X
শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪
২০ বৈশাখ ১৪৩১

সহিংসতা নয়, জনগণের সমর্থনই জরুরি

জোবাইদা নাসরীন
০১ নভেম্বর ২০২৩, ২১:২০আপডেট : ০১ নভেম্বর ২০২৩, ২১:২০

গত ২৯ অক্টোবর সকাল থেকেই ঢাকা ছিল আতঙ্কের শহর। এই সময়ে সাধারণ মানুষের কাছে আওয়ামী লীগ-বিএনপি বড় কথা ছিল না, তাদের মনে ভয় ছিল সহিংসতার। ঘর থেকে বের হলেই বিপদে পড়তে পারে কিংবা প্রাণও যেতে পারে– এই ভয়েই ছিল সবাই। এমনকি অনেকে অসুস্থ হওয়া সত্ত্বেও হাসপাতালে যাওয়ার সাহস করেনি।

ক‍্যানসারে আক্রান্ত আমার একজন আত্মীয় কেমো দিয়ে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরতে পারেনি ভয়ে। তাকে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে আরেক দিন বেশি থাকতে হয়েছে হাসপাতালে। অন‍্যদিকে সরকারি হাসপাতালগুলোতে এমনিতেই সিট সংকট। একজন রোগীর একদিন বাড়তি থাকা মানে আরেকজন রোগীর চিকিৎসা শুরু না হওয়া। কোনও কোনও স্কুল থেকে ২৮ তারিখ রাতেই শিক্ষার্থীদের পরের দিন স্কুলে যেতে বারণ করা হয়েছে। তবে লিখিত কোনও নোটিশ জারি করেনি, হয়তো করা যায়নি। আবার কেউ কেউ হরতাল ঠেলে স্কুলে গিয়ে দেখেছেন গেটে তালা ঝুলছে। বাসায় থেকে টিভি খুলেই সময় কাটিয়েছেন অনেকেই। কারণ, হরতাল কী মাপের হচ্ছে সেটি বুঝে বাসা থেকে বের হওয়া ঠিক হবে কিনা সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া। হরতাল, অবরোধের মতো দুঃসহ অভিজ্ঞতা আবারও ঘিরে ধরছে দেশের খেটে খাওয়া মানুষদের।

বাচ্চারা বারবার প্রশ্ন করেছে, করোনার সময়ও তারা স্কুলে গিয়ে লেখাপড়া করতে পারেনি, নির্বাচনের আগ পর্যন্ত তারা ক্লাস-পরীক্ষা ঠিকমতো দিতে পারবে তো?

সকালে জানা যায় মোহাম্মদপুর বাজার বন্ধ তখনও। ব‍্যবসায়ীরা দোকান খুলতে ভয় পাচ্ছেন। অন‍্যদিকে সবজি বিক্রেতারাও ভয়ে বের হতে পারছেন না। ‘দেখি কী হয়’- এসব ভেবে অপেক্ষা করছেন। আর যারা রাজধানীতে প্রতিদিন এসে ঝুড়ি, কোদাল নিয়ে বসে থাকেন দিনমজুর হিসেবে একটু কাজ পাওয়ার আশায়, তারা কী করছিলেন সেই দিনে, তা আমরা ভাবী না। কারণ তাদের জীবনযাপন আমাদের চোখের আড়ালে পড়ছে। আমরা শুধু চোখের সামনে সংঘর্ষে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তাদের নিয়েই বেশি আলোচনা করছি। সংঘর্ষে যারা নিহত হয়েছেন নিঃসন্দেহে তাদের সঙ্গে অন্য কারও তুলনা হবে না, কিন্তু প্রতিনিয়তই যারা পোড় খাচ্ছে তাদের নিয়ে কেউই মাতামাতি করছি না।

নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক নানা রকম তাপ-চাপে এতদিন বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে ‘সহিংসতা সতর্ক’ পরিস্থিতি বজায় ছিল সেটি আর জারি রাখা গেলো না। ২৮ অক্টোবরের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এটি বলা যায়, নানা চাপে দুই দলই এতদিন সহিংসতা চেপে রেখেছিল। শেষমেশ সেটির দিকেই রাজনৈতিক পরিবেশ মোড় নিচ্ছে।

পাঁচ বছর পরপর হওয়া বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনে সহিংসতা এক অনিবার্য অনুষঙ্গ হিসেবেই এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের মানুষের কাছে হাজির হয়েছে। আমরা শুধু মৃত‍ আর হতাহতের সংখ‍্যা গোনে সহিংসতার ক্ষতকে বিচার করছি। কিন্তু এই সহিংসতা সাধারণ মানুষের প্রতিদিনকার জীবনে কত ভয়, আশঙ্কা আর দুশ্চিন্তা, ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে আসছে সেদিকে আমাদের নজর নেই, হিসাব নিকাশের খাতাও নেই।

