আমরা যারা দীর্ঘদিন বিদেশে থাকি, প্রায় সবাই একটি শব্দের সঙ্গে খুবই পরিচিত আর তা হলো ‘আইডেন্টিটি ক্রাইসিস’ বা পরিচয় সংকট। বিদেশে জন্ম ও বড় হওয়া সন্তানদের ক্ষেত্রে এটি একটি ভয়াবহ সমস্যা। যেকোনও জটিল রোগ থেকেও ‘আইডেন্টিটি ক্রাইসিস’-কে অনেক বড় করে সমস্যা হিসাবে বিবেচনা করা হয়। অনেক পরিবার জানতেই পারে না যে তার সন্তান ‘আইডেন্টিটি ক্রাইসিস’-এ ভুগছে। বিদেশে ছেলেমেয়েরা বাসাবাড়িতে বেড়ে উঠে দেশি সংস্কৃতির বলয়ে, আর ঠিক চৌকাঠ পেরুলেই তারা দেখে ভিন্ন সংস্কৃতি, ভিন্ন ভাষা। তারা স্কুলজীবন থেকেই শুরু করে জাতিগত আত্মপরিচয়ের এই যুদ্ধ। নিজের পরিচয় নিয়ে সংকটে পড়ার মতো কষ্ট মনে হয় পৃথিবীতে আর নেই।
তারা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে, কঠিন এক সময় পার করে জীবনের অনেকটা বছর। ফলে উন্নত বিশ্বে, সরকার এই ‘আইডেন্টিটি ক্রাইসিস’কে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে এবং উত্তরণে নানা ধরনের কর্মসূচি অব্যাহত রাখে। তাই ‘আইডেন্টিটি ক্রাইসিস’কে অস্তিত্ব সংকটের সঙ্গে তুলনা করা হয়। মনোবিজ্ঞানে ব্যক্তির এই সমস্যাকে বলা হয় আত্মপরিচয় অর্জনে ব্যর্থতা।
ব্যক্তির মতো রাজনৈতিক দলেরও ‘পরিচয়’ একটি অপরিহার্য অংশ। জনগণের কাছে দলের পরিচয় একদম পরিষ্কার থাকতে হবে। নতুবা জনগণ জানতে চাইবে, দলটি কেমন? তার চরিত্র কেমন? কোন গোষ্ঠীর, কোন জাতির? কিংবা কোন সংস্কৃতির? বা কোন আদর্শের? বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল হিসাবে বিএনপি কিংবা আওয়ামী লীগের মতো প্রায় সব দলের পরিচয় সাধারণ মানুষের কাছে বেশ পরিষ্কার। রাজনৈতিক দলগুলোর চরিত্রও সবার জানা। কিন্তু জন্মের পর থেকেই রাজনৈতিক দল হিসাবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলাম ‘আইডেন্টিটি’ নিয়ে আছে এক মহা সমস্যায়। কারণ দলটির জন্ম ব্রিটিশ ভারতের একটি ভিন্ন প্রেক্ষাপটে, ভিন্ন গোষ্ঠী থেকে।
এমনকি দলটির প্রতিষ্ঠাতা শাইখ সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদীও একজন ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষ। মূল দলটির একটি শাখা পাকিস্তানে আর অন্য অংশটি বাংলাদেশে। এই দেশে দলটি বেড়ে উঠেছে সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশে, ভিন্ন সংস্কৃতিতে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ভাষা, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য নিয়ে তারা বারবার বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছে।
সাধারণত কোনও একটি দেশে একটি রাজনৈতিক দল গঠিত হয় কোনও জাতি গোষ্ঠীর চাহিদা, ইচ্ছা কিংবা প্রয়োজনের তাগিদ থেকে। আর সেই দলগুলো ওই জাতি গোষ্ঠীর ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের ওপর নির্ভর করে তৈরি করে তার আদর্শিক জায়গা। সেই রাজনৈতিক দল সংঘবদ্ধভাবে দেশ বা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বার্থের বিষয় নিয়ে কাজ করে থাকে।
জামায়াতে ইসলামের সমস্যাটা ঠিক এখানেই। দলটি দেশের নানা বিষয় নিয়ে চরম বিভ্রান্ত। তাদের সাবেক আমির গোলাম আজম, যিনি ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেও পরবর্তীতে ১৯৭০ সালে বলেছেন, ‘বাংলা ভাষার আন্দোলন করা ভুল হইয়াছে,’ এবং এর জন্য তিনি পাকিস্তানের কাছে ক্ষমাও চেয়েছেন। তার মানে ভাষার বিষয়ে দলটির সাবেক আমির নিজেও ছিলেন বিভ্রান্ত। ধর্মীয়ভাবে তারা আরবি ভাষাকে সর্বোচ্চ জায়গায় স্থান দিয়েছে। আবার তাদের প্রতিষ্ঠাতা মওদুদীর মাতৃভাষা উর্দুকে মনের গহিনে লালন করে। ফলে ব্রাহ্মণদের মতো সেই চর্যাপদের পথ ধরে বাংলা হয়ে পড়েছে তাদের কাছে অনেকটা অচ্ছুত। পরে স্বাধীন বাংলাদেশে তারা বাংলাকে মেনে নিয়েছে কিন্তু মেনে নেয়নি। ফলে ভাষা দিবস পালনেও তাদের এক ধরনের অনীহাই শুধু নয়, ‘হারাম’ বলে অবহিত করতে দেখা যায়। তাদের কাছে আরবি, উর্দু কিংবা ফার্সি ভাষাটাকে যত আপন মনে হয়, মায়ের ভাষা বাংলাটাকে ঠিক তত আপন মনে হয় না।
