X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

রমজানে স্বস্তি-অস্বস্তি

প্রভাষ আমিন
১৮ মার্চ ২০২৩, ১৮:৩৪আপডেট : ১৮ মার্চ ২০২৩, ১৮:৩৪

ব্যবসার একদম সহজ একটা হিসাব আছে। ব্যবসায়ী যে দামে কিনবেন, তারচেয়ে কিছুটা বেশি দামে বিক্রি করবেন। তবে সেই বেশি কতটা বেশি, তার একটা ন্যায্য সীমা আছে। সেই সীমাটা ছাড়িয়ে গেলে ব্যবসা আর ব্যবসা থাকে না, ডাকাতি হয়ে যায়। লাভ আর লোভের ফারাকটা ঘুচে গেলেই মহৎ পেশা ব্যবসা হয়ে যায় নিকৃষ্টতর। অর্থনীতির আরেকটা অতি সরল নিয়ম আছে- চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কমে গেলে নির্দিষ্ট সেই পণ্যের দাম বেড়ে যায়। লাভের আরেকটা হিসাব আছে, কোনও পণ্যের চাহিদা যদি বেশি থাকে, মানে যদি বেশি বিক্রি হয়, তাহলে লাভের পরিমাণ কিছুটা কমালেও আখেরে লাভ বেশি হয়। তাতে অর্থনীতিতে টাকার প্রবাহ বাড়ে। আর কে না জানে, টাকার যত হাতবদল, ততই লাভ। প্রতিবারই আসলে কিছু না কিছু মূল্য সংযোজন হয়।

কিন্তু বাংলাদেশে আসলে ব্যবসার কোনও নিয়মকানুনই মানা হয় না। এখানে ব্যবসা মানেই যেন ডাকাতি, ব্যবসা মানেই যেন সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে বাড়তি মুনাফা আদায়। বিদেশে দেখেছি, বড় কোনও উৎসবের সময় বিশাল ডিসকাউন্ট দেওয়া হয়। মানুষ সারা বছর অপেক্ষা করে সেই ডিসকাউন্টের জন্য। আর ডিসকাউন্টের সময় প্রচুর বিক্রি হয়। তাতে লাভের পরিমাণ একটু কম হলেও ব্যবসায়ী একসঙ্গে অনেক অর্থ পেয়ে যান। ভবিষ্যতের জন্য বড় পরিকল্পনা করতে পারেন। রমজানকে সামনে রেখে বিশ্বের অনেক দেশেই বড় ছাড়ের নিউজ পড়ছি পত্রিকায়। আর আফসোস করছি, আমাদের ব্যবসায়ীরা কি এইসব নিউজ দেখেন না, নাকি বড় ছাড়ে বিশাল বিক্রির লাভের অঙ্কটা বোঝেন না। বাংলাদেশে হয় উল্টো ঘটনা। বড় কোনও উৎসব এলেই হু হু করে দাম বাড়তে থাকে। ব্যবসায়ীরা সারা বছরের লাভ একবারে করে ফেলতে চান। এটা অনৈতিক, এটা অন্যায়; এটা ব্যবসা নয়, প্রতারণা।

বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরাও যে ডিসকাউন্ট দেন না, তা নয়। কিন্তু সেই ডিসকাউন্টে থাকে শুভঙ্করের ফাঁকি। ডিসকাউন্ট দেওয়ার কয়েক মাস আগে একবার দাম বাড়িয়ে নেওয়া হয়। তারপর ডিসকাউন্ট দিয়েও আগের দামের চেয়ে বেশি দামেই বিক্রি করেন পণ্য। যারা নিয়মিত কোনও নির্দিষ্ট পণ্যের দাম ফলো করেন, তারা এই ফাঁকিটুকু ধরতে পারেন। অনেকেই পারেন না। তাই ডিসকাউন্টের নামে বাড়তি দামে পণ্য কিনতে হয় তাদের। বাংলাদেশে সত্যি সত্যি সস্তার তিন অবস্থা। কোথাও ডিসকাউন্ট দেখলেই আমার সন্দেহ হয়। অনেক জায়গায় মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ার আগে স্টক খালি করতে ডিসকাউন্ট দেওয়া হয়। তার মানে ডিসকাউন্টের পণ্য কিনলে আপনাকে হয় দামে নয় মানে ঠকতে হবে। বাংলাদেশে ব্যবসায়ীরাই শুধু জিতবেন। সাধারণ ক্রেতাদের জেতার কোনও সুযোগ নেই।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যখন রমজান উপলক্ষে বিশাল ছাড়ের উৎসব চলছে, বাংলাদেশে তখন রমজানকে সামনে রেখে সাধারণ মানুষের মনে শঙ্কার কালো ছায়া। রমজান এলে বাংলাদেশে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ে, এটা প্রায় স্বতঃসিদ্ধ, সবাই যেন মেনেই নিয়েছেন এটা। তবে এবারের সমস্যাটা ভিন্ন। রমজান আসার অনেক আগেই দ্রব্যমূল্য আকাশে উঠে বসে আছে। এখন রমজানের সময় দাম কমলেও তা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরেই থাকবে। তারচেয়ে বড় কথা হলো, রমজান উপলক্ষে কোনোকিছুর দাম কমবে, তেমন কোনও লক্ষণ নেই। সাধারণ মানুষের মনে তাই রমজান নিয়ে প্রবল শঙ্কা।

