X
রবিবার, ০৪ মে ২০২৫
২১ বৈশাখ ১৪৩২

হাসপাতালের অপেক্ষা-কক্ষ: যেখানে সময় থমকে দাঁড়ায়

মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম
০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৭:০৮আপডেট : ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৭:০৮

ঘটনাটি বেশ কয়েক বছর আগের। আমার বাবা তখন বেঁচে ছিলেন। তার দেহে বাসা বেঁধেছে মরণব্যাধি। তার কিডনির ক্রিয়াশীলতার সক্ষমতা একেবারে শেষ পর্যায়ে। দেহের এই খবর জেনে তিনি বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। মা ও দুই ছোট ভাইয়েরও একই অবস্থা। বাবা যেন তার মৃত্যুকে দেখতে পাচ্ছেন খুব কাছ থেকে। এতে তার আচরণেও পরিবর্তন এসেছে। বেশ জেদি হয়ে উঠেছেন। এই রোগের জন্য দায়ী করছেন নিজেকে। আমিসহ পরিবারের অন্যান্য সবাইকে। জীবনের ঘানি টানতে গিয়ে ভালো কিছু খেতে পারেননি। নিজ শরীরের যত্ন নিতে পারেননি।

অন্যদিকে আমি সক্ষমতার সর্বোচ্চটুকু দিয়ে চেষ্টা করছি সম্ভাব্য সবচেয়ে উন্নত চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করার। তো, বাবাকে নিয়ে বসে আছি দেশসেরাদের একজন কিডনি বিশেষজ্ঞের চেম্বারের অপেক্ষা কক্ষে। ডাক্তারের সাক্ষাৎ পাওয়ার জন্য বাবার সিরিয়াল নম্বর হলো ৫২। ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়ার সময় হাসপাতালের পক্ষ থেকে পরামর্শ অনুযায়ী বাবাকে নিয়ে সেখানে পৌঁছাই। কিন্তু তারা বেশ আগেই ডেকে ফেলেছেন। ডাক্তারও চেম্বারে ঢুকেছেন নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে। যা হোক, আমরা যখন পৌঁছাই তখন কেবল ১৪ নম্বর সিরিয়ালের রোগী ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকেছেন। এদিকে অপেক্ষা করতে করতে বাবা বেশ অস্থির হয়ে পড়েছেন। আমাকে বারবার তাগাদা দিচ্ছেন কোনও একটা ব্যবস্থা করতে। ডাক্তারের সাক্ষাৎ কিছুটা আগে পাওয়া যায় সেই চেষ্টা করতে। একপর্যায়ে আমাকে বকাঝকা শুরু করলেন। জীবনের এই মুহূর্তে আমি তার কোনও কাজে লাগছি না বলে অভিসম্পাত দিতে থাকলেন। আমার পেশাগত পরিচয়কে কাজে লাগিয়ে হলেও তার চিকিৎসকের সাক্ষাৎ পাওয়ার ব্যবস্থা করতে বলেন। প্রয়োজনে ঘুষ দিতে বলেন।

যে ব্যক্তিজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সৎ থেকেছেন, অন্যায়কে প্রশ্রয় দেননি; আর অপেক্ষার এই দীর্ঘ প্রহরের বেদনা, আশঙ্কা, ভয়, ক্ষোভের কাছে হার মেনে ফেললেন? তার এই ভয়, যন্ত্রণা, আশঙ্কা ও হার মেনে নেওয়াটা সন্তান হিসেবে আমি খুব আহত বোধ করি। নিজেকে খুব ক্ষুদ্র মনে হতে থাকে। অন্যদিকে বিচলিত বোধ করি বাবার জীবন ও আবেগের প্রশ্নে ক্ষমতা, সম্পর্ক ও পেশাগত অবস্থানকে কাজে লাগানোতে। তখন আমাকে দুনিয়ার সবচেয়ে অসহায়তম সন্তান মনে হয়েছে। আজ আমি বুঝতে পারি জীবনের প্রচণ্ড ভয় ও আশঙ্কা হয়তো বাবাকে এরূপ আচরণে তাড়িত করেছে। বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোতে রোগী ও তার স্বজনদের এই অভিজ্ঞতা কম-বেশি সবারই হয়। আজকের এই আলোচনাটি হাসপাতালের অপেক্ষা কক্ষে রোগীদের অভিজ্ঞতা নিয়েই।