সাধারণভাবে রাজনীতি হওয়ার কথা মানুষের জন‍্য। রাজনীতিবিদরা মানুষের জন‍্যই কাজ করেন, করবেন। কিন্তু সেই রাজনীতি যদি হয় এরকম, তাহলে তো এক ভয়ানক পরিস্থিতি তৈরি হবে দেশে। সরকার নানা চাপে রয়ে-সয়ে থাকলেও শেষ পর্যন্ত কঠোর উপায়ে হলেও সহিংসতা ঠেকানোর পথ বেছে নিতেও দ্বিধা যে করবে না, সেটিই বুঝিয়ে দিয়েছে।

সহিংসতার রেশ খুব দ্রুত কেটে যাবে মনে হচ্ছে না। এর রেশ ধরে রাজনীতিতে আরও সহিংসতা জায়গা করে নেবে বলেই মনে হচ্ছে। কারণ, হরতালের দিনও বাসে আগুন দেওয়াসহ নানা ধরনের ঘটনা ঘটছে। এরইমধ‍্যে বিএনপি তিন দিনের অবরোধ পালন করছে। এই কমর্সূচির সঙ্গে একমত পোষণ করছে জামায়াতে ইসলামী।

আমরা ভুলে যাই– কেন আমরা রাজনীতি করি? তবে দেশে এক দল ক্ষমতায় যেতে এবং আরেক দল ক্ষমতায় থাকতে যেভাবে সহিংসতাকে অবলম্বন করছে, তাতে কোনোভাবেই মনে হয় না তাদের মনোজগতে মানুষ রয়েছে। থাকলে মানুষের দুর্ভাগ্য এড়িয়ে যেতে পারতেন না। নির্বাচন হবে ৩০০টি আসনে। সেই ৩০০টি আসনে জয়লাভ করবেন তিনশো জন। কিন্তু সেই নির্বাচন নিয়ে শান্তিতে নেই দেশের বেশিরভাগ মানুষ। অথচ যাদের বেঁচে থাকার অনিশ্চয়তা নেমে আসছে তারাই হওয়ার কথা এই নির্বাচনের মূল চালিকাশক্তি। কিন্তু তারা কোথাও নেই। নেই রাজনৈতিক দলগুলোর ভাবনায়, নেই নির্বাচনের ভাবনায়ও। কিন্তু এই মানুষদের জিম্মি করেই চলছে রাজনীতি, হবে নির্বাচন। নির্বাচনের আগেই যখন এই সহিংসতার শুরু, তখন নির্বাচন সহিংসতা ছাড়া হবে কোনোভাবেই বলা সম্ভব নয়।

কাদের জন‍্য নির্বাচন করবেন? কাদের ভোটে জিততে চান? নাকি দুই পক্ষের কাছেই এখন আর জনগণ গুরুত্বপূর্ণ নয়? কারণ, তারা বাদেই নির্বাচন করা যায় এবং ক্ষমতায় বসা যায়। বাইরের শক্তি আপনাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু গুরুত্বহীন দেশের মানুষ, যাদের জন‍্য রাজনীতি করেন বলে আপনারা দাবি করেন। কিন্তু তারা আপনাদের কর্মকাণ্ডের কোথাও গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হলে সহিংসতা বেছে নিতেন না।

আপনারা প্রমাণ করেছেন মানুষের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় যেতে চান না। এক দল আরেক দলকে আক্রমণ করে, সহিংসতা তৈরি করেই ক্ষমতায় যেতে চান। যেখানে জনগণ নেই, জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার কোনও মূল‍্য নেই, সেখানে রাজনীতি আসলে কাদের জন‍্য সেটি স্পষ্টতই বোঝা যায়।

দেশের মূল চালিকাশক্তি হলো জনগণ। সেই জনগণের মনে ভয়, উদ্বেগ তৈরি এবং তাদের জীবন সংগ্রামকে কঠিনতর করার রাজনীতির চর্চাই হচ্ছে বর্তমান বাংলাদেশে। সহিংসতা নয়, জনগণকে নিয়েই ক্ষমতায় যাওয়ার কথাই ভাবতে হবে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলকে।

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ‍্যালয়।

ইমেইল: [email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সেন্ট জোসেফ স্কুলে তিন দিনব্যাপী লিট ফেস্টিভ্যাল শুরু
সেন্ট জোসেফ স্কুলে তিন দিনব্যাপী লিট ফেস্টিভ্যাল শুরু
জাকিরের বিস্ফোরক ব্যাটিংয়ে প্রাইম ব্যাংকের বড় জয়
জাকিরের বিস্ফোরক ব্যাটিংয়ে প্রাইম ব্যাংকের বড় জয়
অবশেষে মোংলায় ঝরলো কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি
অবশেষে মোংলায় ঝরলো কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি
‘দেওরা’ সফলতার পর ‘মা লো মা’ চমক
‘দেওরা’ সফলতার পর ‘মা লো মা’ চমক
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