ্কারেও ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। যারা কিছুটা ইতিবাচক, কর দিতে আগ্রহী, তারা কর অফিসের নেতিবাচক ব্যবহারের কথা শুনে দূরে সরে যান। অনেকে বলেন ‘না দেওয়াই ভালো, দিতে গেলে নানান হয়রানিতে পড়তে হয়’। আমার কাছে পরামর্শ নিতে এসেছেন এমন অনেক মানুষকে পরবর্তীতে ট্যাক্স ফাইল করতে অনুৎসাহিত হতে দেখেছি। জিজ্ঞাসা করলে বলে– ‘ভাই খাল কেটে কুমির ডেকে আনতে যাবো কেন? কর দেবো রাষ্ট্রের রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য; অথচ সেখানে নাকি নানান ধরনের হয়রানির শিকার হতে হয়। নিজের আয়-রোজগারের টাকা থেকে রাষ্ট্রকে ট্যাক্স দেবো, আবার উল্টো হামলা-মামলার মধ্যে পড়তে হবে, এগুলো করতে চাই না’।

আমার আগের একটি কলামে সম্ভবত উল্লেখ করেছিলাম– নেতিবাচক কথাগুলো বাতাসে সবার আগে ভেসে বেড়ায়। বাস্তবতা হলো সব করদাতা যেমন হয়রানির শিকার হন না, তেমনি অকারণে অনেকে হয়রানিতে পড়েননি, তাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। রাজস্ব বিভাগকে কর ফাঁকি ও করদাতার অন্তর্নিহিত কথাগুলো মূল্যায়ন করেই এগোতে হবে।

ন্যূনতম করযোগ্য নাগরিক ও ৪০টি সেবার ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক আয়কর রিটার্ন জমার নিয়মে ত্রুটির বিষয়টি হলো– করযোগ্য আয় কতজনের আছে তা বিবেচনায় রাখা হয়নি। কর রেয়াতযোগ্য আয় বাদ দিয়ে কোনও নাগরিক যদি সংশ্লিষ্ট আয় বছরে ৩ লাখ টাকা আয় করেন তাহলে উক্ত নাগরিককে করযোগ্য নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হয়। এখন যে ৪০টি সেবার জন্য আয়কর রিটার্ন জমা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে উক্ত সেবা গ্রহীতাদের মধ্যে কত জনের বছরে ৩ লাখ টাকা করযোগ্য আয় আছে? এটা বিবেচনা করা দরকার।

অনেক অসঙ্গতিপূর্ণ শর্তের মধ্যে– ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণ, সমবায় সমিতির রেজিস্ট্রেশন ইত্যাদি কয়েকটি উল্লেখযোগ্য। একজন উদ্যোক্তা নতুন ব্যবসা করতে গিয়ে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট করতে হয়, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট করতে হলে ট্রেড লাইসেন্স করা বাধ্যতামূলক। এখন বিভিন্ন উৎস থেকে ধারদেনা করে একজন উদ্যোক্তা কোনও একটা ব্যবসা শুরু করেন; শুরুতেই আয় কোথায় পাবেন? আইন অনুযায়ী করযোগ্য আয় থাকলে ট্যাক্স দিতে হবে, এখানে আয় শুরু না করতেই আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়া কতটা যৌক্তিক তা বিবেচনা করা দরকার।

আবার সমবায় সমিতির কথা ধরা যাক। আমরা সবাই জানি, সমবায় সমিতি কারা করেন। সমাজে অনগ্রসর জনগোষ্ঠী, ছোট ছোট পেশায় নিয়োজিত শ্রমিক ও শ্রমজীবী মানুষেরাই নিজেদের পারস্পরিক সমৃদ্ধির জন্য এক হয়ে সঞ্চয় জমা করে পুঁজির সংস্থান করে থাকে। এই সমবায় সমিতি নিবন্ধন নেওয়ার সময় আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে তেমন কোনও যৌক্তিকতা আছে বলে মনে হয় না। কারণ, নিবন্ধন নিয়ে পুঁজির সংস্থান করে কয়েক বছর পর তারা যৌথভাবে কোনও আয়বর্ধক কাজে যুক্ত হন। এরমধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশের বেশি সমবায় সমিতি নিজেদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে বন্ধ হয়ে যায়। এখানে অনেকের প্রশ্ন, একটা সমিতি আয় না করতে আয়কর রিটার্ন দাখিলের যৌক্তিকতা কি? উত্তর জানা দরকার। সুতরাং জেনারেল সেবার ক্ষেত্রে আয়কর রিটার্ন বাধ্যতামূলক করার বিষয়গুলো আসন্ন বাজেটে পুনর্বিবেচনা করা জরুরি।

