X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা ঢলের ছয় বছর!

ড. রাহমান নাসির উদ্দিন
২৫ আগস্ট ২০২৩, ১২:৫৭আপডেট : ২৫ আগস্ট ২০২৩, ১৭:১৬

আজ রোহিঙ্গা ঢলের ছয় বছর পূর্তি। আমি প্রতি বছর আগস্টের ২৫ তারিখ বাংলা ট্রিবিউনের জন্য রোহিঙ্গা ঢলের বছরপূর্তি উপলক্ষে একটি কলাম লিখি এবং এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। রোহিঙ্গা ঢলের পাঁচ বছর বর্ষপূর্তি থেকে ছয় বছর পূর্তি পর্যন্ত সংঘটিত উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলোর একটি বিশ্লেষণ দাঁড় করাই। পাশাপাশি কোন কোন বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেওয়া জরুরি বলে আমি মনে করি, সেগুলো সম্পর্কে সম্যক ধারণা দিয়ে থাকি। সঙ্গে এ কথাটাও সাফ করে দিই যে আমরা যেন মনে না করি বাংলাদেশে রোহিঙ্গারা মাত্র ছয় বছর আগে এসেছে এবং এর আগে কোনও রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ছিল না।

শরণার্থী হিসাবে বাংলাদেশে প্রথম রোহিঙ্গারা প্রবেশ করে ১৯৭৮ সালে। দ্বিতীয় দফা রোহিঙ্গারা আসে ১৯৯১-৯২ সালে। তৃতীয় দফা প্রবেশ করে ২০১৬ সালে। সর্বশেষ মোটাদাগে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করে ২০১৭ সালের আগস্টের ২৫ তারিখ থেকে। এবং সে সময় প্রায় দুই মাসে সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। আগের রোহিঙ্গা এবং নতুন করে আসা রোহিঙ্গা মিলে বাংলাদেশে রোহিঙ্গার সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ১১ লক্ষাধিক। বিগত ছয় বছরে নতুন করে জন্ম নিয়েছে প্রায় দেড় থেকে দুই লাখ রোহিঙ্গা শিশু। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে বর্তমানে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা প্রায় ১৩ লক্ষাধিক, যার অর্ধেকের বেশি এসেছে ২০১৭ সালে।

ফলে, আজকে রোহিঙ্গা ঢলের ছয় বছর পূর্তি। আজকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে সারা বছর কি কি ঘটনা ঘটলো তার ধারাবর্ণনা দেওয়ার চেয়ে চারটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করবো।

প্রথম হচ্ছে  প্রত্যাবাসন। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া চালু করতে চেষ্টার কোনও ত্রুটি নেই। কিন্তু মিয়ানমার যদি সত্যিকার অর্থে আন্তরিক না-হয়, বাস্তবতা হচ্ছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কখনোই সম্ভব হবে না। এবং এ জন্য আমি দায়ী করি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে। কেননা, বাংলাদেশ যতবারই প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নিয়েছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কখনোই আন্তরিকভাবে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে জোরালো সমর্থন দেয়নি। বরং ইনিয়ে-বিনিয়ে বারবার বলার চেষ্টা করে, জোর করে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো ঠিক হবে না। বাংলাদেশ তো জোর করে ফেরত পাঠাতে চাচ্ছে না। স্বেচ্ছায় ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করছে। জোর করে ফেরত পাঠাতে চাইলে বাংলাদেশ অনেক আগেই এর উদ্যোগ নিতে পারতো। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে সমর্থন তো করছেই না, উল্টো বাগড়া দিচ্ছে। কিন্তু মিয়ানমারকে চাপ প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে এই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তখন নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থ ও ভূ-রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ করে। তাই, আমার মনে হয়ে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে একটা জায়গায় আনতে হবে। সেজন্য প্রয়োজনে একটা ‘স্পেশাল ডিপ্লোমেটিক টাস্কফোর্স’ গঠন করা যেতে পারে। অন্যথায় প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করা আদৌ সম্ভব হবে কিনা আমি সন্দিহান।