হাসপাতালে দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষা রোগীর ওপর বহুমাত্রিক প্রভাব ফেলে। আর সেই প্রভাবগুলোর মধ্যে রয়েছে অর্থনৈতিক, মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক। এই প্রভাবগুলো কখনও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পড়ে। আর এগুলো হাসপাতালে রোগীর ব্যক্তিগত ও স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কিত অভিজ্ঞতাকেও স্পর্শ করে।

গবেষণায় দেখা গেছে, ডাক্তার দেখানোর ক্ষেত্রে অপেক্ষার সময় ও স্বাস্থ্যসেবায় রোগীর সন্তুষ্টির মাঝে গভীর সম্পর্ক আছে। অন্যদিকে রোগীর ওপর বহুমাত্রিক মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব পড়ে। অপেক্ষারত অবস্থায় মানসিক চাপের কারণে রোগী বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা বোধ করেন। এই সমস্যাগুলো কখনও বাস্তব, আবার কখনও শুধুই অনুভূত। অনেক সময় তাদের রক্তচাপ ও হৃদযন্ত্রের গতি স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি হয়ে যায়। দেখা দেয় বিভিন্ন স্নায়ুবিক পীড়ন। অন্যদিকে রোগী ও তার পরিচর্যাকারী স্বাস্থ্য তথ্যের প্রতি মনোযোগ দিতে পারেন না। কারণ ডাক্তারের সাক্ষাৎ পাওয়ার পূর্বে অপেক্ষার সময় তাদের যন্ত্রণা ও অস্বস্তির প্রতি সংবেদনশীলতার মাত্রা বেড়ে যায়। ফলে শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে তাদের মন ও চৈতন্যে বোধগত বিভ্রান্তি ও পক্ষপাতের জন্ম হয়। এ সময় যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সক্ষমতা হ্রাস পায়। এরপর চূড়ান্তরূপে তারা যখন ডাক্তারের সাক্ষাৎ পান তখন বেঠিক ডায়াগনোসিসের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। কেননা দীর্ঘ সময় অপেক্ষার ফলে তাদের শারীরিক অনুভূত সমস্যা ও প্রকৃত সমস্যা এক নাও হতে পারে। ফলে রোগীর মুখের কথা শুনে চিকিৎসা দেওয়া ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রশ্নে ডাক্তার বিভ্রান্ত হতে পারেন।

রোগের তীব্রতা, রোগের ধরন, হাসপাতালের যে বিভাগে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে তার ধরনের ভিত্তিতে বিভিন্ন দেশে অপেক্ষার সময়ের দৈর্ঘ্য ভিন্ন হয়। যেমন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জরুরি বিভাগে চিকিৎসা সেবা নিতে একজন রোগীকে গড়ে আধা ঘণ্টা থেকে দুই ঘণ্টারও বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়। তবে শহর এলাকায় প্রাথমিক চিকিৎসাসেবার জন্য ডাক্তার অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেতে ১-৩ দিন সময় লেগে যায়। আর ইনস্যুরেন্স না থাকলে এই সময় আরও দীর্ঘ হয়। জরুরি এমন রোগের ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক সেবা পেতে লাগে গড়ে ৩০ মিনিট। অন্যদিকে কানাডায় জটিল ও তীব্র রোগের জন্য জরুরি বিভাগে ডাক্তারের চিকিৎসা সেবা পেতে লাগে গড়ে ২-৪ ঘণ্টা। আর প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা কেন্দ্রে ডাক্তারে সাক্ষাৎ পেতে লাগে গড়ে কয়েক দিন থেকে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সাক্ষাৎ পেতে রেফারালের পরেও গড়ে ২২ দিন বা তারও বেশি সময় লাগে। অন্যদিকে যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সিস্টেমে ডাক্তারের সাক্ষাৎ পেতে গড়ে চার ঘণ্টা বা তারও বেশি সময় লাগে। আর সাধারণ চিকিৎসকের অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেতে লাগে এক থেকে দুই সপ্তাহ। অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়াতে কোনও হাসপাতালের ট্রাইয়েজে জরুরি চিকিৎসাসেবায় লাগে গড়ে ১০-৬০ মিনিট। আর চিকিৎসা পেতে লাগে চার ঘণ্টার মতো। অন্যদিকে দেশটির শহর এলাকায় প্রাথমিক চিকিৎসা ডাক্তারের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্টের দিনেই পাওয়া যায়। ইউরোপের দেশ জার্মানিতে জরুরি চিকিৎসার জন্য ডাক্তারের সাক্ষাৎ ৩০ মিনিটের মধ্যেই পাওয়া যায়। আর ইনস্যুরেন্স থাকলে সাধারণ কিংবা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সাক্ষাৎ পাওয়া যায় একদিনেই।

