X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

নৈঃশব্দ্যের ৫২ বছর

শবনম ফেরদৌসী
০৮ মার্চ ২০২৪, ০০:৪১আপডেট : ০৯ মার্চ ২০২৪, ১৬:০৩

বাংলাদেশের এবারের বসন্ত চারদিক উদ্ভাসিত করে তার বাহু মেলে ধরেছে। ২রা মার্চ তেমনই এক ঝলমলে দিনে চললাম সাভারের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে আমি আর জলি আপা। আমার মাথায় সবসময় একটা ভাবনা খেলা করে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল বসন্তদিনে। গাছে গাছে ফুল আর পাখি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল পাকিস্তানি বাহিনীর ম্যাসাকারের গোলাগুলির শব্দে।

৫২ বছর পেরিয়ে গেলো এ দেশের স্বাধীনতার। সে উপলক্ষে নারীপক্ষ বহু বছর পর বীরাঙ্গনাদের নিয়ে একটি আয়োজন করেছে। ৫০ জন বীরাঙ্গনাকে একত্রিত করে সম্মান জানানো, তাদের ঘুরে বেড়ানো আর তাঁদের চাওয়া-পাওয়া জানবার জন্য। সেই সঙ্গে তাদের তথ্য সংগ্রহ আছেই। একাত্তরের যুদ্ধশিশুদের নিয়ে ‘’জন্মসাথী’’ বানানোর উছিলায় আর নারীপক্ষের সঙ্গে কিছু ইস্যুতে সম্মিলিতভাবে কাজ করবার কল্যাণে আমিও সেখানে আমন্ত্রিত হলাম। প্রবল আগ্রহ নিয়েই যাওয়া, একসঙ্গে এতজন বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধাকে তো আর পাওয়ার সুযোগ হবে না। সারা বছর মুক্তিযোদ্ধাদের কত শত অনুষ্ঠান হয় রাষ্ট্রীয় এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে। কোনোদিন দেখিনি একজন বীরাঙ্গনাকেও আমন্ত্রণ জানাতে। ওই নারীপক্ষ সেই কত বছর আগে একবার আয়োজন করেছিল। আর কালেভদ্রে মাঝে মাঝে ফান্ড খরচ করবার নিমিত্তে ১৬ই ডিসেম্বর বা ২৬শে মার্চ উপলক্ষে তাদের দূরদূরান্ত থেকে টেনেহিঁচড়ে আনা হয়।

সবার সামনে কুমির ছানা দেখাবার মতো তাদের দেখানো শেষে, অত্যন্ত নিম্নমানের হোটেলে রেখে কোনোমতে পরদিনই পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এরপর জাতিসুদ্ধ ভুলে থাকা বছরের পর বছর। নারীপক্ষ তা করেনি। এরপর বীরাঙ্গনাদের যত্ন করে এনেছে, আদর করে রেখেছে, ঘুরিয়ে দেখিয়েছে তাঁরা যা দেখতে চান।

“জন্মসাথী” বানানোর পর বেশ কিছুটা আশাবাদী হয়েছিলাম বা হবার মতো ঘটনা ঘটেছিল- বীরাঙ্গনা এবং যুদ্ধশিশুদের ব্যাপারে। ইয়াসমিন কবিরের স্বাধীনতা নির্মাণের পরও কিছুকাল আলোচনায় ছিলেন তাঁরা। কিংবা শামীম আখতারের “ইতিহাস কন্যা” সময়টায়। তারপর জলে ভাসা কচুরিপানার মতো থিতিয়ে গেছে ”বীরাঙ্গনা” নামের রাষ্ট্রীয় বোঝা। যে বোঝা চিরকাল “মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে” বহন করে চলেছে রাষ্ট্র। আর জাতি হিসেবে এক বিশাল কলঙ্ক হয়ে জ্বলজ্বল করছে ৫২ বছর বাদেও।