দ্বিতীয়ত হচ্ছে চীনের মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা। বাংলাদেশের অনেকে বিশ্বাস করেন, মিয়ানমার চীনের কথা শোনে। চীন যদি মধ্যস্থতা করে তাহলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার অন্তত একটা পাইলট প্রক্রিয়া শুরু করা যেতে পারে। কিন্তু অনেকে হয়তো জানেন না, মিয়ানমারের মিলিটারির সঙ্গে চীনের সম্পর্ক অম্লমধুর। কেননা, মিয়ানমারের বিভিন্ন সীমান্তবর্তী এলাকায় যেসব সশস্ত্র গ্রুপ মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে নিত্য যুদ্ধে লিপ্ত তাদের অস্ত্র সাপ্লাই করে চীন। এবং এ খবর মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর কাছে আছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে চীন যেহেতু মিয়ানমারের নিঃশর্ত বন্ধুর ভূমিকা নেয় সেহেতু চীনের সঙ্গে একটা সম্পর্ক বজায় রাখা মিয়ারমারের সেনাবাহিনীর জন্য জরুরি। তাছাড়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপসহ পাশ্চাত্য দেশগুলোর নানান ধরনের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা এবং ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক চাপ মোকাবিলায় চীনের সমর্থন মিয়ানমারের প্রয়োজন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, চীন মিয়ানমারের ‘প্রয়োজন’, কোনোভাবেই ‘প্রিয়জন’ নয়। এরকম একটি অবস্থায় চীনের মধ্যস্থতায় মিয়ানমার ১৩ লাখ রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেবে, এটা অতি আশাবাদীদের পক্ষেও বিশ্বাস করা কষ্টকর। তাই, চীনের ওপর অতি নির্ভরতা আখেরে কোনও ফল দেবে বলে আমার মনে হয় না। মনে রাখতে হবে, চীনের আশ্বাসও শেষ বিচারে ‘মেইড-ইন-চায়না’।

আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রতিষ্ঠান ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত ইস্ট-ওয়েস্ট সেন্টারে ২০২২ সালে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান নিয়ে উচ্চতর গবেষণার কাজ করেছি। আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৬টি সিনেট অফিসের সঙ্গে কাজ করেছি। ডিসিভিত্তিক উইলসন সেন্টার ও রিফিউজি ইন্টারন্যাশনালসহ বিভিন্ন টপ-র‌্যাংকিং থিংকট্যাংকের সঙ্গে কাজ করেছি। আমার গবেষণায় আমি পরামর্শ দিয়েছিলাম বাংলাদেশ নতুন করে ‘থার্ড কান্ট্রি রিসেটেলম্যান্ট’-এর উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। আমি অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতেও এ বিষয় গবেষণার কাজ করেছি। সেখানেও অস্ট্রেলিয়া সরকারের ঘোষিত নীতির ভেতর কীভাবে রোহিঙ্গাদের পাঠানো যায়, তার পরামর্শ দিয়েছি। ইতোমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০ হাজার থেকে ১ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য একটা প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এছাড়াও যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, নেদারল্যান্ড, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, নরওয়ে, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, তুরস্ক প্রভৃতি দেশের রিফিউজি পলিসির কাঠামোতেই বাংলাদেশ থেকে তৃতীয় কোন দেশে রোহিঙ্গাদের পাঠানোর জন্য একটা জোর কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করা যেতে পারে।

তৃতীয় কোনও দেশে পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া একবার ২০০৬ সালে শুরু হয়েছিল কিন্তু ২০১০ সালে সেটা বন্ধ হয়ে যায়। রোহিঙ্গা সমস্যার একটি সবচেয়ে কার্যকর উদ্যোগ হতে পারে ‘থার্ড কান্ট্রি রিসেটেলম্যান্ট’ প্রোগ্রাম নতুন করে শুরু করার উদ্যোগ গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে।  