স্ক্যানডিনেভিয়ার দেশ সুইডেন ও নরওয়েতে এক ঘণ্টার মধ্যেই জরুরি চিকিৎসার জন্য ডাক্তারের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। তবে প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা নিতে ১-৭ দিন পর্যন্ত লেগে যায়। অন্যদিকে মধ্য ও নিম্ন আয়ের দেশ, যেমন- ভারত, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকাতে জরুরি চিকিৎসার জন্য ডাক্তারের সাক্ষাৎ পেতে কয়েক মিনিট থেকে একদিন পর্যন্ত লেগে যায়।

এবার আসা যাক বাংলাদেশ প্রসঙ্গে। মোটাদাগে এখানে ডাক্তারের সাক্ষাৎ পেতে ইউরোপ ও আমেরিকার তুলনায় বেশি সময় লাগে। এ দেশে হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে অপেক্ষার সময়ের দৈর্ঘ্য বিভাগ ভেদে ভিন্ন হয়। যেমন, ধরা যাক জরুরি বিভাগের কথা। এখানে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সাক্ষাৎ পেতে একজন রোগীকে গড়ে দুই থেকে চার ঘণ্টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। এই অপেক্ষার মাত্রা কখনও কখনও ছয় থেকে আট ঘণ্টায়ও পৌঁছায়। অন্যদিকে সরকারি হাসপাতালের বহির্বিভাগে সাধারণত তিন থেকে পাঁচ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। তবে বেসরকারি হাসপাতালে এই অপেক্ষার সময়টি এক থেকে দুই ঘণ্টার মধ্যে হয়। আর বিশেষায়িত চিকিৎসাসেবা, যেমন- ক্যানসার, কিডনি কিংবা হৃদরোগের চিকিৎসার জন্য কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, ডাক্তার দেখানোতে এই অপেক্ষার দৈর্ঘ্য হাসপাতালের ধরন ভেদে ভিন্ন হয়। যেমন– জেলা, উপজেলা, কিংবা বিভাগের সরকারি হাসপাতালগুলোতে সেবা পেতে রোগীকে সবচেয়ে বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়। এর পেছন মূল কারণটি হলো সেবাপ্রার্থী অত্যধিক রোগীর চাপ এবং সেই তুলনায় হাসপাতালে সম্পদের ঘাটতি। আর বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চিকিৎসা পেতে সাধারণত কম সময় অপেক্ষা করতে হয়। তবে ডাক্তারের পরামর্শ ফি, বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাবদ খরচ মিলিয়ে অত্যন্ত চড়া ব্যয়ের তুলনামূলক কম আয়ের মানুষ এখানে চিকিৎসাসেবা নিতে পারেন না।