নিজে ছবি করবার সুবাদে দেখেছি। সভা সমিতিতে দেখেছি। সংবাদেও হরহামেশাই দেখা যায় বাংলাদেশের সব বীরাঙ্গনা গরিব শ্রেণির। তাঁরা সবাই যেন গাঁয়ে থাকেন। দূরদূরান্তের গ্রামের অতি দরিদ্র একশ্রেণির ক্লিষ্ট চেহারার কিছু জীবন্ত নারী। এরা কেউ না জানে পড়াশোনা, না জানে নিজেদের না পাওয়ার কথা ছাড়া অন্য কোনও ভাষা। কী ক্যামেরা, কী নিউজের কলাম– তারা সারাক্ষণ শুধু চাইছেন আর নেই নেই বলে আক্ষেপ করছেন। কোথায় তাদের দেশপ্রেম! কোথায় তাদের আত্মত্যাগ! কোথায় বা সাহসিকতা! টিকে থাকার লড়াইয়ের গল্প তো হাওয়া হয়ে গেছে ৫২ বছরের মধ্যে। সেসব খুঁড়তে ইঁদুরের গর্ত থেকে সাপ বেরিয়ে আসবার সম্ভাবনাই বেশি।

যে দেশে মুক্তিযোদ্ধারাই বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতির সময় সবচেয়ে বেশ বিরোধিতা করেছে বা এখনও করে, সে দেশের বাকি মানুষেরা তাদের কেনই বা সম্মান করবে!

তা বুঝলাম দেশটা পুরুষের। তারা না বুঝতেই পারে বীরাঙ্গনাদের মর্ম। কিন্তু নারী? তারাও কি বুঝে? তারাও তো সে করুণাই করে। এ দেশের প্রথমদিকের নারীবাদীরা বীরাঙ্গনা বিষয়টি নিয়ে লড়েছেন, সামনে এনেছেন, নৈঃশব্দ্য ভেঙেছেন। ব্যাপারটা কি ওখানেই খতম হয়ে গেলো।

যেন বা হলো তো অনেক, মিটে গেছে! এ সময়ের নারীবাদীদের দেখলাম না এ নিয়ে কোনও নাড়াচাড়া করতে। এই যে আজ বিচারহীন ধর্ষণের মচ্ছব, এর মূল কারণ কি আমরা কখনও ভেবে দেখেছি! এর কারণ, দেশের জন্মলগ্নেই যুদ্ধাপরাধের অংশ হিসেবে বীরাঙ্গনাদের ধর্ষণের সাক্ষ্য-প্রমাণ চাপা দিয়ে দেওয়া। দীর্ঘকাল এর কোনও বিচার চাওয়াও হয়নি, উল্টো ভিকটিমকে লুকিয়ে ফেলা হয়েছে, ৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সব নথিপত্র পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। ফলে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম জাতি জেনেছে ধর্ষণ কোনও অপরাধ নয়। এ কাজ করে দিব্যি পার পাওয়া যায় এবং যিনি এই নির্যাতনের শিকার হন, সমাজ তাকেই পতিত করে, একঘরে করে রেখে দেয়। মনুষ্য সমাজের নিউরনে তথ্য এভাবেই জমা হয়।

কিছু সমাজবিজ্ঞানী তাদের রিসার্চের জন্য আর কিছু নারী নির্মাতা ছাড়া এ দেশের তরুণ নারীবাদীদের ওয়ার ভিকটিমের মনোদৈহিক ক্রাইসিস নিয়ে কাজ করতে দেখলাম না। যে শরীরের কারণে তারা নির্যাতিত সেই শরীর তাদের কাছে কী মানে এখন, যৌনতার অর্থ কি তাদের কাছে, আদৌ কি তাদের যৌন জীবন আছে, তারা কি ভয়ে শিউড়ে উঠেছে স্বাধীন দেশে স্বামীর সঙ্গে সহবাসে, শরীরকেন্দ্রিক যে রাজনীতি তার কি ব্যাখ্যা তাদের কাছে… একবার ভাবুন তো, কী ভয়ংকর ট্রমা নিয়ে একেকজন যাপন করে গেলেন এক একটি জীবন! কেউ কি ভুল করে হলেও সে ট্রমা ঘুঁচিয়ে দেবার জন্য আগ বাড়িয়ে গেছেন! কোনও মমতাময় হাত কি কোনোদিন তাদের দুঃখী চিবুক স্পর্শ করেছে!

