X
রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

উন্নয়ন বনাম রাজনৈতিক আন্দোলনের অক্টোবর মাস!

ড. প্রণব কুমার পান্ডে
১০ অক্টোবর ২০২৩, ১৯:১০আপডেট : ১০ অক্টোবর ২০২৩, ১৯:২৬

ক্যালেন্ডারে অক্টোবর মাস শুরু হতেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য শোনা যাচ্ছিল। রাজনৈতিক অঙ্গনের বিভিন্ন শক্তি এবং অনুঘটকরা অক্টোবরকে কেন্দ্র করে নিজেদের কৌশল নির্দিষ্ট করতে ব্যস্ত রয়েছে। সরকার ও বিরোধী দল– বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি (বিএনপি) উভয় পক্ষই বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করার মাধ্যমে একে-অপরের ওপর চাপ প্রয়োগ করার কৌশল নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে, যা দেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে অত্যন্ত তাৎপর্য বহন করে।

সরকার ভোটারদের আকৃষ্ট করার জন্য বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্প উদ্বোধনের দিকে মনোনিবেশ করলেও বিএনপি ক্ষমতাসীন দলকে ক্ষমতাচ্যুত করতে আল্টিমেটাম দিয়ে চলেছে এবং বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করছে। তবে বিরোধী দলের পক্ষ থেকে জনগণের সামনে যে ধরনের প্রতিশ্রুতি প্রদান করা হচ্ছে তা সত্যি বাস্তবায়িত হবে কিনা এই নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার সারা দেশে অবকাঠামোগত উন্নয়নের উচ্চাভিলাষী যাত্রা শুরু করেছিল ২০০৯ সালে। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনকে সামনে রেখে তারা নিরলসভাবে বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো তৈরির কাজের পরিসমাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য কাজ করে চলেছে। এগুলোর মধ্যে ব্রিজ ও বড় বড় সেতু থেকে শুরুর করে বিদ্যুৎকেন্দ্র পর্যন্ত রয়েছে। অনেক প্রকল্পের কাজ শেষ হয়ে যাওয়ায় নির্বাচনকে সামনে রেখে সেগুলোর উদ্বোধন করা হয়েছে এই মাসেই, যার সবগুলো বাংলাদেশের জনগণের জীবনকে উন্নত করবে।

এই কৌশলটি শুধু উন্নয়নের প্রতি তাদের প্রতিশ্রুতি প্রদর্শন করার জন্যই নেওয়া হয়নি, বরং ভোটারদের মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য পরিকল্পনা করা হয়েছে, যা রাজনৈতিক বাস্তবতায় খুবই স্বাভাবিক।

বাংলাদেশে সম্প্রতি উদ্বোধন করা অবকাঠামো প্রকল্পগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প দেশের অগ্রগতিকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করবে। এসব প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল এবং রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে রাজধানী শহরের যানজটের বহু বছরের সমস্যার সমাধান করবে, এক অংশের সাথে অন্য অংশের সংযোগ ত্বরান্বিত করবে এবং ভ্রমণের সময় কমাতে একটি ডেডিকেটেড এলিভেটেড রুট প্রদান করবে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সম্প্রসারণ দেশের বিমান ভ্রমণের অবকাঠামো উন্নত করার মাধ্যমে মানুষ ও পণ্যের নির্বিঘ্ন চলাচল সহজতর করবে। অন্যদিকে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থিতিশীল এবং পর্যাপ্ত বিদ্যুতের সরবরাহ নিশ্চিত করতে অবদান রাখবে, যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প হিসেবে বিবেচিত হবে।

