X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

গায়েবের গুরু পরকীয়ার শুরু

আহসান কবির
১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৫:৫৮আপডেট : ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৫:৫৮

আফ্রিকার কোনও এক দেশে একবার সরকারি এলান হলো এমন– যার তিনটি বাচ্চা হবে সরকার তাকে বিশ হাজার টাকা দেবে। জেরাল্ড সদ্য যমজ দুই সন্তানের বাবা হয়েছে। সে তার স্ত্রীকে বললো– আমার আগের বউয়ের কাছে আরেক বাচ্চা আছে। নিয়ে আসি? বউয়ের পারমিশন নিয়ে জেরাল্ড গিয়ে তার আগের বাচ্চাকে নিয়ে এলো। বাসায় ফিরে দেখলো তার দুই বাচ্চা গায়েব! বউয়ের কাছে জেরাল্ড জানতে চাইলো বাচ্চারা কোথায়? জেরাল্ডের বউ জানালো, যার বাচ্চা সে নিয়ে গেছে।

ছোটকালে দেখা এমন আরেকটা আলোড়িত ঘটনা দিয়ে ‘গায়েবি’ লেখাটার বীজ বপন করা যায়। ১৭ বছরের এক মেয়ে গর্ভবতী হয়ে পড়েছে। সবাই এটা জানতে উদগ্রীব কে এই অনাগত সন্তানের পিতা? থানা পুলিশ করা হলেও মেয়েটা মুখ খুলছিল না। এমন সময়ে আচমকা এক খবর নিয়ে হাজির হলেন মেয়ের মা। তিনি জানালেন এক গায়েবি জিন আসতো মেয়েটার কাছে। সম্ভবত সে-ই এই ঘটনা ঘটিয়েছে।

জীবনে জিন-পরীদের নিয়ে অনেক কেচ্ছা কাহিনি শুনেছি। গায়েবি জিনের কথা সেবার প্রথম শুনেছিলাম। দ্বিতীয়বার ‘গায়েবি’ শব্দটা পেয়েছিলাম পত্রিকার পাতায়। অনেক ফর্মে পেয়েছি এটা। যেমন-

গত শুক্রবারের মিছিলের সময়ে পুলিশের গুলিতে দুজন নিহত হওয়ার ঘটনায় গতকাল মিছিল শেষে গায়েবি জানাজার আয়োজন করে প্রধান বিরোধী দল। নেতাকর্মীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই জানাজায় অংশগ্রহণ করে।

আসলে মরদেহ সামনে না রেখেও জানাজা পড়া যায়, যাকে গায়েবি জানাজা বলে। পত্রিকার পাতা থেকে পাওয়া এমন কিছু ‘গায়েবি’ জিনিসের বিবরণ, যা পত্রিকার ভাষাতেই তুলে ধরা হচ্ছে-

এক. পাঁচ মণ গাঁজা উদ্ধারের পর জমা দেওয়া হয়েছিল নিকটস্থ থানায়। মাদক দ্রব্য অধিদফতর থানা থেকে গাঁজা নিয়ে যাওয়ার সময় জানা যায় প্রাপ্ত গাঁজার পরিমাণ মাত্র দেড় মণ। এ ব্যাপারে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান, থানায় ইঁদুরের উপদ্রব দিনের পর দিন বাড়ছে। ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার ধারণা, সাড়ে তিন মণ গাঁজা গায়েব হবার পেছনে ইঁদুরের গায়েবি হাত আছে। তবে গাঁজা খাওয়ার পর ইঁদুরের দল নেশাসক্ত হয়ে পড়েছিল কিনা সেটা এই খবর পড়ে জানা যায়নি।

দুই. সন্ত্রাসীদের অস্ত্রসহ গ্রেফতার, বন্দুকযুদ্ধ এবং বিবিধ কারণে উদ্ধারকৃত অস্ত্রশস্ত্রের হিসাব সুচারুরূপে রাখা হয় না বিধায় যখনই অস্ত্র গায়েব হওয়ার ঘটনা ঘটে তখনই তোলপাড় শুরু হয়। কত শত অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে আর কত অস্ত্র গায়েব হয়েছে তার কোনও সঠিক পরিসংখ্যান নেই। সরকারি পরিসংখ্যান দেখে মনে হয় মিথ্যা তিন ধরনের। মিথ্যা, ডাহা মিথ্যা ও সরকারি পরিসংখ্যান।

তিন. সুন্দরবনের করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের কৃত্রিম পুকুর (প্যান) থেকে ১৪টি কুমির ছানার মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এর আগে ৪৩টি কুমির ছানা হত্যা ও গায়েব হয়। এক সপ্তাহের মধ্যে মোট ৬০টি কুমির ছানা হত্যা ও গায়েব হবার ঘটনা ঘটেছে!

