আজকের এই আধুনিককালে মুসলিম সমাজে দিনদিন যেন বদলে যাচ্ছে কোরবানির বাণী। আল্লাহর জন্য ত্যাগের ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের বদলে বস্তুবাদী ভোগের আধুনিক সংস্কৃতিই যেন মূল হয়ে উঠছে আজকালের নাগরিক সমাজে। অপ্রিয় দুঃখজনক হলেও সত্য, মুসলিম বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে ঈদুল আজহার যে বাহ্যিক রূপ ফুটে ওঠে, তাতে আমরা দেখতে পাই বাজারে লাগামহীন চড়া মূল্য, পশুর হাটে দাম নিয়ে অস্বস্তি, চামড়া মূল্যে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ক্ষতিসহ নানারকম অনাকাঙ্ক্ষিত অসঙ্গতি। অথচ হওয়ার কথা ছিল সর্বত্র নিজের ভোগ ও স্বার্থ ত্যাগ করে অন্যের প্রাপ্তি ও আনন্দ নিশ্চিত করা।
ঈদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আত্মোৎসর্গ, নিজের ভেতরে থাকা পশুত্বের মূলোৎপাটন এবং একমাত্র সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি। আল্লাহ তায়ালা বলেন: ‘আল্লাহ তায়ালার কাছে (তোমাদের কুরবানির) পশুর গোশত ও রক্ত কিছুই পৌঁছে না। তবে কেবল তোমাদের আল্লাহভীতি তাঁর কাছে পৌঁছে।’ [সুরা হজ, আয়াত: ৩৭]
পবিত্র কোরআনের দেখানো পথে আমরা ঈদুল আজহার প্রকৃত চর্চা নিশ্চিত করে সাম্য, মৈত্রী ও ভালোবাসার সমাজ গড়ার প্রয়াসে শামিল হতে পারি। অস্বীকারের উপায় নেই, তৃণমূল থেকে সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ স্তরে পবিত্র ঈদুল আজহার প্রকৃত বাণী ও ত্যাগের সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলতে হলে বা এর সুফল পেতে হলে আমাদের নিজেদের চিন্তা ও কর্মে ব্যক্তিগত লাভ ও লোভের বদলে ধর্মীয় পুণ্য ও সমাজের উন্নয়নকে সবার আগে স্থান দিতে হবে। তবেই মুসলিম হিসেবে আমরা সত্যিকার অর্থে ঈদুল আজহা থেকে উপকৃত হতে পারি।
প্রধান আমল
ঈদুল আজহার দিন প্রধান আমল হলো পশু কোরবানি করা। প্রথমে ঈদের নামাজ আদায় করে কোরবানি দিতে হবে। হজরত বারা ইবনে আজেব (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ আমাদের উদ্দেশে খুতবা দিয়ে বলেন:
আমাদের এই দিনের প্রথম কাজ নামাজ আদায় করা; এরপর কোরবানি করা। সুতরাং যে এভাবে করবে তার কাজ আমাদের তরিকা মতো হবে। আর যে (নামাজের) আগেই জবাই করবে (তার কাজ তরিকা মতো হয়নি) তা পরিবারের জন্য প্রস্তুতকৃত গোশত, (আল্লাহর জন্য উৎসর্গিত) কোরবানি নয়। [সহিহ বুখারি, হাদিস: ৯৬৮; সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৯৬১]
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি বছরই কোরবানি করতেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন:
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনার দশ বছরে (জীবনে) প্রতি বছরই কুরবানি করেছেন। [তিরমিজি, হাদিস : ১৫০৭]
সামর্থ্য থাকার পরও কোরবানি না করার ব্যাপারে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কঠোর ধমকের সুরে বলেন:
সামর্থ্য থাকার পরও যে ব্যক্তি কোরবানি করলো না, সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে। [ইবনে মাজাহ, হাদিস: ৩১২৩]
ঈদের দিনের বিশেষ আমল
ঈদের দিন খুশির দিন হলেও এক্ষেত্রে আমাদের জন্য কিছু আমল নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ঈদের দিন অন্যদিনের তুলনায় সকাল সকাল ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়া; মিসওয়াক করা; গোসল করা; শরিয়তসম্মত সাজসজ্জা করা; সামর্থ্য অনুসারে উত্তম পোশাক পরিধান করা, সুগন্ধি ব্যবহার করা।
তবে ঈদুল ফিতরে মিষ্টি জাতীয় কিছু খেয়ে ঈদগাহে যাওয়ার কথা হাদিসে উল্লেখ থাকলেও হাদিসগ্রন্থ তিরমিজি শরিফে বলা হয়েছে, ঈদুল আজহার নামাজের আগে কিছু না খেয়ে ঈদগাহে যাওয়া। এদিন না খেয়ে থেকে সর্বপ্রথম কোরবানির গোশত খাওয়া উত্তম। মুহাম্মদ (সা.) এভাবে খেতেন। [তিরমিজি, হাদিস : ৫৪২।]
ঈদুল আজহার দিন নামাজের পরে খাওয়ার কারণ এও হতে পারে যে এদিন যেন সবার আগে কোরবানির গোশতই মুখে ওঠে। যা আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে এক ধরনের দাওয়াত ও আপ্যায়ন। [মা’আরিফুল হাদিস]। এতে আরও বলা হয়েছে, পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া এবং পায়ে হেঁটেই ফিরে আসা; এক পথে যাওয়া এবং ভিন্ন পথে ফিরে আসা এবং ঈদের দিন পরস্পরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার বিষয়টিও।
কোরবানির পশু ও তার গোশত
কোরবানির পশু কেমন হবে এবং কোরবানির পদ্ধতি কী হবে, তা আমরা জানতে পারি হাদিসে নববীর মাধ্যমে। আনাস ইবনে মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন: রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাদা-কালো বর্ণের (বড় শিংবিশিষ্ট) দুটি নর দুম্বা কোরবানি করেন। আমি দেখেছি, তিনি দুম্বা দুটির গর্দানে পা রেখে ‘বিসমিল্লাহি ওয়াল্লাহু আকবার’ বললেন। এরপর নিজ হাতে জবাই করলেন। [সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫৫৫৮; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৯৬৬]
কুরবানির গোশত কী করবেন? এ ব্যাপারে হজরত জাবির (রা.) বর্ণনা করেন: হজরত মুহাম্মদ (সা.) (বিশেষ একটি কারণে) তিন রাত পর কোরবানির গোশত খেতে নিষেধ করেছিলেন। এরপর (অবকাশ দিয়ে) বলেন, ‘খাও, পাথেয় হিসাবে সঙ্গে নাও এবং সংরক্ষণ করে রাখো। [সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৯৭২]
হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: সুতরাং তোমরা খাও, সংরক্ষণ করো এবং সদকা করো। [সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৯৭১]
মোটকথা ঈদুল আজহা যেমন আনন্দের বার্তা দেয়, ঠিক তেমনি শিক্ষা দেয় মহান আল্লাহর আদেশ নিষেধ পালনের প্রতি নিজেকে উৎসর্গ করার জন্য। নিজের মাঝে থাকা পশুত্ব ও অমানবিক মনমানসিকতা বিসর্জন দেওয়ার। অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর বার্তা দেয়। সুপথ দেখায় ন্যায়নীতি আর নিষ্ঠার পথে চলার। শিক্ষা দেয় সুন্দর ও পবিত্র মনের অধিকারী হওয়ার।
লেখক: ইতিহাস গবেষক; মুহাদ্দিস: মাদ্রাসা দারুর রাশাদ