X
শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪
২০ বৈশাখ ১৪৩১

যৌন নিপীড়ন সেল গঠন নিয়ে অস্বস্তি কেন?

জোবাইদা নাসরীন
২০ জুলাই ২০২৩, ১৭:০২আপডেট : ২০ জুলাই ২০২৩, ১৭:০২

১৯৯৮ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অনেক বিষয় আমাদের মনোযোগ তৈরি করেছিল, তার মধ্যে একটি ছিল যৌন নিপীড়নকে অপরাধ হিসেবে আমলে আনা এবং এর বিচার করা। সেই আন্দোলনের ১১ বছর পর ২০০৯ সালে বাংলাদেশ হাইকোর্ট যৌন হয়রানিকে অপরাধ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে এই বিষয়ে বিচার প্রক্রিয়া এবং অভিযোগ দায়ের করার জন্য প্রত্যেক কর্মক্ষেত্র এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যৌন নিপীড়ন তদন্ত সেল গঠনের জন্য নির্দেশনা প্রদান করেন।

অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই যৌন নিপীড়নের অভিযোগ ওঠে এবং বিচারের দাবিতে আন্দোলন হয়। তারপর থেকে মূলত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কখনও শিক্ষকের বিরুদ্ধে, কখনও সহপাঠী, কখনও ক্ষমতাসীন সংগঠনের নেতার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছে। যৌন হয়রানির বিচার চেয়ে আন্দোলনের কারণে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় উত্তপ্ত হয়েছিল। পরবর্তীতে অনেক পাবলিক এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও যৌন নিপীড়ন তদন্ত সেল গঠন করা হয়। তবে এটিও এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, সব কমিটিই যে হাইকোর্টের নির্দেশ মেনে হয়েছে এমন নয়। এমনও দেখা গেছে–  বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হাই্কোর্টের নির্দেশনা তোয়াক্কা না করেই তাদের মতো করে কমিটি করেছে।

আপাতভাবে মনে হতে পারে যে বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অন্য কোথাও যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটে না। কারণ, আমরা অন্যগুলোর খবর তেমন একটা পাই না। কিন্তু কিছু দিন আগে আরও একটি খবর নজর কাড়ে আর সেটি হলো– একজন সরকারি কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। তিনি ২১তম বিসিএসের কর্মকর্তা। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল গৃহকর্মী ধর্ষণের। অভিযোগটি ২০২০ সালে করা। তারপর তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের তদন্ত সাপেক্ষে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা-আপিল) বিধিমালা ২০১৮-এর বিধি ৩(খ)  অনুযায়ী তাকে চাকরিচ্যুত করার মতো ‘গুরুদণ্ড’ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। তবে চাকরিচ্যুত করার আগে তার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) পরামর্শও চেয়েছিল জনপ্রশাসন। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী তাকে এই শাস্তি দেওয়ার বিষয়ে রাষ্ট্রপতি ও পিএসসির অনুমোদন নেওয়া হয়েছিল।

বাংলাদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি বন্ধে ২০০৯ সালে হাইকোর্টের নির্দেশনা দেয়। সেই নির্দেশনা মেনে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যৌন নিপীড়ন অভিযোগ এবং তদন্ত কমিটি করে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যৌন নিপীড়নের ঘটনার খবর বিভিন্ন মিডিয়াতে আসার কারণে আমাদের মনে হয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেই সবচেয়ে বেশি যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটে। আমরা সেখানে বিচার নিয়ে আন্দোলন করি, কিন্তু যৌন নিপীড়নের ঘটনা সব জায়গাতেই ঘটে। কিন্তু সব জায়গায় যৌন নিপীড়ন নিয়ে কথা বলা যায় না? নাকি আমরা বেছে বেছে কয়েকটি ঘটনা হাজির করে অন্যগুলোকে খারিজ করতে সহায়তা করি?

সেগুলো নিয়ে আন্দোলনও হয় না। সেগুলো ‘সয়ে’ যেতে হয়। অনেক জায়গাতেই কমিটি আছে, কিন্তু নিজেদের মতো করে তৈরি করা কমিটি। এই কমিটির ক্ষেত্রে হাইকোর্টের নির্দিষ্ট কিছু নির্দেশনা রয়েছে অর্থাৎ কীভাবে এই কমিটি তৈরি করা হবে এবং এই কমিটি অবশ্যই নারী প্রধান হবে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো এটি যে সরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান এবং সচিবালয়ের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে এই ধরনের কোনও কমিটি করা হয়নি। কারণ, আমরা স্পষ্টই দেখতে পেয়েছি যে যার চাকরি গেছে সেটি কিন্তু শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে, যৌন সহিংসতার অভিযোগে নয়।