চার. হযরত শাহজালাল এয়ারপোর্টের কাস্টম হাউজের ভল্ট থেকে ৫৫ কেজি সোনা গায়েব। এই ঘটনার পেছনে কাদের যোগসাজশ আছে সেটা বের করার জন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

পাঁচ. মরে গিয়েও রেহাই নেই। জাহাঙ্গীর আলম মারা গেছেন দেড় বছর আগে, এক বছর আগে মনসুর আলি এবং ছয় মাস আগে মারা গেছেন জিল্লুর রহমান। কিন্তু তারপরও তাদের বিরুদ্ধে যানবাহন ভাঙচুর ও রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রের মামলা দিয়েছে পুলিশ। খবরে আরও বলা হয়, দশ বছর আগে মারা গেছেন এমন একজন, হজে গেছেন কিংবা কারাগারে আছেন এমন কয়েকজনের নামেও গায়েবি মামলা দেওয়া হয়েছে।

ছয়. সাংবাদিক সাগর রুনি হত্যাকাণ্ডের মামলায় চার্জশিট দেওয়ার তারিখ ১০০ বার বদল করা হয়েছে। কেউ কেউ বলতে চাইছেন যে খুনিদের গায়েব করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে।

কী দাঁড়ালো তাহলে? গায়েবের হাত থেকে গাঁজা, অস্ত্র, কুমির, সোনা, মামলা, আসামি এমনকি মানুষও রেহাই পাচ্ছে না, তাই না? গায়েব নিয়ে বিশ্বখ্যাত গল্পও আছে। যেমন-

এক. ওয়াশিংটন আর্ভিংয়ের লেখা গল্প রিপ ভ্যান উইঙ্কেল। রিপ একজন আটপৌরে ভালো মানুষ। একদিন পাহাড়ের দিকে গিয়ে তিনি ঘুমিয়ে পড়েন। মানুষ বলতো রিপ গায়েব হয়ে গেছে। ফিরে আসেন বহু বছর পর। পুরনো শহর ও মানুষগুলো তখন তার কাছে নতুন হয়ে দাঁড়ায়।

দুই. ভাওয়ালের রাজকুমার রামেন্দ্রনারায়ণ রায় গায়েব হয়ে গিয়েছিলেন। মারা গেছেন ভেবে তার লাশ চিতায় তোলা হয়। এরপর ঝড় বৃষ্টি শুরু হলে তার জ্ঞান ফেরে এবং তিনি গায়েব হয়ে যান। ফিরে আসেন বহু বছর পর এবং সম্পত্তি ফিরে পেতে মামলা করেন এবং ফিরে পান সবকিছু।

এমন গায়েবি গল্পের সঙ্গে আছে সেই অমর মন্তব্য– ‘অতিকায় ডাইনোসর লোপ পাইয়াছে  কিন্তু ক্ষুদ্রকায় তেলাপোকা টিকিয়া আছে’। ডাইনোসরের মতো পৃথিবী থেকে গায়েব হয়ে গেছে প্লেগ কিংবা গুটি বসন্তের মতো রোগ, অনেক প্রজাতির বৃক্ষ, পশু, পাখি কিংবা মাছ। প্রযুক্তি নিজেই গায়েব করেছে টরেটক্কা মেশিন, টাইপ রাইটার, ফ্লপি ডিস্ক, সাদা কালো মনিটর বা টেলিভিশন, ফ্যাক্স অথবা টেলেক্স মেশিন। গায়েব হয়ে গেছে ভিসিআর কিংবা ভিসিপি, সিডি কিংবা লং প্লে। প্রযুক্তি কিংবা প্রকৃতি, কাকে যে কখন গায়েব করে দেয় তার কোনও ঠিক নেই। তবে সবচেয়ে বড় গায়েবি ঘটনার ভিন্ন নাম গুম। আপনার যাকে শত্রু মনে হয় ক্ষমতা ব্যবহার করে আপনি তাকে গায়েব করে ফেললেন। ১০০ জনের নিরানব্বই জনই ফিরলো না, কেউ হয়তো রিপ ভ্যান উইঙ্কেলের মতো ফিরলো। গায়েবি অবস্থা থেকে যারা ফিরে আসে বাংলাদেশটাকে তাদের কাছে কেমন মনে হয়? কেউ কেউ মরার পরও ফেরে। যেমন নারায়ণগঞ্জের সাত হতভাগা।

যারা তাদের পেট কেটে ইট বেঁধে নদীবক্ষে ডুবিয়ে দিতে চেয়েছিল তাদের কয়েকজন এখন ফাঁসির অপেক্ষায় আছে। তারপরও গায়েব, গুম বা বন্দুকযুদ্ধ নিয়ে তেমন কিছু না বলাই ভালো। সবসময়ের জন্য ভালো বিষয় হচ্ছে নির্ভেজাল কৌতুক। পরকীয়া বিষয়ক কৌতুক হলে আরও ভালো। কারণ, কেউ কেউ ঢাকা থেকে সরকারিভাবে গায়েব হয়ে রংপুরে যাচ্ছেন।

এক. বল্টু পরকীয়া করবে বলে একজন গুরুর শরণাপন্ন হয়েছে। গুরুর নাম কেল্টু। তিনি বল্টুকে কিছু টিপস দেওয়ার পর সাহস নিয়ে বল্টু রিং দিলো বীনুকে-

বল্টু– জান্টুস, আজ কখন দেখা হবে?