একটি হাসপাতালে রোগীর অপেক্ষার সময় কম বা বেশি হওয়ার পেছনে যেসব বিষয় অনুঘটকের ভূমিকা পালন করে তা হলো: চিকিৎসা ব্যবস্থার মডেল, চিকিৎসা সেবাকেন্দ্রের ভৌগোলিক অবস্থান, রোগ ও চিকিৎসার ধরন, রোগীর অনুপাতে ডাক্তার সংখ্যা কম হওয়া, অবকাঠামো ও চিকিৎসা উপকরণের অপ্রতুলতা, চিকিৎসার সব সুযোগ কেবল শহর এলাকায় কেন্দ্রীভূত হওয়া, লাইনে থাকা অপেক্ষমাণ রোগীর মাঝে অন্য রোগী ঢুকে পড়া, কোনও কোনও রোগীকে মাত্রাতিরিক্ত সময় ধরে চিকিৎসা পরামর্শ দেওয়া, কার্যকর অ্যাপয়েন্টমেন্ট ব্যবস্থা না থাকা, চিকিৎসা সেবা নেওয়ার প্রশ্নে রোগীদের বিশেষ কোনও ডাক্তারের প্রতি আগ্রহ ও নির্ভরতা। বিশেষ করে সিনিয়র ডাক্তার বা অধ্যাপকদের কাছে চিকিৎসা নেওয়ার প্রবণতার ফলে কোনও কোনও ডাক্তারের চেম্বারে দীর্ঘ লাইন পড়ে যায়। অনেক সময় কোনও কোনও ডাক্তার আবার নির্দিষ্ট সময়ে তার চেম্বারে বসেন না। ফলে রোগীদের অপেক্ষার প্রহর বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে যন্ত্রণার মাত্রাও। কেননা, হাসপাতালের পক্ষ থেকে সম্ভাব্য অপেক্ষার সময় সম্পর্কে সঠিকভাবে যোগাযোগ করা হয় না।  অপেক্ষা কক্ষে সৃষ্টি হয় এক ধরনের বিশৃঙ্খল পরিবেশের।

বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোতে ডাক্তার দেখানোর জন্য অপেক্ষা করার প্রশ্নে বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আর সেই চ্যালেঞ্জগুলো হলো:  হাসপাতালের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সম্পর্কিত,  হাসপাতালের ভৌত অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা, মানসিক ও সামাজিক চ্যালেঞ্জ, প্রযুক্তিগত ও যোগাযোগের চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশে মানুষের দোরগোড়ায় গুণগত মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা খুবই সীমিত। ফলে বিদ্যমান স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে অতিরিক্ত চাপ পড়ে। আর এই অধিক সংখ্যক রোগী ও তার পরিচর্যাকারীদের জন্য পর্যাপ্ত স্থানিক পরিসর থাকে না।

অন্যদিকে, ভৌত অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতার অন্যতম হলো হাসপাতালে রোগীকেন্দ্রিক নকশা পদ্ধতির দুর্বলতা থাকে। বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোতে সাধারণত রোগীর স্বাচ্ছন্দ্য বিবেচনা করে অপেক্ষা কক্ষের নকশা করা হয় না। আলো ও বায়ু চলাচল ব্যবস্থা দুর্বল কিংবা পর্যাপ্ত না হলে তা অপেক্ষারত রোগী ও তার স্বজনদের দেহ, মন ও আচরণে প্রভাব ফেলে। আর বসার ব্যবস্থা আরামপ্রদ না হলে তারা মেজাজ ও ধৈর্য হারিয়ে ফেলে।

অন্যদিকে সীমিত পরিসরে মাত্রাতিরিক্ত বসার আসন থাকলে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার সম্ভব হয় না। তাছাড়া অপর্যাপ্ত স্যানিটেশন তথা শৌচালয় ও পরিচ্ছন্নতার ব্যবস্থা পর্যাপ্ত না হলে তা রোগীকে নেতিবাচকভাবে আক্রান্ত করে। অন্যদিক আলোকসজ্জা ব্যবস্থা দুর্বল হলে তা রোগীর দেহ মনে প্রভাব ফেলে। হাসপাতালে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অভাব, দূষিত বাতাস নিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকা, বিভিন্ন রোগের রোগীদের নিকটতা, বিভিন্ন রোগের জন্য আলাদা আলাদা ব্যবস্থা না থাকা ইত্যাদি পরিবেশগত স্বাস্থ্যঝুঁকির মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। অন্যদিকে নারীদের জন্য অপেক্ষা কক্ষে থাকে নানাবিধ বিশেষ চ্যালেঞ্জ।