জানা নেই! আমাদের কিছু জানা নেই! অথবা যে নারীরা তখন ধর্ষণের ফলে গর্ভবতী হয়ে পড়েছিল, সেই মুহূর্তে ভয়ে, ঘৃণায় কিংবা পরিবারের চাপে বাচ্চাকে ত্যাগ করেছেন বা অজানা কোথাও দত্তক দিয়েছেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তারা হয়তো কিছুটা থিতু হয়েছেন, বিয়ে থা’ হয়েছে, ছেলেপুলে জন্মেছে। হয়তো তিনি নিজেও একজন স্বাবলম্বী নারী। ২০-২৫  বছর পর তাদের কি কখনও মনে পড়েছে হারিয়ে ফেলা সেই নবজাতকের মুখ? কিংবা বিদেশ থেকে প্রতিবার মা’কে খুঁজতে আসা যুদ্ধশিশুদের দেখে কেঁদে কেঁদে কি বুক ভাসিয়েছেন তাঁরা? সাহস করে কি তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারেননি কেউ অন্য সন্তানের কথা ভেবে?

পুনরায় উন্মাদের মতো হয়ে পড়েছেন কি কেউ সেই ফেলে দেওয়া সন্তানকে ফিরে পাওয়ার আশায়, তাকে একটিবার জড়িয়ে ধরবার আকণ্ঠ ইচ্ছায়? এসবের কিছু জানা নেই আমাদের। কারণ, তাদের প্রতি কোনও বোধ কাজ করেনি আমাদের। তর্জনী উঁচিয়ে আমরা তাদের জন্য একটি  সম্মাননাই নির্ধারণ করতে পেরেছি, তা হলো নিস্তব্ধতা। চুপ করিয়ে রাখা।

এই যে নারী দিবস আসে-যায়, বেগুনি-পার্পলে ছেয়ে যায় দেশ। হাইব্রিড আর করপোরেট নারীদের নিয়ে শুরু হয় ফেমিনিস্ট প্যারেড। সেই ঝকমকে প্যারেডে এসব দরিদ্র ঘুটে কুড়ুনি বীরাঙ্গনাদের কি মানায়! আর যেসব শিক্ষিত মধ্যবিত্ত কিংবা উচ্চবিত্তের বীরাঙ্গনারা আছেন আমাদের মাঝে, তারা হয়তো কল্পনাও করতে পারেন না নারী দিবসের কোনও অনুষ্ঠানে “নারী শক্তি” হিসেবে আমন্ত্রিত হবার। আর তারা যাবেনই বা কেন! কবি বলে গেছেন- কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে! কিংবা মা দিবসের আয়োজনে? যখন মাতৃত্বের জন্য সম্মাননা দেওয়া হয়, তখন কই থাকেন বীরাঙ্গনা মায়েরা? যে মায়েদের সন্তান জানে তার মায়ের ধর্ষণের ফল হিসেবে তার জন্ম, সেই সন্তানই যখন বীরাঙ্গনা মা’কে ঘৃণা করে, তার জন্মের জন্য মা-কেই দায়ী করে তখন “মায়ের পায়ের তলে সন্তানের বেহেশত “ বা “জননী জন্মভূমি স্বর্গাদপী গরীয়সী” মিথ্যা হয়ে যায়। আমার নিজের একটা প্রতিবাদ আছে অবশ্য।

