X
শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪
২০ বৈশাখ ১৪৩১

নারীর ‘পোশাক কেন্দ্রিক’ সহিংসতার কি শেষ নেই?

জোবাইদা নাসরীন
০৭ আগস্ট ২০২৩, ১৮:৫৩আপডেট : ০৭ আগস্ট ২০২৩, ১৮:৫৩

ফুটবলে বাংলাদেশের মুখটা  জ্বল জ্বল করে রেখেছিল আমাদের সোনার মেয়েরা। বিশেষ করে পুরুষদের ফুটবলে নানা ঘটনা প্রবাহের পর একমাত্র নারী ফুটবলকে নিয়েই বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি স্বপ্ন দেখেছে এবং এখনও দেখে। এত অর্জনের পরও এই নারী ফুটবলারদের প্রতি নানাবিধ বৈষম্যের খবর আমরা গণমাধ্যম সূত্রে জানতে পারি। এই কয়েক মাস আগেই আমাদের অসম্ভব গর্বের দিন ছিল, যেদিন ফুটবলে নেপালকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পরেছিল এ দেশের মেয়েরা।

বিজয়ী সেই বীর মেয়েরা আমাদের মুখ উজ্জ্বল করেছে বলে আমরা কত কত আবেগঘন স্ট্যাটাস দিয়েছি। শুধু তাই নয়, এবার দেশের মাটিতে সাফ অনূর্ধ্ব-২০ নারী চ্যাম্পিয়নশিপেও বাংলার বাঘিনীদের ছিল জয়ের উৎসব।

এত এত আনন্দ, গর্ব আর বিজয়ের মুখেও সেই নারী ফুটবলারদের হামলার শিকার হতে হয়, অসম্মানিত হতে হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং গণমাধ্যম থেকে আমরা জেনেছি, গত ২৯ জুলাই খুলনা জেলার  বটিয়াঘাটার তেঁতুলতলা গ্রামে সেই মেয়েদের কয়েকজন আক্রমণের শিকার হয়েছেন। তাদের অপরাধ, তারা হাফপ্যান্ট পরে ফুটবল খেলেন। এই অপরাধে অনূর্ধ্ব-১৭ দলের সাদিয়া নাসরিনসহ চার জনের ওপর আক্রমণ চালায় স্থানীয় নুর আলম এবং তার পরিবারের তিন সদস্য। সহিংসতা সেখানেই শেষ হয়নি। আক্রমণের শিকার হওয়া খেলোয়াড়দের পরিবার মামলা করলে সেই মামলা তুলে না নিলে নারী ফুটবলারদের অ্যাসিডে মুখ ঝলসে দেওয়ার হুমকিও দিয়েছে আক্রমণকারীরা।

কেন এই আক্রমণ? আক্রমণকারীরা দাবি করছে, ফুটবল খেলায় অংশ নেওয়া মেয়েদের পোশাক তাদের চোখে ‘শালীন’ নয়। তবে এখানে বলে রাখা প্রয়োজন যে বাংলাদেশে এর আগে নারীদের ফুটবল খেলা বাধার মুখে পড়েছিল। সেটি হয়েছিল ২০১৮ সালে। সেই প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধ এসেছিল একটি ইসলামি দল থেকে। ইসলামি আন্দোলনের বিরোধিতার মুখে সেবার বন্ধ হয়েছিল নারীদের একটি টুর্নামেন্ট। তবে আমরা ভুলে যাইনি কয়েক বছর আগে হাফপ্যান্ট পরে ফুটবল খেলার কারণে জাতীয় দলের এক নারী ফুটবলারকে বাসে হেনস্তা হতে হয়েছিল। শুধু ফুটবলারই নন,  একজন নারী ফুটবলারের বাবাকে নিজের এলাকায় মারধর করা হয়েছিল। অপরাধ ছিল তার মেয়ে হাফপ্যান্ট পরে মাঠে ফুটবল খেলে। কোনও ঘটনারই কোনও বিচার হয়েছে বলে জানা যায়নি।

বাংলাদেশে নারী ফুটবলের ইতিহাসের দিকে যদি আমরা ফিরে তাকাই তাহলে দেখবো এর শুরুটা মূলত ২০০৮ সাল থেকে। কিন্তু তখন থেকেই নারী ফুটবলাররা আলোচনায় আসে এবং এই আলোচনা তাদের এগিয়ে যাওয়ার পথকে অনেকটাই সহজ করেছিল, যে কারণে ২০১১-২০১২ থেকেই বাংলাদেশের নারী ফুটবল অনেকটাই পরিণতি লাভ করে। স্বপ্নের শুরুটা করেছিল ২০১৭ সালেই। কিন্তু সেবার ভারতে অনুষ্ঠিত সাফ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে স্বাগতিকদের কাছে হেরে যায় বাংলাদেশ। হাতছাড়া হয়ে যায় শিরোপা। তারপর সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ চ্যাম্পিয়নশিপেও ভারতকে হারিয়ে শিরোপা নিজেদের হাতে এনেছিল সেই সোনার মেয়েরা।