এসব গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো প্রকল্পের উদ্বোধন নিঃসন্দেহে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে লাভবান করবে। উন্নত সংযোগ, নির্ভরযোগ্য বিদ্যুতের অ্যাক্সেস এবং অর্থনৈতিক সুযোগের প্রতিশ্রুতি দেওয়া এই প্রকল্পগুলো ভোটারদের কাছে ইতিবাচকভাবে অনুরণিত হতে পারে। ভোটাররা সেই সকল উন্নয়নের প্রশংসা করে, যা সরাসরি তাদের জীবনকে প্রভাবিত করে। একই সাথে এই উদ্যোগগুলো অগ্রগতি এবং উন্নয়নের জন্য সরকারের প্রতিশ্রুতি হিসেবে বিবেচিত হবে।

তবে, এই উদ্বোধনগুলো আওয়ামী লীগের জন্য নির্বাচনি সাফল্যে রূপান্তরিত হবে কিনা তা নির্ভর করবে জনগণের কাছে প্রকল্পগুলোর সুবিধার কার্যকর যোগাযোগ, সামগ্রিক রাজনৈতিক অবস্থা এবং ক্ষমতাসীন দল এবং বিরোধী উভয়ের দ্বারা নিযুক্ত কৌশলসহ বিভিন্ন কারণের ওপর।

রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের অন্যদিকে, বিএনপি প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধীদের একত্রিত করতে সক্রিয়ভাবে নিয়োজিত রয়েছে। তারা সরকারের পতন নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন ধরনের আল্টিমেটাম প্রদানের মাধ্যমে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করছে।

২০২৩ সালের অক্টোবর মাসকে বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে তুলে ধরে এই মাসেই সরকারের পতন হবে মর্মে প্রতিশ্রুতি দেওয়ার মাধ্যমে এই দলটি তাদের কর্মীদের উৎসাহিত করার চেষ্টা করছে এবং তাদের সমর্থনের ভিত্তিকে শক্তিশালী করার জন্য কাজ করেছে।

তবে আদৌ তারা এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে পারবে কিনা এ নিয়ে সকলের মধ্যে চরম দ্বিধা রয়েছে।

বিএনপি জনগণের অসন্তোষকে কাজে লাগাতে এবং তাদের উদ্দেশ্যকে গতিশীল করতে রাজনৈতিক কর্মসূচি ও বিক্ষোভের আয়োজন করেছে। এই প্রচেষ্টাগুলো কি একটি উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক পরিবর্তনে রূপান্তরিত হবে বা নিছক প্রতীকী কর্মসূচি হিসাবে রয়ে যাবে তা নির্ভর করবে বিস্তৃতভিত্তিক জোট গঠন, ভোটারদের উদ্বেগ মোকাবিলা এবং বাংলাদেশের রাজনীতির জটিল গতিশীলতা মোকাবিলা করার ক্ষমতাসহ বেশ কয়েকটি কারণের ওপর। বিএনপির কৌশল প্রত্যাশিত রাজনৈতিক পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যাবে নাকি ক্ষমতাসীন দলের স্থিতিস্থাপকতা ও উন্নয়ন এজেন্ডার সামনে চ্যালেঞ্জিং প্রয়াস হিসেবে প্রমাণিত হবে তা নির্ধারণে আগামী সপ্তাহগুলো গুরুত্বপূর্ণ হবে।

সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, বিএনপি তাদের দাবি আদায়ে এবং সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার ক্ষেত্রে সফল হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম, যেমনটি তারা গত ১৫ বছর ধরে ব্যর্থ হয়েছে। রাজনৈতিক প্রচার ও সমর্থন জোগাড় করার জন্য তাদের প্রচেষ্টার পরও প্রায়ই তাদের উদ্দেশ্যগুলোকে সুনির্দিষ্ট সাফল্যে রূপান্তর করতে পারছে না। 

কখনও কখনও বিরোধী দলের মধ্যে খণ্ডিত রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে বিএনপির প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তাছাড়া তাদের সমন্বিত কৌশলের অভাব রয়েছে। এই ঐক্যের অভাব তাদের ক্ষমতাসীন দলের কাছে টেকসই ও কার্যকর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে ব্যর্থ করেছে। বিএনপি নেতাদের বক্তৃতা তাদের সমর্থকদের মধ্যে উত্তেজনা এবং প্রত্যাশাকে আলোড়িত করলেও এটি প্রায়ই উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে, সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য তাদের প্রতিশ্রুতি অর্জিত হচ্ছে না।

