ভেবেছিলাম ছাগল নিয়ে অনেকেই লিখেছে, আমি আর লিখবো না। কিন্তু ছাগলকাণ্ডে আলোচিত এনবিআর সদস্য মতিউর রহমান দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন বলে একটি গুজব ছড়িয়ে পড়েছে। ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা বিষয়টি জানিয়েছেন মতিউর দেশ ছেড়ে যাননি। এটাই ছাগল নিয়েই লিখতে উদ্বুদ্ধ করলো।
এনবিআর সদস্য মতিউর রহমান নিজে কোরবানির ছাগল কিনেননি। কিনেছিলেন তার ছেলে। এত টাকা দিয়ে ছাগল কেনার খবর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে সংবাদপত্রের খবরে চলে আসে। এমনকি দু-একজন কলামিস্ট তাদের কলামে আমলার ছেলের ব্যয়বহুল কোরবানির ছাগল ক্রয়ের বিষয় তুলে ধরেন।
মতিউর রহমানের সন্তান এবারের কোরবানির ঈদে ১৫ লাখ টাকায় একটি ছাগল ক্রয় করে বুক চিতিয়ে ‘বাহাদুরি’ করা থেকেই বিষয়টি জন্ম নিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, বিশেষ করে ফেসবুকে খবরটি আসে এক ধনবান পুত্রের বিলাসীকাণ্ড হিসেবে। ফেসবুক এবং গণমাধ্যম ঘটনার নাড়ি-নক্ষত্র নিয়ে এমনভাবে টানাহেঁচড়া শুরু করে যে ছাগল কর্মকাণ্ডটি ভাইরাল হয়ে ঘুরতে থাকে সবার মুখে মুখে।
গণমাধ্যমগুলো তার টাকার উৎস কী এবং সেই টাকার যথাযথ কর দেওয়া হয় কিনা সেসবের খোঁজ খবর নিতে মাঠে নামেন।
টনক নড়লো দুদকের। সরকারের সংস্থাগুলোও নড়েচড়ে উঠলো। বেরিয়ে আসতে শুরু করলো ছাগল ক্রেতার পিতা এনবিআর সদস্য মতিউর রহমানের দেশে-বিদেশে অঢেল সম্পত্তির সন্ধান। জানা গেলো তার সন্তানরা কোটি কোটি টাকা দামের গাড়ি চালায়, দেশে-বিদেশে রয়েছে তাদের অঢেল সম্পত্তি। নিজ এলাকায় গড়ে তুলেছেন বিরাট সাম্রাজ্য। ছেলে আমেরিকার নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। আর মেয়ে থাকে কানাডায়। বাপের পোদ্দারিতে বিলাসবহুল জীবনযাপন করে তারা।
এসব নিয়ে মতিউর রহমান বেশ বিপদে আছেন। তাকে এনবিআর থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। করা হয়েছে ওএসডি। সর্বশেষ খবরে দেখলাম ভদ্রলোক আখাউড়া বর্ডার দিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন! আবার ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা জানিয়েছেন খবরটি সত্য নয়, গুজব।
মতিউর রহমানের ছেলে ১৫ লাখ টাকা দিয়ে কোরবানির ছাগল না কিনলে সম্ভবত তার এই অঢেল সম্পত্তি জনগণের দৃষ্টিতে আসতো না, পত্রিকায় আসতো না, প্রশাসনকে ব্যস্ত হতে হতো না। বলতে বাধা নেই একদিনে বা এক মাসে অথবা এক বছরে তিনি এই সম্পত্তির মালিক হয়নি। এতদিন সবাই চোখ বন্ধ করেছিল।
এমন সম্পত্তির মালিক তিনি একাই নন, তার পর্যায়ের অনেকেরই আছেন বলে ধারণা করা যেতে পারে। মতিউর রহমানের বিষয়টি আমাদের দৃষ্টিতে এসেছে, অন্যদের বিষয় দৃষ্টিতে আসেনি। পার্থক্য এটাই। এরা সাধারণ মানুষের হক মেরে নিজেদের সম্পত্তির পাহাড় গড়ে তোলে। দেশের মানুষদের দুর্ভাগ্যের জন্য এই মতিউর রহমানরাই দায়ী। এরা ভিন্ন দেশে সেকেন্ড হোম করে, কানাডায় বিলাসবহুল বেগমপাড়া বানায়, সুইস ব্যাংকে হাজার হাজার কোটি কালোটাকা জমায়।
