X
রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১

বৃষ্টি, জলাবদ্ধতা আর ‘নয় ছয়’ আনন্দ

রেজানুর রহমান
০৯ আগস্ট ২০২৩, ১৭:১৫আপডেট : ০৯ আগস্ট ২০২৩, ১৭:১৫

চট্টগ্রাম ডুবে আছে পানিতে। কয়েক দিনের বৃষ্টিতেই প্রায় গোটা চট্টগ্রাম শহর ডুবে গেছে। কোনও কোনও এলাকায় বসতবাড়ির নিচতলা চলে গেছে পানির দখলে। চট্টগ্রামের মেয়রের বাড়িতেও বৃষ্টির পানি ঢুকে পড়েছে। মেয়র বলে কথা। বৃষ্টির পানির কী সাহস, মেয়রের বাড়িতে পর্যন্ত ঢুকে যায়? সে জন্য প্রচারমাধ্যমে মেয়রের বাড়ির ছবি ছাপা হয়েছে। মেয়র মানে নগরপিতা। তার বাড়িতে যখন বৃষ্টির পানি ঢুকে যায় তখন ভাবতে হবে ‘ডাল মে কুছ কালা হ্যায়’। কোথাও একটা ঝামেলা আছে। মারাত্মক ঝামেলা।

এবার ৭ মাসে ১০ বার ডুবলো চট্টগ্রাম। নগরের প্রায় ১৫ লাখ পানিবন্দি মানুষ অসহায় জীবনযাপন করছেন। ক্ষতির মুখে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। বৃষ্টির পানিতে এবার ডুবেছে চট্টগ্রাম শহরের ৪০ শতাংশ এলাকা। দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ শহরের অর্ধেকই বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে ডুবে যাওয়ায় নানান অনিয়মের অভিযোগ ভেসে বেড়াচ্ছে। চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে ৪টি প্রকল্প চলমান। মোট বাজেট ১১ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকা। ৬ বছরে জলাবদ্ধতা নিরসনে ব্যয় হয়েছে ৫ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা। তবু জলাবদ্ধতা কমেনি। যেই লাউ সেই কদু অবস্থা।

সেই কবিতার মতো– ‘আসমানিরে দেখতে যদি তোমরা সবে চাও/ রহিমুদ্দির ছোট বাড়ি বসুলপুরে যাও/ বাড়ি তো নয় পাখির বাসা ভেন্না পাতার ছানি/ একটু খানি বৃষ্টি হলেই গড়িয়ে পড়ে পানি।’

আষাঢ়-শ্রাবণে বৃষ্টি হবে এটাই স্বাভাবিক। আর তাই বৃষ্টির জন্য আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করি। অথচ সামান্য বৃষ্টিতেই ডুবলো চট্টগ্রাম শহর। জলাবদ্ধতার কারণে একজন কলেজছাত্রীর করুণ মৃত্যু হয়েছে। চট্টগ্রামের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বৃষ্টির দিনে বৃষ্টি তো হবেই। সে জন্য আমাদের প্রস্তুতিও থাকতে হবে। তবে প্রস্তুতি যে নেই সেটা তো বলা যাবে না।

ভারী বর্ষণ ও জোয়ারের পানিতে চট্টগ্রাম শহরে যাতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি না হয় সেজন্য সিটি করপোরেশনের ১টি, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের দুটি ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের ১টি-সহ মোট ৪টি প্রকল্পের আওতায় ১১ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ চলমান। ইতোমধ্যে ব্যয় হয়ে গেছে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা। তবু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। সামান্য বৃষ্টিতেই ডুবছে চট্টগ্রাম শহর। তাহলে এত টাকা খরচ হলো কোথায়? বৃষ্টির দিনে বৃষ্টি হবে। জোয়ারের পানি শহরে ঢুকবে এটা সবারই জানা। কিন্তু বৃষ্টি ও জোয়ারের পানি যাতে শহরের মানুষের জন্য দুর্ভোগের কারণ না হয় তা নিশ্চিত করার জন্যই তো একাধিক প্রকল্প চলমান। তবু ৭ মাসে ১০ বার ডুবলো চট্টগ্রাম। এ ব্যাপারে চলমান প্রকল্পের যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তারা কি বলেন? তারা মূলত দায় এড়ানোর চেষ্টা করছেন। এক পক্ষ অন্য পক্ষের বিরুদ্ধে কথা বলছেন। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগের তীর ছুড়েছেন চট্টগ্রামের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। তিনি বলেছেন, সিডিএ তাদের প্রকল্পের আওতাধীন খালগুলো থেকে যে পরিমাণ মাটি উত্তোলনের কথা, তার চার ভাগের একভাগও তোলেনি। রাস্তা বানানোর জন্য খালের প্রশস্ততা কমিয়েছে। যেখানে খালের মাটি তুলে গভীর করার কথা সেখানে পর্যাপ্ত মাটি না তুলে রাস্তা প্রশস্ত করা হয়েছে। এতে খালের প্রশস্ততা কমে গেছে। ফলে আগের চেয়ে বেশি জলাবদ্ধতা হচ্ছে।

এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলী। তিনি বরং অভিযোগের পাল্টা তীর ছুড়েছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বিরুদ্ধে। তিনি বলেছেন, সিডিএ’র খালগুলো যথাযথ প্রক্রিয়ায় রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে। তবে সিটি করপোরেশন তাদের আওতাভুক্ত নালাগুলো নিয়মিত পরিষ্কার করে না। সে কারণে নালার পানিই মূলত জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে। দুই কর্মকর্তার বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে একটি ছোট গল্পের কথা মনে পড়ে গেলো। গল্পের নাম ‘চাপা পড়া মানুষ’। প্রচণ্ড ঝড়ে একটি ভাঙা গাছের ডালে চাপা পড়ে একজন মানুষ। মানুষটি বাঁচার জন্য চিৎকার করছে। ডালটি সরাতে পারলেই হতভাগ্য মানুষটি বেঁচে যাবে। কিন্তু গাছের ডাল সরানো নিয়ে বাধে বিপত্তি। ডালটি যে জায়গায় ভেঙে পড়েছে সেই জায়গাটা আসলে কার? কোন কর্তৃপক্ষের? তা নিশ্চিত করার জন্য চিঠি চালাচালি শুরু হয়। কোনও পক্ষই গাছের মালিক হতে চায় না। কারণ, মালিক হলেই চাপা পড়া মানুষটির দায় নিতে হবে। কাজেই মানুষটিকে বাঁচানোর বদলে দায় এড়ানোর কূটকৌশলে লিপ্ত হয় উভয় পক্ষ। ততক্ষণে যা ঘটার ছিল তা-ই ঘটে। অসহায় মানুষটির অকাল মৃত্যু ঘটে।

চট্টগ্রামের ঘটনাও অনেকটা এই গল্পের মতো। সামান্য বৃষ্টি হলেই পানি সরে না। নড়ে না মোটেও। এর কারণ জলাবদ্ধতা। এ জন্য নিশ্চয়ই কেউ না কেউ দায়ী? কিন্তু দায় তো কেউ নিতে চায় না। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মানুষ। হায়রে মানুষ।

এমনিতেই এবার বৃষ্টির পরিমাণ কম। তাতেই যদি জনজীবনের এত করুণ পরিণতি হয় তাহলে অতীতের মতো একনাগাড়ে ৫ দিন ৭ দিন বৃষ্টি হলে দেশের পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? চট্টগ্রাম শহরের অবস্থা তো দেখতেই পাচ্ছি। ঢাকা শহরের অবস্থা কেমন হবে? ঢাকা শহরের ড্রেনেজ ব্যবস্থা এতটাই নাজুক যে সামান্য বৃষ্টিতেই সড়ক ডুবে যায়। বাড়ির ভিতর পানি ঢুকে যায়। এর একটাই কারণ, জলাবদ্ধতা। ঢাকা শহরে একসময় ৫৪টি খাল ছিল। বৃষ্টির পানি খালে গিয়ে জমা হতো। এখন খালগুলো নেই। খাল ভরাট করে অবৈধভাবে বসতবাড়ি, শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। বর্ষা-বাদলের দিনে মাঝে মাঝে অবৈধ দখলদারদের নিয়ে নানা পর্যায়ে কথাবার্তা, আলোচনা হয়। বর্ষা কমে গেলে আর কোনও আলোচনা হয় না। যেমন, চট্টগ্রাম এখন আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। জলাবদ্ধতার জন্য একে অপরকে দোষারোপ করছেন। বর্ষা কমে যাবে। পথঘাটের চৌচির অবস্থা দেখে নয়া বাজেটের দিকে ঝুঁকবেন সবাই। বাজেট তৈরি হবে। বাজেট পাসও হবে। তখন একদল লোকের জিভ লক লক করবে। কারণ, এই দেশে উন্নয়ন বাজেট মানেই অনেক ক্ষেত্রে ‘নয় ছয়’ করার সুবর্ণ সুযোগ। নয় ছয় মানেই অবৈধ আয়। দুর্নীতির ব্যাপক সুযোগ। বন্যায় ভেসে যাক মানুষ। ডুবে যাক সংসার। তাতে কার কী আসে যায়। এসো সবাই ‘নয় ছয়’ আনন্দে মেতে উঠি...।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক- আনন্দ আলো।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পঞ্চম বারের মতো কমলো সোনার দাম
পঞ্চম বারের মতো কমলো সোনার দাম
নেত্রীর জন্য জান দেবেন আর সিদ্ধান্ত মানবেন না, সেটা উচিত না: দীপু মনি
নেত্রীর জন্য জান দেবেন আর সিদ্ধান্ত মানবেন না, সেটা উচিত না: দীপু মনি
গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রই বন্ধ করতে পারে: আব্বাস
গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রই বন্ধ করতে পারে: আব্বাস
টেন মিনিট স্কুলে বিকাশ পেমেন্টে ক্যাশব্যাক
টেন মিনিট স্কুলে বিকাশ পেমেন্টে ক্যাশব্যাক
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