X
শনিবার, ০৩ মে ২০২৫
২০ বৈশাখ ১৪৩২

কেন সুইপার কলোনিগুলো বারবার টার্গেট হচ্ছে?

জোবাইদা নাসরীন
২১ জুন ২০২৪, ১৮:৫৮আপডেট : ২১ জুন ২০২৪, ১৮:৫৮

১৯৭১ সালের ভয়াল সেই ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইটে প্রথম আক্রমণ করা হয় ঢাকার পিলখানায়। সেখানে আক্রান্ত হয়েছিল পিলখানার অভ্যন্তরে থাকা সুইপার কলোনি। শহীদ হয়েছিলেন কয়েকজন। রাষ্ট্রীয়ভাবে তৈরি করা ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র’। সেখানে আছে সুইপারদের কয়েকজনের সাক্ষাৎকার– যারা সেই ভয়াল রাতের সাক্ষ্য দিয়েছেন। কিন্তু সেই কালরাতে শহীদ সুইপারদের কেউই শহীদের তালিকায় স্থান পাননি। শুধু ঢাকা পিলখানা নয়, বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সুইপার কলোনিগুলোতে পাকবাহিনী হামলা চালিয়েছিল। সেই পরিবারগুলো শুধু তাদের পিতামাতা হারানোর কথা মুখেই বলে, কিন্তু ইতিহাস লেখনী তাদের স্থান দেয়নি। কারণ তারা সমাজে ক্ষমতা-কাঠামোর কেউ নয়।

বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলাতেই রয়েছে সুইপার কলোনি। এই কলোনিগুলো নির্মাণের ইতিহাস অনেক পুরনো। চারশ’ বছর আগে তাদের পূর্ব পুরুষেরা এই দেশে এসেছিল। তাদের মূলত আনা হয়েছিল এই অঞ্চলকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার তাগিদে। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরেই ঢাকাসহ বেশ কয়েকটি জেলায় বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে সুইপারদের তাদের দীর্ঘদিনের বাসস্থান থেকে উচ্ছেদ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এরই সর্বশেষ চেষ্টা আমরা দেখি মিরনজল্লা সুইপার কলোনির বাসিন্দাদের উচ্ছেদ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে।

২০১৯ সালে রাজধানীর কমলাপুর থেকে পদ্মা সেতু হয়ে যশোর পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় ঢাকার গোপীবাগের (টিটিপাড়া) হরিজন ও তেলেগু কলোনির সুইপারদের ১১২টি পরিবারকে প্রথম দফায় উচ্ছেদ করা হয়। সেসময় প্রকল্প পরিচালকের কার্যালয় থেকে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে উচ্ছেদকৃত ১১২টি পরিবারের তালিকা তৈরি করা হলেও আজ পর্যন্ত তাদের পুনর্বাসন করা হয়নি। পরে আরও ২৭টি পরিবারকে তালিকা প্রণয়ন ছাড়াই উচ্ছেদ করা হয়।

এর আগে ২০১২ সালে খুলনা সদরের দেড়শ’ বছরের পুরনো সুইপার কলোনি উচ্ছেদের পরিকল্পনায় ২০টিরও অধিক ঘর ভেঙে দেওয়া হয়। এরপরের ঘটনাটি ঘটে রাজশাহীতে ২০১৮ সালে। রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার তাহেরপুর পেঁয়াজ হাটায় সরকারি খাস জমিতে স্বাধীনতার পর থেকেই ২০টি সুইপার পরিবার বসবাস করছে। স্থানীয় জনগণের মুখে মুখেই সেটির নাম হয়ে যায় সুইপার কলোনি। সেই কলোনি উচ্ছেদ করে মেয়র সেখানে নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন সুপার মার্কেট। প্রথমে পৌরসভা মেয়র সেই জায়গা খালি করার জন্য সুইপারদের নোটিশ পাঠায়। পরে বুলডোজার দিয়ে উচ্ছেদ করতে আসে। তখন সেখানকার সুইপাররা বাধা দেয়। এতে তাদের মারধর করা হয়। পরে মেয়রের এই উচ্ছেদ অভিযান ঠেকাতে তাহেরপুরে মল ঢেলে রাস্তা অবরোধ করেন সুইপাররা। তখনই ফিরে আসেন মেয়র।

এই মিরনজল্লা সুইপার কলোনিতেও তা-ই হচ্ছে। এখানে সুইপাররা প্রায় ৪০০ বছর ধরেই বসবাস করছেন। এখন এখানে প্রায় ৭০০ পরিবার বসবাস করছে। এদের মধ্যে পাঁচ শতাধিক সদস্য সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কাজে নিয়োজিত, আর বাকি দুইশ’ পরিবারও কোনও না কোনও সময়ে সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কাজে নিয়োজিত ছিলেন। ইতোমধ্যে কয়েকটি ঘর ভাঙা হয়েছে। উচ্ছেদের পর সেই জায়গায় কাঁচাবাজার সম্প্রসারণের পরিকল্পনা নিয়েছিল সিটি করপোরেশন। করপোরেশন থেকে বলা হয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তাদের পুনর্বাসন করা হবে। তবে সেখানে বসবাসরত হরিজনরা দাবি করেছেন, এতে অন্তত দেড়শ’টি পরিবার উচ্ছেদ হবে।