যেহেতু ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে রাজনৈতিক আন্দোলন এবং উন্নয়নের জোয়ারের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে, সেহেতু এই দুইয়ের মধ্যে একটি সূক্ষ্ম ভারসাম্য বজায় রাখা সমস্ত স্টেকহোল্ডারদের জন্য প্রধান হয়ে উঠেছে। এটা খুবই স্বাভাবিক যে সরকার তার জনগণের কল্যাণকে অগ্রাধিকার দেবে। একই সাথে এটা নিশ্চিত করবে যে সকল  অবকাঠামোগত উদ্যোগগুলোর উদ্বোধন করা হয়েছে সেগুলোর মাধ্যমে প্রকৃত অর্থে দেশের জনগণ উপকৃত হবে।

ফলে, তারা প্রত্যাশা করতেই পারে যে জনগণ এই প্রকল্পগুলোর জন্য সামনের নির্বাচনে তাদের সমর্থন জানাবে। অন্যদিকে, বিরোধী দলের নেতাদের জ্বালাময়ী বক্তব্য ও আল্টিমেটামের রাজনীতি থেকে বের হয়ে এসে ভোটারদের সাথে অনুরণিত ব্যবহারিক কৌশল দ্বারা সমর্থিত ভবিষ্যতের জন্য একটি পরিষ্কার এবং কার্যকর দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করতে হবে।

অন্যদিকে সরকার এবং বিরোধী দলের ভূমিকা, উন্নয়ন প্রকল্প এবং বিভিন্ন ধরনের প্রতিশ্রুতি যাচাই-বাছাই করার ক্ষেত্রে ভোটারদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। কোন দলকে সমর্থন করলে দেশের উন্নয়ন হবে এবং জনগণের ভাগ্য পরিবর্তন হবে সেই বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে। একই সাথে সরকার এবং সরকারি এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবার জন্য ভোটারদের কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে।

বলা যায় যে ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসটি বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাস হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, যেখানে রাজনৈতিক আন্দোলন এবং উন্নয়ন উদ্যোগের মাধ্যমে সরকারি দল এবং বিরোধী দল একে-অপরকে কৌশলগতভাবে পরাজিত করবার চেষ্টা করছে। সরকারের অবকাঠামো প্রকল্পগুলো জাতির ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্ব বহন করলেও বিরোধী নেতাদের সরকার পতনের প্রতিশ্রুতি পূরণের ক্ষমতা নিয়ে সকল মহলে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।

এই অবস্থায় দেশের জনগণের জন্য টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের আবশ্যিকতার সঙ্গে রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার ভারসাম্য বজায় রাখা অত্যন্ত কঠিন একটি কাজ। ফলে অক্টোবর মাসকে রাজনৈতিক উত্থান-পতনের জন্য স্মরণ করা হবে, নাকি বাংলাদেশের সমৃদ্ধির পথে মাইলফলক হিসেবে বিবেচনা করা হবে তা কেবল সময়ই বলে দেবে।

তবে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করা একটি কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, অক্টোবর মাসকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অঙ্গনে যে ভয়ের আবহ তৈরি করার প্রচেষ্টা চলছে তা প্রকৃতপক্ষে প্রতিশ্রুতিই থেকে যাবে।

লেখক: অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
যাত্রাবাড়ীতে সড়ক দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেল আরোহী নিহত
যাত্রাবাড়ীতে সড়ক দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেল আরোহী নিহত
শেখ জামালের জন্মদিন আজ
শেখ জামালের জন্মদিন আজ
জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস আজ
জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস আজ
উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় আরও ৩ নেতাকে বহিষ্কার বিএনপির
উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় আরও ৩ নেতাকে বহিষ্কার বিএনপির
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