এসব একদিনে হয়নি। বহু দিন বহু কাল বহু যুগ ধরে চলছে। এই দলে শুধু মতিউর রহমানদের মতো আমলারাই নয় বরং রাজনীতিক, ব্যবসায়ী চোরাকারবারি অনেকেই রয়েছে। অতি সম্প্রতি অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ার অগ্রপথিক হিসেবে যাদের নাম পত্রপত্রিকায় আসছে তাদের মধ্যে যারা স্বনামে সবার কাছে পরিচিত তাদের দু-একজনের নাম বলতে গেলে বলতে হয় পুলিশের সাবেক মহাপরিচালক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের কথা। বলতে হয় ডিএমপির সাবেক কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়ার কথা, র্যাবের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার উত্তম কুমার বিশ্বাসের কথা।
প্রশ্ন হলো, এসব কীভাবে সম্ভব হয়! দেশে দুর্নীতি দমন কমিশন রয়েছে, রয়েছে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা। এসব প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের চোখে মতিউর রহমান গং দীর্ঘদিনের অনৈতিক কীর্তিকলাপ ধরা পড়লো না। যখন ফেসবুকে একটি বিষয় ভাইরাল হলো তখন তাদের ঘুম ভাঙলো। তবে কি আবার আরেকটি মতিউর রহমানকে ধরার জন্য ফেসবুকে আরেকটি সংবাদ ভাইরালের অপেক্ষায় থাকতে হবে? এটি একটি রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক।
আমাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোতে যথেষ্ট দক্ষ জনবল রয়েছে বলে আমরা বিশ্বাস করি। দক্ষ জনবল রয়েছে বলেই দেশে যখন জঙ্গিবাদ জেঁকে বসেছিল, যখন গুলশানে হলি আর্টিসানের মর্মান্তিক ঘটনা ঘটানোর সাহস নিয়ে জঙ্গিরা বুক চিতিয়ে বিচরণ করছিল, তখন এই গোয়েন্দাদের রিপোর্টের ভিত্তিতেই দেশকে উগ্রবাদী জঙ্গিদের হাত থেকে মুক্ত করা সম্ভব হয়েছে। এই একটি বিষয়েই প্রমাণ করে যে সরকার আন্তরিকভাবে চাইলে সবকিছুই সম্ভব।
আবারও উল্লেখ করতে চাই, কানাডার বেগম পাড়ায় আলোচ্য মতিউর রহমানের মতো অনেক মতিউর রহমানদের বিলাসবহুল ভবন রয়েছে। সেখানে তাদের বেগম সাহেবারা সন্তানরা দেশের সাধারণ মানুষের মারা টাকায় দুই হাতে অর্থ ওড়াচ্ছে। আনন্দ ফুর্তি করছে। এ নিয়ে বহু লেখালেখি হয়েছে। সচিত্র প্রমাণ পত্রপত্রিকায়, সামাজিকমাধ্যমে উপস্থাপিত হয়েছে। মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম নিয়ে কত কাণ্ডই না হলো, তারপর আবার নিস্তেজ হয়ে গেছে। প্রতিবছরই সুইস ব্যাংকগুলোর রিপোর্টের ভিত্তিতে বাংলাদেশিদের হাজার হাজার কোটি কালোটাকা জমা হওয়ার খবর আমরা শুনতে পাই। কিন্তু কেন যেন তাদের কিছুই হয় না।
এই কালো টাকার মালিক কারা? এরা আমাদেরই মতিউর রহমান গং। শুধু আমলা মতিউর রহমানরাই নয়, দুরবিন দিয়ে দেখুন, দেখবেন কত রাজনীতিবিদ, কত ব্যবসায়ী, কত চাকরিজীবী এই বলয়ে বিচরণ করছে। তাদের সরকার কেন বের করে জনসম্মুখে আনতে পারছে না? কিংবা কেন তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হচ্ছে না? এটা অনেকেরই প্রশ্ন।
যাহোক যে কথাটি বলার জন্য এত সব কথা বলা তা হলো মতিউর রহমান গংয়ের মূলোৎপাটন অত্যাবশ্যক। এসব ছোট বড় মাঝারি মতিউর রহমানরা যদি আমলাতান্ত্রিক কৌশলে, রাজনীতির আশীর্বাদে অথবা অন্য কোনও ক্যারিশমায় পার পেয়ে যেতেই থাকে, তবে আরও মতিউর, বেনজীর, আসাদুজ্জামানরা সংখ্যায় বাড়তেই থাকবে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক
*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।