অনেক শারীরিক ও মানসিক অনিশ্চয়তা নিয়েই রোগী ও তার পরিচর্যাকারীরা হাসপাতালে আসেন। হাসপাতালে ঢোকার পর থেকেই তাদের ভর করতে থাকে এক ধরনের উদ্বিগ্নতা ও দুশ্চিন্তা। আর ডাক্তারের সাক্ষাৎ পেতে লম্বা সময় অপেক্ষা করতে হলে তাদের এই দুশ্চিন্তার মাত্রা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে সে সম্পর্কে সঠিক তথ্য না থাকলে তাদের মনে ও আচরণে নানান প্রভাব পড়ে। রোগী ও পরিচর্যাকারীদের মাঝে হতাশা ও অসন্তোষবোধ জাগ্রত হয়। তারা প্রচণ্ড বিরক্তবোধ করেন। তারা মনে করেন যে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের সময়ের কোনও মূল্য নেই। এতে চূড়ান্তরূপে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী ও স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা সম্পর্কে তাদের এক ধরনের নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়। কমে যায় আস্থা ও বিশ্বাসের মাত্রা। ফলে ভবিষ্যতে একই হাসপাতাল কিংবা ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা নিতে আসেন না বা আসতে চান না। এতে বিশেষ কোনও ডাক্তার কিংবা হাসপাতালের সুনাম নষ্ট হয়। তাদের এই অভিজ্ঞতার কথা অন্য রোগীদেরও বলেন। ফলে মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে হাসপাতাল ও ডাক্তার সম্পর্কে দুর্নাম।

কাঙ্ক্ষিত সময়ের চেয়ে বেশি অপেক্ষা করতে হলে রোগীর মানসিক চাপের মাত্রাও বাড়ে। হাসপাতালে সেবার মান সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা জন্মে। এই নেতিবাচক ধারণা নিয়েই ডাক্তারের চেম্বারে প্রবেশ করেন। ফলে ডাক্তারের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও পুরো মিথস্ক্রিয়াটিই এক ধরনের নেতিবাচক লেন্স দিয়ে উপলব্ধি করেন। কেননা অপেক্ষা করার সময় তিনি মনে করেন যে তার রোগ ও সমস্যার প্রতি তেমন গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। গবেষণায় দেখা গেছে যে ডাক্তার দেখাতে দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষা করেছেন এমন রোগীরা ভবিষ্যতে কোনও রোগীকে সেই হাসপাতাল কিংবা ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা নিতে সুপারিশ করেন না। অনেক সময় কোনও কোনও রোগী চিকিৎসা না নিয়েই সেই হাসপাতাল ত্যাগ করেন। কিংবা অন্য কোথাও চিকিৎসা নিতে যান। এতে তার শারীরিক অবস্থা আরও খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। হার্ট-অ্যাটাক, স্ট্রোক কিংবা তীব্র ট্রমার মতো রোগের ক্ষেত্রে প্রতিটি সেকেন্ডই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে সামান্যতম দেরি হলে এসব রোগীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কিংবা আরোগ্য লাভের সম্ভাবনা কমে যায়। অন্যদিকে কোনও ডায়াবেটিক রোগীকে বেশি সময় ধরে অপেক্ষ করতে হলে তিনি ভবিষ্যতে রুটিন চেকআপে আসতে নাও পারেন। ফলে তার ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণ কঠিন হতে পারে। বাড়তে পারে বিভিন্ন জটিলতার ঝুঁকি।

রোগীকে নিয়ে ডাক্তারের জন্য অপেক্ষা করতে করতে অনেক সময় পরিবারের লোকজন মেজাজ হারিয়ে ফেলেন। জীবন যন্ত্রণার জন্য রোগীকে দোষারোপ করেন। অন্যদিকে রোগী ও স্বজন উভয়ই খুব অসহায় বোধ করেন। যেসব বয়স্ক, দীর্ঘমেয়াদে জটিল রোগে আক্রান্ত রোগী, বিষণ্নতা আক্রান্ত রোগী, চলাফেরা করতে পারেন না বা কম করতে পারেন, এমন ব্যক্তি ডাক্তার দেখাতে গিয়ে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হলে এক ধরনের প্রান্তিক বোধ করেন। মোটাদাগে, চিকিৎসাসেবা নেওয়ার জন্য হাসপাতালে ডাক্তার দেখানোর জন্য দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষা করতে হলে কোনও রোগী বা তার পরিবারকে বিভিন্নভাবে অর্থনৈতিক ক্ষতির শিকার হতে হয়। যেমন, দীর্ঘ সময় ধরে উৎপাদনশীল কাজে নিযুক্ত না থাকা। এর ফলে কর্মঘণ্টা কম হয় এবং সম্ভাব্য উপার্জন কমে যায়। এছাড়া রোগীর যাতায়াত খরচ বেড়ে যায়। দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষা করার ফলে রোগীর অবস্থা ক্রমশ খারাপের দিকে যেতে পারে। এতে জরুরি চিকিৎসার খরচের পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে। প্রয়োজন পড়তে পারে বাড়তি পরীক্ষা-নিরীক্ষার; দরকার পড়তে পারে মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তার।