তবে এই মিরনজল্লা সুইপার কলোনির এই জায়গা অনেক দিন থেকেই প্রশাসনের নজরে ছিল। এ কারণে ২০১৯ সালেই হরিজন সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগে আবেদন করা হয়। সেই আবেদনে মিরনজল্লা সুইপার কলোনির জায়গায় কোনও ধরনের বাণিজ্যিক ভবন অথবা মার্কেট না করা এবং হরিজনদের আবাসিক সংকট কাটানোর জন্য অনুরোধ জানানো হয়।

খাস জমিতেই দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করে আসছে হরিজনরা। আইন অনুযায়ী দীর্ঘদিন কেউ খাস জমিতে বসবাস করলে সেটি তাদেরই জমি। আর বস্তি উচ্ছেদ মামলায় হাইকোর্টের স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। আর সেটি হলো পুনর্বাসন ছাড়া কোনও বস্তি বা কলোনি উচ্ছেদ করা যাবে না। কারণ মানুষের বাসস্থানের অধিকার মৌলিকগুলোর একটি।

প্রথমত কেন হরিজনদের উচ্ছেদ করেই সিটি করপোরেশনকে মার্কেট কিংবা কাঁচাবাজার করার পরিকল্পনা করতে হবে? কেন বুলডোজার দিয়ে তাদের ঘর ভাঙতে হবে? কোথায় তাদের পুনর্বাসন করা হবে? আমরা দেখেছি এর আগে যতবার মানুষের ঘরবাড়ি ভাঙা হয়েছে ততবারই বলা হয়েছে তাদের ঘর দেওয়া হবে। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষই নতুন ঘরে যেতে চায় না। সরকারি ভাষায় হয়তো সেই ঘর অনেক উন্নত, কিন্তু এই মানুষরা সেসব ’উন্নত’ ঘরে যেতে চায় না।  শত কষ্টের মধ্যেও তারা যেখানে থেকে অভ্যস্ত, অর্থাৎ তাদের আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে, সংস্কৃতি ছেড়ে থাকতে চায় না। এখন এক ঘরে ৫/৬ জন গাদাগাদি করে ঘুমায়, তবু তারা এখানেই থাকতে চায়।

টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনার একটি বড় অঙ্গীকার হলো কাউকে পিছিয়ে রাখা যাবে না। সেই হিসেবে তাদের উচ্ছেদের পরিকল্পনা সেই অঙ্গীকারের বিপরীতে অবস্থান করছে। বর্তমান সরকারের আরেকটি অঙ্গীকার হলো হতদরিদ্রদের ঘর দেওয়া। সেই অঙ্গীকার অনুযায়ী তাদের ঘর পাওয়ার কথা। ধরেই নিচ্ছি যেহেতু তারা কলোনিতে থাকে তাই তাদের বাড়তি ঘর দেওয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু যদি তাদের সেখান থেকে উচ্ছেদ করা হয় তাহলে তারা কোথায় যাবে?

মিরনজল্লার সুইপারদের কান্না, প্রতিবাদ, তাদের পাশে দাঁড়ানো অ্যাকটিভিস্টদের আন্দোলন এবং রিটের কারণে বর্তমানে এই উচ্ছেদ এক মাসের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। তবে এর পিছনে সম্ভবত কোরবানির গরু-ছাগলের বর্জ্য পরিষ্কারসহ রাস্তাঘাট পরিষ্কারের তাগাদা রয়েছে। এগুলো যে সুইপাররাই করবে। তাই যদি তারা আন্দোলন করে পরিষ্কার না করার সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে নাকাল হবে নগরবাসী। এখানেও রয়েছে তাদের কাজে লাগিয়ে শহর পরিষ্কার রাখার চিন্তা।

সুইপারদের স্বার্থ দেখার কেউ কি নেই? মনে রাখতে হবে আমাদের পরিষ্কার করতেই তাদের প্রয়োজন। এই সমাজ রাষ্ট্রে তাদের মর্যাদা, সম্মান এবং অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। তাদের অধিকারহীন করে কোনোভাবেই দেশ এগিয়ে গেছে বলা যাবে না। তাই শুধু এই সময়ের জন্যই নয়, আর কখনও যেন কাউকে উচ্ছেদ না করতে পারে সেই বিষয়ে আমাদের মনোযোগ দিতে হবে।

 

লেখক: শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বিভিন্ন অভিযোগে রাজধানীতে ১১ জন গ্রেফতার
বিভিন্ন অভিযোগে রাজধানীতে ১১ জন গ্রেফতার
পাকিস্তানকে দেওয়া ঋণ পর্যালোচনা করতে আইএমএফকে ভারতের অনুরোধ
পাকিস্তানকে দেওয়া ঋণ পর্যালোচনা করতে আইএমএফকে ভারতের অনুরোধ
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে প্রক্সি ওয়ারে জড়াতে চায়: ফরহাদ মজহার
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে প্রক্সি ওয়ারে জড়াতে চায়: ফরহাদ মজহার
কোচিং থেকে বিরতি নেবেন গার্দিওলা!
কোচিং থেকে বিরতি নেবেন গার্দিওলা!
সর্বশেষসর্বাধিক