X
বৃহস্পতিবার, ০৮ মে ২০২৫
২৪ বৈশাখ ১৪৩২

সম্পর্ক উন্নয়নে বাংলাদেশ এগিয়েছে, ভারতকেও এগিয়ে আসতে হবে

শেখ শাহরিয়ার জামান
০৫ এপ্রিল ২০২৫, ১৭:৫৪আপডেট : ০৫ এপ্রিল ২০২৫, ১৭:৫৪

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে প্রথমবারের মতো দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়েছে ৪ এপ্রিল (২০২৫)। থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের সাইডলাইনে দুই নেতার মধ্যে এই বৈঠক হয়। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে শীর্ষ নেতাদের মধ্যে একাধিকবার বৈঠকের উদ্যোগ নেওয়া হলেও এই প্রথমবারের মতো দুই নেতা মুখোমুখি আলোচনায় বসেন। এর আগে দুজনের মধ্যে টেলিফোন আলোচনা হলেও মুখোমুখি আলোচনায় এই প্রথম দুই পক্ষ একে-অপরকে বোঝার চেষ্টা করেন।

বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের সাইডলাইনের দুই নেতার মধ্যে বৈঠকের জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানো হলে ভারত শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে চেষ্টা অব্যাহত ছিল এবং অবশেষে ভারত বৈঠক করতে রাজি হয়।

মোদির টুইট

বৈঠকের পরে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আনুষ্ঠানিক টুইট একাউন্ট থেকে একটি বার্তা দেওয়া হয়। বার্তায় বলা হয়-

‘বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা জনাব মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে সাক্ষাৎ করেছি। ভারত বাংলাদেশের সাথে একটি গঠনমূলক ও জনকেন্দ্রিক সম্পর্কের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

আমি বাংলাদেশে শান্তি, স্থিতিশীলতা, অন্তর্ভুক্তি ও গণতন্ত্রের প্রতি ভারতের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছি। অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করা রোধের ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করেছি এবং হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও কল্যাণের জন্য আমাদের গুরুতর উদ্বেগ প্রকাশ করেছি।‘

টুইটে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য যতটা না বলা হয়েছে, তার থেকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক মঞ্চের প্রতি। ভারতের রাজনীতিতে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু বিষয়টি জনতুষ্টিমূলক এবং সে কারণে ভারতের অনেক রাজনীতিবিদরা বিষয়টি নিয়ে কথা বলে থাকেন। এক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম দেখা যায়নি।

বাংলাদেশের উদ্বেগ

বৈঠকের পরে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে এবং সরকারি কর্মকর্তারা এ বিষয়ে সাংবাদিকদের জানান। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে উভয় ক্ষেত্রে জানানো হয় বৈঠকে পানি, সীমান্ত হত্যা, রাজনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়ন, সব নাগরিকের সমান নিরাপত্তা, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। পানি সমস্যা নিয়ে সমাধানের বিষয়ে দ্রুত উদ্যোগ নেওয়ার জন্য এবং সীমান্ত হত্যাকাণ্ডের কারণে বাংলাদেশের উদ্বেগ পরিষ্কার করে জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়টা বাংলাদেশ অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে থাকে সেটি জানানো হয়েছে।

সংখ্যালঘু বিষয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জানানো হয় যে এগুলোর বেশিরভাগই অপপ্রচার এবং ভারত এ বিষয়ে কিছু বলার আগে প্রকৃত ঘটনা সম্পর্কে যেন পরীক্ষা করে দেখে। পানি সমস্যার ক্ষেত্রে তিস্তা নদীর পানি বন্টন এবং গঙ্গা নদীর চুক্তি নবায়ন এবং  সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠানোর বিষয় বৈঠকে আলোচিত হয়।

বড় ধরনের পরিবর্তন নেই

কূটনীতিতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় আলোচনার উপরে। সম্পর্ক উন্নয়ন অথবা দ্বন্দ্ব বা সংকট নিরসন - সব ক্ষেত্রেই আলোচনার কোনও বিকল্প নেই। সেটি বিবেচনায় নিলে এই বৈঠকের তাৎপর্য অনেক বেশি। তবে একই সঙ্গে এটিও দেখতে হবে যে বৈঠকে কী কী বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে, কীভাবে আলোচনা হয়েছে এবং বৈঠকে কোনও সিদ্ধান্ত হয়েছে কিনা। আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে প্রধান উপদেষ্টা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী একে-অপরকে তাদের বক্তব্য সম্পর্কে জানিয়েছেন। কিন্তু কোনও ধরনের সিদ্ধান্ত বা দিকনির্দেশনা এই বৈঠক থেকে নেওয়া হয়নি। বৈঠকের পরে উভয় দেশের কর্মকর্তারা যা বলেছেন এবং সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে যা প্রকাশ করা হয়েছে, সেখান থেকে দৃঢ় কোন ফলাফল এসেছে, সে ধরনের কোনও ধারণা পাওয়া যায় না। তবে এই বৈঠকটি ভবিষ্যতে দুই দেশের কর্মকর্তাদের মধ্যে আলোচনা বড় ধরনের প্রভাব রাখতে পারে বলে ধারণা করা যায়।