এই সাফল্য অব্যাহত থাকে ২০১৮ সালেও। সেবারই নেপালে সাফ ফুটবলে মেয়েরা অনূর্ধ্ব-১৮ টুর্নামেন্টে শিরোপা জিতে এবং নারী ফুটবলের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রথম স্বপ্ন দেখা শুরু করে বাংলাদেশ। তারপর থেকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা আমাদের দিয়েছে জয়ের খবরই।

যে মেয়েরা আমাদের গর্ব, সেই মেয়েদের কয়েকজন আহত, অসম্মানিত হয়েছেন। মেয়েদের এত সাফল্যও নারীর প্রতি পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের তীব্রতা কমাতে পারেনি। এই খেলোয়াড়দের একমাত্র অপরাধ তারা হাফপ্যান্ট পরে খেলে। যদি প্রথম থেকেই এই বিষয়ে সরকার কঠোর অবস্থান নিতেন তাহলে এই বিষয়টিই এ পর্যন্ত আসতো না। যখন ইসলামি আন্দোলন মেয়েদের খেলার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল, সেবার তাদের ভয়ে কেন টুর্নামেন্ট বন্ধ করতে হলো? যে মেয়েরা আমাদের দেশের মুখ উজ্জ্বল করছে তাদের খেলতে না দিয়ে ইসলামি আন্দোলনকে কেন খুশি করতে হলো? এর আগে যখন খেলোয়াড়কে বাসে হেনস্তা করা হলো এবং একজন খেলোয়াড়ের বাবাকে মারধর করা হলো, তখন এর প্রতিবাদে কী করেছি আমরা? আমরা এগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখে পাশ কাটাতে চাই। যদি এগুলোকে আমরা সঠিকভাবে আমলে নিতাম তাহলে আর এ ধরনের ঘটনা ঘটতো না।

বিষয়টি একটু গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে কী ধরনের চিত্র পাই। বর্তমানে যে ঘটনা ঘটেছে, সেখানে আমরা দেখেছি যে শুধু আক্রমণ করেই হামলাকারীরা শান্ত হননি, বরং মামলা তুলে নেওয়ার জন্য হুমকি দিচ্ছেন এবং মামলা না তুলে নিলে অ্যাসিড ছুড়ে মুখ পুড়ে দেবে বলে হুমকি দিচ্ছে। এবং সবই হচ্ছে প্রশাসনের সামনেই। এই শক্তির উৎস আসলে কোথায়?

এই শক্তির উৎস অনেক। প্রথমত পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার কারণে অনেকেই মনে করেন মেয়েরা হাফপ্যান্ট পরে খেলবে কেন? যে কারণ মেয়েদের বিরুদ্ধে অবস্থান না নিলেও এই ঘটনাকে সমর্থন দিচ্ছেন। দ্বিতীয়ত, আমরা মনে করছি এটি স্থানীয় একটি ঘটনা, এ জন্য রাজধানীতে এই বিষয়ে তেমন কোনও প্রতিবাদ হাজির হয়নি। তৃতীয়ত, এই ঘটনাকে দুটো পরিবারের ঘটনা হিসেবেও উপস্থাপন করছে কোনও কোনও গণমাধ্যম। কিন্তু খুব কম জায়গাতেই এটি লিঙ্গীয় সহিংসতা হিসেবে পাঠ করা হচ্ছে।

নারীর পোশাক নিয়ে বিতর্ক এ দেশে অনেক পুরাতন। এবং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ইস্যুতে এই বিষয় আলোচনা হয়ে আসছে, কিন্তু এই বিষয়ে তেমন কোনও পরিবর্তন হয়নি। যার কারণে এটি নারীর প্রতি সহিংসতার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠছে। এই বিষয়ে অনেক বেশি মনোযোগ না দিলে শুধু বিতর্কই নয়, বারবার আক্রান্ত হবে নারীরা। পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার অন্যতম কুতর্কের জায়গা নারীর পোশাক। এই বিষয়ে কঠোর অবস্থান নিয়ে করণীয়গুলো অচিরেই নির্ধারিত হওয়া প্রয়োজন।

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

ইমেইল: [email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জাতিসংঘে বাংলাদেশের ‘শান্তির সংস্কৃতি’ রেজুলেশন গৃহীত
জাতিসংঘে বাংলাদেশের ‘শান্তির সংস্কৃতি’ রেজুলেশন গৃহীত
‘তীব্র গরমে’ মারা যাচ্ছে মুরগি, অর্ধেকে নেমেছে ডিম উৎপাদন
‘তীব্র গরমে’ মারা যাচ্ছে মুরগি, অর্ধেকে নেমেছে ডিম উৎপাদন
ইসরায়েলের সঙ্গে সব ধরনের বাণিজ্য বন্ধ করলো তুরস্ক
ইসরায়েলের সঙ্গে সব ধরনের বাণিজ্য বন্ধ করলো তুরস্ক
রোমাকে হারিয়ে ফাইনালে এক পা লেভারকুসেনের
ইউরোপা লিগরোমাকে হারিয়ে ফাইনালে এক পা লেভারকুসেনের
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