আসন্ন বাজেটে বা অর্থ আইন ২০২৩-২৪-এ যে কর ফাঁকি ঠেকানোর যেমন জরুরি, তেমনি করদাতারা হয়রানির শিকার হন এমন ব্যবস্থাগুলো তুলে দেওয়ার প্রতি নজর দেওয়া জরুরি। এ ক্ষেত্রে যে সুপারিশগুলো বিবেচনা করা যেতে পারে:

১. অর্থপাচার বন্ধে কঠোর নজরদারি বাড়ানো এবং যেসব দেশে পাচার করা হচ্ছে, সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক যোগাযোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার ব্যবস্থা রাখা;

২. যারা অর্থপাচার করে বিদেশে স্থায়ী সম্পদ ক্রয় করবে; তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে, সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাসের মাধ্যমে বিক্রির ব্যবস্থা করে অর্থ দেশে ফেরত আনার ব্যবস্থা রাখা;

৩. কর সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কার্যক্রম গ্রহণ করা;

৪. করভীতি দূর করার জন্য করদাতাবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা;

৫. রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ থেকে তালিকা সংগ্রহ করে প্রত্যেক বাড়িওয়ালাদের ট্যাক্স প্রদান নিশ্চিত করা;

৬. সিটি করপোরেশন বা মহানগর এলাকায় প্রতিটি পাড়ায় বাড়ির মালিক সমিতিগুলোকে চিহ্নিত করে প্রত্যেক বাড়িওয়ালার ট্যাক্স ফাইল নিশ্চিত করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর সার্কেল থেকে চিঠি ইস্যু করা জরুরি;

৭. প্রত্যেক করদাতার আয়কর নথির সঙ্গে করদাতার সব ব্যাংক হিসাবের স্টেটমেন্ট/ব্যাংক লেনদেন বিবরণী দাখিল বাধ্যতামূলক করা;

৮. নতুন উদ্যোক্তাদের কমপক্ষে ৩ বছর টিআইএন খোলার বাধ্যবাধকতা থেকে অব্যাহতি দেওয়া;

৯. করবর্ষে ১ কোটি টাকার লেনদেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসার ক্ষেত্রে নিরীক্ষা প্রতিবেদন বাধ্যতামূলক না করা;

১০. করদাতার নিট সম্পত্তি ১ কোটি টাকার অধিক হলে একজন আয়কর আইনজীবীর মাধ্যমে অ্যাসেসমেন্ট করার বিধান করা;

১১. করদাতার আয়-ব্যয় ও করদায় নির্ণয় করার ক্ষেত্রে কর অফিসের কোনও কর্মচারীকে জড়িত না থাকার বিষয়ে নিরুৎসাহিত করা;  

১২. করদাতার নামে যেকোনও নোটিশ ইস্যুর করার আগে সংশ্লিষ্ট কর অফিস কর্তৃক করদাতার সঙ্গে বা তার প্রতিনিধির সঙ্গে নোটিশ ইস্যুর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা। অনেক ক্ষেত্রে এই আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। এতে কর অফিসের সময় বাঁচবে এবং করদাতাদের মধ্যে করভীতি কমে আসবে।

১৩. নাগরিক পরিষেবাগুলোর ক্ষেত্রে কতিপয় ক্ষেত্র ব্যতীত ট্যাক্স ফাইল জমা বাধ্যতামূলক না করা;

মূলত একটি করবান্ধব পরিবেশ ও গণসচেতনতাই আমাদের রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। এই জন্য করদাতার যেমন এগিয়ে আসতে হবে, একইভাবে কর অফিসকে ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে সেবার মান বৃদ্ধি করতে হবে। তবেই সম্ভব কর ফাঁকি রোধ ও করদাতাবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা।

লেখক: আয়কর আইনজীবী

[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চীনের দক্ষিণাঞ্চলে সড়ক ধসে নিহত ৩৬
চীনের দক্ষিণাঞ্চলে সড়ক ধসে নিহত ৩৬
লাউ খেলে মিলবে এই ৮ উপকারিতা
লাউ খেলে মিলবে এই ৮ উপকারিতা
রাশিয়ার বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনের অভিযোগ যুক্তরাষ্ট্রের
রাশিয়ার বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনের অভিযোগ যুক্তরাষ্ট্রের
কেনিয়ায় বন্যায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১৮১
কেনিয়ায় বন্যায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১৮১
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