এই অপেক্ষার রয়েছে একটি আবেগীয় মাত্রা। ডাক্তারের সাক্ষাৎ পেতে লম্বা লাইন ও সময় অপেক্ষা করতে হলে রোগী ও তার স্বজনদের দুশ্চিন্তা ও মানসিক চাপের পরিমাণ বেড়ে যায়। এতে শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে ভীতির মাত্রা বাড়ে; দেহ-মন ও অন্তরে সঞ্চারিত হয় মারাত্মক ভয় ও শঙ্কা। কোনও কোনও রোগী ও তার স্বজন প্যানিক অ্যাটাকেও আক্রান্ত হন। আবেগের জায়গায় ভেঙে পড়েন। এর ফলে জীবন, মরণ, সুস্থতা ও অস্তিত্বের প্রশ্নে খুবই অসহায় বোধ করতে থাকেন। মনে হতে থাকে যেন জীবনের কোনও কিছুতেই আর নিয়ন্ত্রণ নেই। ক্রমেই বাড়তে থাকে হতাশা। কমতে থাকে আবেগীয় সহনশীলতার মাত্রা। আর নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণের মাত্রা যত কমে, ঠিক ততই বাড়ে বিষণ্নতার সম্ভাবনা। এ সময় অনেক রোগী ও স্বজন হারিয়ে ফেলেন সঠিকভাবে চিন্তা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা।

ফলে কোনও কিছুতেই তারা মনোযোগ ধরে রাখতে পারেন না। কারণ এসময় মানসিক চাপ বাড়ে। জন্ম হয় মানসিক অবসাদের। স্মৃতিশক্তিতে ব্যাঘাত ঘটে। অনুধাবন ও উপলব্ধি সক্ষমতায় পরিবর্তন আসে। ফলে নিজের শরীর ও স্বাস্থ্যের সমস্যাগুলো এলোমেলো করে ফেলেন। ডাক্তারের কাছে গুছিয়ে বলতে পারেন না নিজ সমস্যাগুলো। এসময় শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে ব্যথার অনুভূতি অত্যন্ত তীব্র হয়ে ওঠে। মাথায় ঘুরপাক খেতে নানা কিসিমের নেতিবাচক চিন্তা। লোপ পায় কিংবা কমে যায় যৌক্তিক চিন্তার সক্ষমতা। শুধু তাই নয়, দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষার ফলে রোগীর শারীরিক প্রভাবও পড়ে। রক্তের চাপ বাড়ে; বৃদ্ধি পায় হৃদযন্ত্রেও ক্রিয়ার হারও; হাত পায়ে তীব্র ব্যথা অনুভূত হতে পারে। কমে যেতে পারে রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতাও। দেখা দেয় হরমোনের অসাম্যতা। দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হলে অনেক সময় কোনও কোনও রোগীর মাঝে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সম্পর্কে অনাস্থা, সন্দেহ, অবিশ্বাসের জন্ম হয়। আবার কোনও রোগী মাঝে চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণ করা না করা কিংবা এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়।

হাসপাতালে অপেক্ষার সময় রোগী ও তার পরিচর্যাকারীদের ইতিবাচক অভিজ্ঞতা নিশ্চিতের প্রশ্নে বহুমাত্রিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রথমেই বুঝতে হবে রোগীর দুশ্চিন্তার বিচ্ছিন্ন মাত্রা। আর সেক্ষেত্রে জরুরি হলো অপেক্ষা কক্ষে বসে থাকার সময় তাদের দুশ্চিন্তার উৎস ও কারণগুলো চিহ্নিত করা।