সংস্কৃতির ক্ষত্রে তাদের আচরণে আরও ভয়াবহ চিত্র ফুটে ওঠে। হাজার বছরে গড়ে ওঠা বাংলাদেশের বাঙালি মুসলমান সংস্কৃতি থেকে আরবের সংস্কৃতিকেও অনেক বেশি আপন মনে করে, চর্চা করে। ফলে পোশাক-আশাকে, খাবার-দাবারে এমনকি সামাজিক রীতিতেও আরবের সংস্কৃতি পালনে তারা অনেক বেশি উজ্জীবিত। দেশীয় আচার-অনুষ্ঠানের চেয়ে আরব কিংবা পাকিস্তানের সংস্কৃতিকে অনেক বেশি উপভোগ করে। তাই একদিকে দেশীয় বাউলদের অনুষ্ঠানে বাধা দেয়, অন্যদিকে পাকিস্তানি কাওয়ালি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। তাদের বিভ্রান্তি এমন এক জায়গায় পৌঁছেছে যে, পূজার অনুষ্ঠানে নাশিদ কিংবা গীতা পাঠের মতো কাজকর্মের মাধ্যমে নিজেদের সর্বজনীন প্রমাণ করতে চায়, আবার অন্য দিকে ইসলামিক দল হিসাবে প্রচার চালায়। একদিকে প্রকাশ্যে ইসলামের রক্ষক দাবি করে, অন্যদিকে হিন্দু কিংবা খ্রিষ্টান শাখা উদ্বোধনের মাধ্যমে তৈরি করে আত্মপরিচয়ের এক উদ্ভট সংকট।
দলটির বেশিরভাগ কর্মী জানে না সে কোন জাতিসত্তার, তাই শুধু ধর্মকে ব্যবহার করে নিজের জাতিসত্তার পরিচয় প্রকাশ করতে চায়। আর এই পরিচয় প্রকাশ করতে গিয়ে তারা তৈরি করে এক সাংস্কৃতিক সংকট। তাই দলটির আমিরের শিশুদের আপত্তিকরভাবে স্পর্শ করার কিছু ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। যা শুধু আমাদের সংস্কৃতিতেই অগ্রহণযোগ্য তাই নয়, ধর্মীয়ভাবেও নিরুৎসাহিত। এ ধরনের স্পর্শকে ‘ব্যাড টাচ’ হিসাবে গণ্য করা যায়।
ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের বিষয়ে দলটি বরাবরই নীরব ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের সবচেয়ে গর্বের ইতিহাস হলো স্বাধীনতার ইতিহাস। যেহেতু জামায়াতে ইসলামী দলগতভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান করেছিল এবং বর্তমানেও তাদের ওই অবস্থান নিয়ে কোন পরিষ্কার বক্তব্য পাওয়া যায়নি, তাই তারা এই বিষয়টি সবসময় এড়িয়ে চলে। ‘স্বাধীনতা দিবস’ কিংবা ‘বিজয় দিবস’ উদযাপনে দেখা যায় তাদের এক ধরনের উদাসীনতা। কিন্তু রাজনীতিতে দেশপ্রেম একটি স্বতঃসিদ্ধ বিষয়। কিন্তু এই বিষয়টি দলটিকে সবসময় পীড়া দেয়। অনেকটা পরীক্ষায় পাস না করেও উত্তীর্ণদের মতো ভাববাচ্যে চলাফেরা করার মতো। তাই কারণে অকারণে, অতি উৎসাহী হয়ে মাথায় জাতীয় পতাকা বেঁধে রাজপথে নেমে পড়ে দেশ-ভক্তির শোডাউনে।
তাছাড়া উপমহাদেশে এই দলটির উল্লেখ করার মতো কোনও ইতিহাস নেই। দেশ পরিচালনা করার অভিজ্ঞতাও নেই। তাছাড়া দলটির সাবেক আমিরের কথায় স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে ১৯৪৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত তাদের প্রধান কার্যালয় পাকিস্তানের লাহোরে অবস্থিত। কিন্তু একটি স্বাধীন দেশের রাজনৈতিক দলের প্রধান কার্যালয় অন্য একটি দেশে অবস্থানের বিষয় নিয়ে তারা মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে।
বাংলাদেশি বাঙালির ঐতিহ্য নিয়ে তাদের রয়েছে এক ধরনের অ্যালার্জি। ফলে প্রচলিত উৎসব পহেলা বৈশাখ, পহেলা ফাল্গুন, চৈত্র সংক্রান্তি, নবান্ন, বর্ষা উৎসব কিংবা গায়ে হলুদ, বৌভাতের মতো সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোও তাদের ‘আপত্তির’র উদ্ভব ঘটায়।
সব মিলিয়ে এই দলটি তার জাতিগতভাবে আত্মপরিচয় অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে, অর্থাৎ আইডেন্টিটি ক্রাইসিস-এ ভুগছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াতে ইসলামীর জন্য যা একটি বড় ধরনের সংকট তৈরি করেছে।
লেখক: নির্মাতা ও ব্রডকাস্টার