জান্টুস– সন্ধ্যার পর পর। আমার স্বামী আজ সন্ধ্যার ফ্লাইটে যশোর যাবে।

বল্টু– ঘুমানোর জন্য কী তোমাদের বাসায় সুন্দর ও আরামপ্রদ খাট আছে?

জান্টুস– থাকবে না কেন?

বল্টু– সেটা কী বক্স খাট না নরমাল খাট জান্টুস?

জান্টুস– (অবাক হয়ে) কী সব জিজ্ঞাস করছো! কী হয়েছে তোমার?

বল্টু– জান্টুস কিছু মনে করবা না। আমার পরকীয়ার গুরু কেল্টু দা বলেছেন, যে ঘরে নরমাল চার পায়াঅলা খাট নেই সেখানে পরকীয়া করা যাবে না। স্বামী চলে এলে নিজেকে গায়েব করার জন্য খাটের তলাই ইমার্জেন্সি সেইফ প্লেস।

দুই. আমরা কবিতায় পড়েছি– তোমারে বধিবে যে গোকূলে বাড়িছে সে!

মেরি শেলীর লেখা ফ্রাংকেনস্টাইনের গল্পও জানি আমরা। গল্পের মূল বক্তব্য এমন– পরের ক্ষতি করার জন্য যে দৈত্যকে (প্রশাসনে হোক আর পুলিশ বা র‌্যাবেই হোক)  সৃষ্টি করা হয়, সেই দৈত্য একদিন তার সৃষ্টিকারীকেই মেরে ফেলে। সুতরাং এ কালের ফ্রাংকেনস্টাইনের গল্প শুনে বিদায় নিই।

এক বিজ্ঞানী ইয়া বড় এক দৈত্য বানিয়েছেন। দশাশই তার ফিগার, কুচকুচে কালো গায়ের রঙ।আধুনিক সব অস্ত্র থাকে দৈত্যের পকেটের ভেতর। তবে দৈত্য নিজে কিছু করতে পারে না। রিমোট কন্ট্রোল টিপে দৈত্যকে নিয়ন্ত্রণ করেন সেই বিজ্ঞানী। তো বিজ্ঞানী তার প্রিয় বন্ধুকে নিয়ে আসলেন তার সৃষ্ট দৈত্যকে দেখাতে। বিজ্ঞানী তার বন্ধুকে নিয়ে বিজ্ঞানাগারে ঢোকা মাত্র হো হো করে হেসে উঠলো দৈত্য। বিজ্ঞানী খেয়াল করলেন দৈত্যটা রিমোট কন্ট্রোল হাতে নিয়ে হাসছে। বিজ্ঞানীর বন্ধু ভয়ার্ত কণ্ঠে জানতে চাইলেন– এখন আমরা কী করবো?

বিজ্ঞানী উত্তর দিলেন– এখন যা করার দৈত্যটাই করবে। যতটুকু সময় পাই আমরা শুধু হাত তুলে প্রার্থনা করতে পারবো।

প্রকৃতি নিজে কখনও গায়েব হয় না; বরং সে তার মতো টোল আদায় করে কাউকে না কাউকে গায়েব করে দিতে পারে। মনে রাখতে হবে সেই পুরোনো বাণী– ‘অতিকায় ডাইনোসর লোপ পাইয়াছে কিন্তু ক্ষুদ্রকায় তেলাপোকা টিকিয়া আছে’।

প্রার্থনা হোক সম্মানের সঙ্গে প্রয়োজনে ক্ষুদ্র হয়ে বাঁচার।

লেখক: রম্যলেখক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বরুণের স্পিনের পর সল্ট ঝড়ে দিল্লিকে হারালো কলকাতা
বরুণের স্পিনের পর সল্ট ঝড়ে দিল্লিকে হারালো কলকাতা
বেতন বৈষম্যে উচ্চশিক্ষার মান হারাচ্ছে বেসরকারি কলেজগুলো
বেতন বৈষম্যে উচ্চশিক্ষার মান হারাচ্ছে বেসরকারি কলেজগুলো
খিলগাঁও তালতলা মার্কেটে ক্যাশলেস লেনদেন চালু
খিলগাঁও তালতলা মার্কেটে ক্যাশলেস লেনদেন চালু
ছদ্মবেশে অভিযান চালিয়ে সাড়ে ১২ লাখ ইয়াবা উদ্ধার, নদীতে ঝাঁপিয়ে পালালো পাচারকারীরা
ছদ্মবেশে অভিযান চালিয়ে সাড়ে ১২ লাখ ইয়াবা উদ্ধার, নদীতে ঝাঁপিয়ে পালালো পাচারকারীরা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