রোগী নির্ণয় ও চিকিৎসা প্রক্রিয়া সম্পর্কে তাদের অনিশ্চয়তা ও ভীতির মাত্রা প্রশমনে সহায়তা করা। বসার জন্য আরামদায়ক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। শুধু তাই নয়, অপেক্ষা কক্ষে বসার আসন বিন্যাস এমনভাবে করতে হবে যাতে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা নিশ্চিত হয়। অপেক্ষা কক্ষের সাজসজ্জা যাতে জাঁকজমকপূর্ণ না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আর রোগী ও স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের মাঝে যোগাযোগে কোনও ফারাক না থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে। এসব ক্ষেত্রে হাসপাতালে স্থাপত্য ও অন্তর্সজ্জা এমনভাবে করতে হবে যাতে অপেক্ষা কক্ষে আরামপ্রদ ও শিথিল আবহ তৈরি হয়। এমন এক পরিবেশ তৈরি করতে হবে যাতে রোগী ও তার পরিচর্যাকারীদের মনে হয় যে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছেন। হাসপাতাল রোগীকে ইতিবাচকভাবে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। আর সেক্ষেত্রে জরুরি হলো কক্ষটি নির্মাণে উপকরণ ও রঙের ব্যবহারে মনোযোগ দেওয়া। স্থানীয় প্রাকৃতিক উপকরণ ও আরামদায়ক রঙ ব্যবহার করলে রোগীর অভিজ্ঞতা ভালো হয়। এছাড়া শব্দের উচ্চমাত্রা প্রশমনের ব্যবস্থাও থাকতে হবে।

প্রযুক্তিচালিত সমাধানও এক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। যেমন, ডিজিটাল চেক-ইন ও রিয়েল টাইম আপডেট ব্যবস্থা থাকা; অপেক্ষার সারির ব্যবস্থাপনার জন্য মোবাইল অ্যাপের ব্যবহার করা; একেবারে ব্যক্তিকেন্দ্রিক অপেক্ষার সময় সম্পর্কে তথ্য ও ঘোষণা দেওয়া; মানসিক প্রশমনের লক্ষ্যে দেয়ালে বিভিন্ন রকম কৌশল প্রদর্শন করা; আবেগীয় সহায়তা প্রদানের জন্য প্রশিক্ষিত কর্মী বাহিনী নিয়োগ করা। রোগী ও তার স্বজনদের সঙ্গে অপেক্ষার সময় সম্পর্কে স্বচ্ছ যোগাযোগ নিশ্চিত করা। কোনও কারণে দেরি হলে স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা দেওয়া। পুরো অপেক্ষা ও চিকিৎসা প্রক্রিয়া সম্পর্কে রোগীকে নিয়মিত তথ্য দেওয়া এবং সমানুভূতিপূর্ণ মিথস্ক্রিয়া নিশ্চিত করা এবং রোগ স্বাস্থ্য শিক্ষা সম্পর্কিত বিভিন্ন উপকরণ দেওয়া। রোগ, চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য বিভিন্ন ম্যাগাজিন, পত্রিকা ও প্রকাশনার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এছাড়া হাসপাতালের কোথায় কোন ধরনের সেবা পাওয়া যাবে সে সম্পর্ক তথ্য দেওয়ার জন্য দেয়ালে বিভিন্ন প্রতীক, চিহ্ন ও সংকেত সেঁটে দেওয়া।    

লেখক: সিনিয়র লেকচারার, মিডিয়া স্টাডিজ অ্যান্ড জার্নালিজম বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব)।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ঢাবির সাবেক উপাচার্য, প্রক্টর ও আ.লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে রাশেদ খানের মামলা
ঢাবির সাবেক উপাচার্য, প্রক্টর ও আ.লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে রাশেদ খানের মামলা
বিয়ের প্রলোভনে যৌনসম্পর্ক শাস্তিযোগ্য অপরাধ: অধ্যাদেশের বৈধতা প্রশ্নে রুল
বিয়ের প্রলোভনে যৌনসম্পর্ক শাস্তিযোগ্য অপরাধ: অধ্যাদেশের বৈধতা প্রশ্নে রুল
সিরিজের নেশা কাটিয়ে সিনেমায় মন...
সিরিজের নেশা কাটিয়ে সিনেমায় মন...
৯ মাস পর চালু হলো আগুনে পুড়ে যাওয়া নারায়ণগঞ্জ পাসপোর্ট অফিস
৯ মাস পর চালু হলো আগুনে পুড়ে যাওয়া নারায়ণগঞ্জ পাসপোর্ট অফিস
সর্বশেষসর্বাধিক