চতুর্থত পয়েন্টে এসে আমার পর্যবেক্ষণ হিসাবে আমি বলতে চাই, বাংলাদেশে ধীরে ধীরে রোহিঙ্গাবিরোধী একটা শক্ত মনোভাব গড়ে উঠেছে এবং সেটা রোহিঙ্গাদের জন্য কোনোভাবেই সুখকর নয়। এটা অনস্বীকার্য যে প্রায় ১৩ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার উপস্থিতির কারণে বাংলাদেশকে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। উখিয়া এবং টেকনাফসহ কক্সবাজারের জনগণকে অনেক ধরনের সমস্যা পোহাতে হচ্ছে। এত বড় একটা জনগোষ্ঠীর উপস্থিতির কারণে নানান প্রতিবেশগত, সামাজিক ও অবকাঠামোগত ক্ষতি হচ্ছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, রোহিঙ্গারা শখ করে বাংলাদেশে বেড়াতে আসেনি। একটা মৃত্যু-ভয়ংকর জেনোসাইড থেকে বাঁচার জন্য ‘জান’ নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছে। আমরাও রোহিঙ্গাদের একটি মানবিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করার জন্য আশ্রয় দিয়েছি। তাই, তারা চলে যাচ্ছে না বলে, তাদের প্রতি কোনোভাবেই অমানবিক হওয়া যাবে না। রোহিঙ্গাদের মানবিক বিবেচনায় আশ্রয় দেওয়ার জন্য বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের মানুষের মানবিকতা ভূয়সী প্রশংসা কুড়িয়েছে। কিন্তু এখন অস্থির হয়ে অমানবিক হয়ে আমরা যেন নতুন করে নিন্দা না-কুড়াই। অবশ্যই রাষ্ট্রের স্বার্থ আগে কিন্তু পৃথিবীতে মানুষ এসেছে আগে, রাষ্ট্র এসেছে অনেক পরে।  

পরিশেষে বলবো, বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে কী ভুল করেছে? এ প্রশ্ন আমাদের করতে হবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে। ছয় বছর হয়ে গেলো কারও কোনও সাড়াশব্দ নাই। রোহিঙ্গাদের ভরণ-পোষণের জন্য আন্তর্জাতিক সাহায্য সহযোগিতার পরিমাণও ক্রম হ্রাসমান। এভাবে তো চলতে পারে না। সবকিছুর একটা শেষ আছে। আমরাও রোহিঙ্গা সমস্যার একটা শেষ দেখতে চাই। একটা সম্মানজনক এবং মর্যাদাপূর্ণ সমাধান চাই। এবং এজন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেই এগিয়ে আসতে হবে। অন্য কোনও উপায়ে দ্রুত এর সমাধান হবে বলে আমার মনে হয় না।

লেখক: নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মাটি কাটার সময় 'গরমে অসুস্থ হয়ে' নারী শ্রমিকের মৃত্যু
মাটি কাটার সময় 'গরমে অসুস্থ হয়ে' নারী শ্রমিকের মৃত্যু
সাকিবের সঙ্গে উপজেলা নির্বাচনের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সাক্ষাৎ
সাকিবের সঙ্গে উপজেলা নির্বাচনের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সাক্ষাৎ
স্বর্ণপামে ৯ বিচারক: সর্বকনিষ্ঠ আদিবাসী লিলি, আছেন বন্ডকন্যাও
কান উৎসব ২০২৪স্বর্ণপামে ৯ বিচারক: সর্বকনিষ্ঠ আদিবাসী লিলি, আছেন বন্ডকন্যাও
‘“সুলতান পদক” পেয়ে আমি গর্বিত ও ধন্য’
‘“সুলতান পদক” পেয়ে আমি গর্বিত ও ধন্য’
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