বীরাঙ্গনাদের মা ডাকতেই হবে কেন? মুক্তিযোদ্ধাদের কি আমরা বাবা ডাকি? ডাকি না তো। তবে কেন মায়ের মোড়কে এই নারীদের বীরত্বকে লুকিয়ে ফেলা! এ তো যুদ্ধের কাহিনি- বীভৎস এবং নিষ্ঠুর। তাতে আবেগ অনুকম্পার কোনও জায়গা নেই। দেশপ্রেম, সাহস আর আত্মত্যাগই মূল কথা। একেকজন বীরাঙ্গনা সাত আট মাস ধরে ক্যাম্পে নির্যাতিত হলেন। বেঁচে ফিরে সমাজচ্যুত হয়ে সারা জীবন লড়াই করে টিকে থাকলেন কোনও দাবি-দাওয়া ছাড়া, বিচার ছাড়া, রাষ্ট্রীয় পদক ছাড়া। আমরা তাদের কোনও মুখে আমরা অনুকম্পা দেখাই আমার মাথায় আজও ঢোকে না। সবচেয়ে অবাক হই তাদের দেশপ্রেম দেখে। যে দেশের স্বাধীনতার জন্য তার ওপর ঘটেছে বীভৎস নির্যাতন, যে দেশ উল্টো তাকেই করেছে একঘরে- সেই দেশের প্রতি তাদের ভালোবাসা দেখে আমি অবাক হয়ে যাই। আমাদের তো অজানা নয়, কত কত মুক্তিযোদ্ধা কি পরিমাণ অসাধু পথ বেছে নিয়েছেন পরবর্তীতে। কেউ কেউ সুযোগ-সুবিধার চূড়ান্ত অপব্যবহার করে গেছেন নির্লিপ্তভাবে। দেশ স্বাধীন করার উপহার হিসেবে নিজেরাই দেশকে ভোগদখলের ব্যবস্থা করে নিয়েছেন।

নৈঃশব্দ্যের ৫২ বছর

আজ পর্যন্ত একজন বীরাঙ্গনা সম্পর্কে এহেন অভিযোগ কেউ করেছেন বা শুনেছেন বলে আমার জানা নেই। আর তা করবেন বা কোত্থেকে নিজেদেরই যখন অস্তিত্বের তীব্র সংকট!  

আমি যতবার বীরাঙ্গনা নারীদের সান্নিধ্যে গেছি ততবার যেন চারপাশের বাতাসটা ভারী হয়ে ঠেকেছে আমার কাছে। যেন জমাট বাধা যন্ত্রণার এক পাষাণপুরী! সেই পাষাণ বুকে বেঁধে এক একটা মানুষ চলছে, ফিরছে, হাঁটছে, কথা বলছে। এবং কি ঋজু তাদের ভঙ্গি, কথা বলবার সৎ সাহস! আমি কোনও নাজুক ভঙ্গুর বীরাঙ্গনার সাক্ষাৎ পাইনি। দেখতে হয়তো তাঁরা খুব সাধারণ। কিন্তু ভীষণ বলিষ্ঠ তারা এত এত অপমান সইবার পরেও।

আমার শুধু মনে হয়, কীভাবে পারেন তারা! কেমন করে পারা যায়! কই এ সময়ের প্রিভিলেজড ক্লাসের কোনও একটি মেয়েকে তো তাদের মতো করে পেলাম না! হয়তো তাই তাদের আলোচনায় বীরাঙ্গনা নারীরা নেই। থাকবেই বা কী করে! তাদের অনেকেই হয়তো কোনোদিন বীরাঙ্গনা নারীদের চোখের দেখা দেখেনি, হাত দিয়ে ছুঁয়ে স্পর্শ করেনি। তাই এই সর্বাধুনিক যুগেও বীরাঙ্গনা নারীরা নারীদের কাছেও অচ্ছুত হয়ে রইলো। আমি নিশ্চিত। ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী যদি এই ঢাকায় থাকা শিল্পী না হতেন, তবে তিনিও ওরকম অচ্ছুতই থেকে যেতেন বলেই আমার বিশ্বাস।  

লেখক: চলচ্চিত্র নির্মাতা

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ভুটানে আবার কোচ হয়ে যাচ্ছেন বাংলাদেশের বিদ্যুৎ
ভুটানে আবার কোচ হয়ে যাচ্ছেন বাংলাদেশের বিদ্যুৎ
ধর্ষণ মামলা: প্রতিবেদন দাখিল পর্যন্ত জামিন পেলেন মুশতাক-ফাওজিয়া
ধর্ষণ মামলা: প্রতিবেদন দাখিল পর্যন্ত জামিন পেলেন মুশতাক-ফাওজিয়া
সৌদি আরব পৌঁছেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী
সৌদি আরব পৌঁছেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