এখন বিষয় হলো যৌন হয়রানি প্রমাণিত হওয়ায়ও প্রচলিত ‘শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ তাকে শাস্তি দেওয়া হলো? কেন এখন পর্যন্ত মন্ত্রণালয়গুলো এবং সরকারের অন্যান্য অফিসে এখনও যৌন নিপীড়নরোধ সেল গঠিত হয়নি?  এটি নিয়ে কিন্তু কোথাও আলোচনা নেই। হাইকোর্টের নির্দেশনায় সব কর্মক্ষেত্রের কথা উল্লেখ করা রয়েছে। কিন্তু বেশিরভাগ কর্মস্থল এগুলোকে আমলে নেয়নি। বরং কোনও ধরনের ঘটনা ঘটলে সেগুলোকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে। কারণ ক্ষমতা সম্পর্ক। আমাদের বেশিরভাগ ক্ষমতা সম্পর্কগুলো এমন যে আমরা নিপীড়ন এবং নির্যাতনকে ধামাচাপা দিতে শেখাই আর এভাবেই আমরা কর্মক্ষেত্রে যৌন সহিংসতাকে আশকারা দিয়ে থাকি।

এরপর আসি রাজনৈতিক দলগুলোর কথা। হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী রাজনৈতিক দলগুলোতে যৌন নিপীড়ন তদন্ত সেল গঠনের বাধ্যবাধকতা নেই। এখন প্রশ্ন আসতে পারে আমরা কর্মক্ষেত্রের পরিসরকে কীভাবে পাঠ করবো? কর্মক্ষেত্র কী তবে শুধু কাঠামো? তারা তাদের নিজেদের মতো করেই এই ধরনের ঘটনার ফয়সালা করে। তবে মৌখিকভাবে ডান-বাম সবাই দাবি করেন যে যৌন হয়রানির বিষয়ে তাদের দলের অবস্থান জিরো টলারেন্স। কিন্তু কারও গঠনতন্ত্রেই এই বিষয়ে কোনও ধরনের সুনির্দিষ্ট সেল গঠন এবং বিচারিক প্রক্রিয়া নিয়ে কোনও আলাপ নেই।

বেশ কিছু দিন ধরে বাম ঘরানার একটি রাজনৈতিক দলে যৌন নিপীড়ন নিয়ে আলোচনায় হইচই শুরু হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে। এটি নিয়ে জাতীয় পত্র-পত্রিকাতেও পাল্টাপাল্টি যুক্তি উপস্থাপিত হয়েছে। যদিও বিভিন্ন সময়ে যৌন নিপীড়নবিরোধী আন্দোলনে বাম দলগুলোর রাজনৈতিক নেতাকর্মীরাই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু নিজেদের দলের অভ্যন্তরে অভিযোগগুলোকে তারা যেভাবে মোকাবিলা করছে সেটি নিয়ে তর্ক-বিতর্কও বহাল আছে। তারপরও সাধুবাদ যে দলের অভ্যন্তরে এসব বিষয় আলোচনায় এসেছে।

কিন্তু কেন বাম দলগুলো তাদের দলের অভ্যন্তরে এই ধরনের কমিটি গঠনে আগ্রহী নয় এই বিষয়ে স্পষ্ট কারণ জানা যায়নি। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোও এক একটি কর্মক্ষেত্র, যেখানে দলীয় নেতাকর্মীরা একসঙ্গে কাজ করে। বাইরে যদি আমরা সেটি নিয়ে আন্দোলন করতে পারি তাহলে নিজেদের দলে সেই কমিটি গঠন নিয়ে কেন করা যাবে না?

যৌন নিপীড়ন অভিযোগ সেল সচিবালয়সহ সব সরকারি অফিসে গঠন করা হয়েছে কিনা এই বিষয়ে আমাদের কাছে খুব বেশি তথ্য নেই। হাইকোর্টের নির্দেশ সবারই মানার কথা। আর নির্বাচনের আগে সব রাজনৈতিক দলে এই ধরনের সেল আছে কিনা সেটিও নির্বাচনি এজেন্ডায় থাকা প্রয়োজন।

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

ইমেইল: [email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
প্রতিদিন মা হারাচ্ছে ৩৭ ফিলিস্তিনি শিশু
প্রতিদিন মা হারাচ্ছে ৩৭ ফিলিস্তিনি শিশু
সেন্ট জোসেফ স্কুলে তিন দিনব্যাপী লিট ফেস্টিভ্যাল শুরু
সেন্ট জোসেফ স্কুলে তিন দিনব্যাপী লিট ফেস্টিভ্যাল শুরু
জাকিরের বিস্ফোরক ব্যাটিংয়ে প্রাইম ব্যাংকের বড় জয়
জাকিরের বিস্ফোরক ব্যাটিংয়ে প্রাইম ব্যাংকের বড় জয়
অবশেষে মোংলায় ঝরলো কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি
অবশেষে মোংলায় ঝরলো কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