সম্পর্ক উন্নয়নের দায়িত্ব সবার

সম্পর্ক উন্নয়ন এবং এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য দায়িত্ব রয়েছে প্রতিটি পক্ষের। কূটনীতিতে প্রতিবেশীকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়। এর কারণ হচ্ছে একজন ব্যক্তি তার প্রতিবেশী পরিবর্তন করতে পারে, কিন্তু একটি দেশ কখনই তার প্রতিবেশী পরিবর্তন করতে পারে না।

দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে ভারত সবচেয়ে বড় দেশ এবং শক্তিশালী রাষ্ট্র। শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের দায়িত্বও বেশি। ভারতের প্রতিবেশী নীতির ক্ষেত্রে গুজরাল ডক্ট্রিন মোটামুটি ভাবে অনুসরণ করা হয়। সেখানে প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়ার কথাও বলা আছে। ভারত এর আগে একাধিকবার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে যে বাধাগুলো রয়েছে সেগুলো দূর করার জন্য এগিয়ে এসেছিল। বাংলাদেশের প্রত্যাশা করে শুধুমাত্র একটি দল বা গোষ্ঠী কেন্দ্রিক সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য নয়, বরং গোটা বাংলাদেশ এবং তার মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ভারত এগিয়ে আসবে।

ড. ইউনূসের ভূমিকা

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরে দায়িত্ব গ্রহণ করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে একটি অস্থিতিশীল পরিবেশকে স্থিতিশীল করার উদ্যোগ সঙ্গে সঙ্গে গ্রহণ করেন তিনি। একই সঙ্গে বিদেশিদের সঙ্গে যোগাযোগ ক্ষেত্রে সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করেন এবং সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে জোরালো পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ প্রদান করেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে।

ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে টেলিফোন আলাপ করেন এবং গত সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ অধিবেশনের সাইডলাইনে দুই নেতার মধ্যে বৈঠকের উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য চেষ্টা করে বাংলাদেশ।

ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান সহ সব দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য ড. ইউনূসের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ যে নীতি গ্রহণ করেছে সেটি হচ্ছে পারস্পরিক সম্মান এবং উভয়ের জন্য লাভজনক এমন একটি সম্পর্কের উপর। যেকোনও দেশের ক্ষেত্রে সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এই নীতি অনুসরণ করছেন ড. ইউনূস।

ভারতের করণীয়

প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্ক হয় মানুষ এবং মানুষের মধ্যে এবং পারস্পরিক সম্মান ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে। বাংলাদেশ একই ধরনের সম্পর্ক চায় ভারতের সঙ্গে।

দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ এবং শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে এ বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে ভারতকে। ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখার কারণে অবশ্যই এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশগুলো উপকৃত হতে পারে। কিন্তু একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে কে কতটুকু পাচ্ছে বা জনগণের পারসেপশন কী, সেটিও গুরুত্বপূর্ণ।

একটি রাষ্ট্র যত বেশি শক্তিশালী হয়, তার দায়িত্বও তত বেশি হয়ে থাকে। সেই বিবেচনায় এই অঞ্চলে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে ভারতকেই বড় আকারে এগিয়ে আসতে হবে। আঞ্চলিক সম্প্রীতি না থাকলে আঞ্চলিক সমৃদ্ধি আসা সম্ভব না। সে কারণে ভারতকে সবচেয়ে বড় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে উদ্যোগের আগে তেমনভাবে সফলতা পায়নি এবং এর একটি অন্যতম বড় কারণ হচ্ছে এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সম্প্রীতি কম। সেটিকে কাটিয়ে উঠে যদি সম্প্রীতি বাড়ানো যায় এবং দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি করা যায় তবে আঞ্চলিক সমৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। এক্ষেত্রে ভারতকেই সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আসতে হবে। 

লেখক: বিশেষ প্রতিনিধি, বাংলা ট্রিবিউন

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকি ‘স্পষ্ট ও বাস্তব’, পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর হুঁশিয়ারি
পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকি ‘স্পষ্ট ও বাস্তব’, পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর হুঁশিয়ারি
মহানির্বাণ
মহানির্বাণ
ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে কাঁপছে দক্ষিণ এশিয়া, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে শঙ্কার মেঘ
ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে কাঁপছে দক্ষিণ এশিয়া, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে শঙ্কার মেঘ
কক্সবাজার পৌর এলাকা থেকে দৈনিক ৩৪ টন প্লাস্টিক বর্জ্য সাগরে পড়ছে
কক্সবাজার পৌর এলাকা থেকে দৈনিক ৩৪ টন প্লাস্টিক বর্জ্য সাগরে পড়ছে
সর্বশেষসর্বাধিক