সমস্যাটা শুরু হয়েছে করোনার সময় থেকেই। তখন থেকেই অর্থনীতির ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি হয়। তখন অনেকে বেকার হয়েছেন, অনেকের আয় কমে গেছে, অনেকের ব্যবসায় ধ্বস নেমেছে। আয় কমে যখন ব্যয় বাড়ে; তখন তা সামলানোর সামর্থ্য সবার থাকে না। করোনার ধাক্কা সামলানোর আগে ইউক্রেন যুদ্ধ। আর এই যুদ্ধ শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো বিশ্বের অর্থনীতির ওপরই প্রবলতর চাপ সৃষ্টি করেছে। অর্থনীতিতে বিশ্বমন্দার ঢেউ লেগেছে বাংলাদেশে। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় বেড়ে গেছে আমদানি পণ্যের দামও। সঙ্গে জ্বালানি তেল আর বিদ্যুতের দাম বাড়ার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের নিত্যপণ্যের বাজারেও। ফলে মানুষের এখন দিশেহারা অবস্থা। এটা ঠিক করোনার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনীতি দারুণ গতিতে এগোচ্ছিল। বাংলাদেশের জিডিপি বেড়েছে, মাথাপিছু আয় বেড়েছে। মঙ্গা অনেক আগেই অতীত হয়ে গেছে। না খেয়ে মানুষ মারা যাবে, এমন অবস্থা বাংলাদেশ অনেক আগেই পেছনে ফেলে এসেছে। আশা করি ভবিষ্যতেও আমাদের আর মঙ্গা বা দুর্ভিক্ষ নিয়ে কথা বলতে হবে না। কিন্তু প্রাথমিক চাহিদা মিটলে মানুষ গুণগত মানের দিকে নজর দেয়। তাই পেট ভরার পর মানুষ পুষ্টি, সুষম খাবারের কথা ভাবার সুযোগ পাচ্ছিল। কিন্তু করোনা, যুদ্ধ, সরকারের অদক্ষতা আর ব্যবসায়ীদের অসততায় টান পড়েছে মানুষের পুষ্টি ভাবনায়। মানুষের মনে এখন ভাবনা, দু বেলা দু মুঠো ভাত। নির্দিষ্ট আয়ের মানুষদের খরচেরও নির্দিষ্ট খাত থাকে। তবে বাসা ভাড়া, সন্তানের পড়াশোনা, চিকিৎসা ব্যয়সহ কিছু খরচ আছে; যা নির্দিষ্ট, হুট করে কমানো যায় না। তাই খরচ কমানোর প্রথম ধাক্কাটা আসে বাজারে, কোয়ালিটির সঙ্গে আপস করতে হয়। সন্তানের মুখে দুধ-ডিম-মাংস তুলে দেওয়া এখন বিলাসিতা। ফার্মের মুরগি আর ডিম ছিল মধ্যবিত্তের সস্তা প্রোটিনের বড় উৎস। এখন সেটাও নাগালের বাইরে গিয়ে ডানা ঝাপটাচ্ছে উড়াল দেওয়ার। বাংলাদেশের মানুষও এখন ২৫০ গ্রাম মাংস কেনায় অভ্যস্ত হচ্ছে। দাম, বাড়লে সাধারণ মানুষের সমস্যা হয়। আবার কমে গেলে উৎপাদকরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হোক, এটা আমরা কেউই চাই না। কিন্তু সবকিছু তো হতে হবে ন্যায্যতার ভিত্তিতে। মুরগি বা ডিম উৎপাদনে কত খরচ, সেটা বের করা তো কঠিন কিছু নয়। সেটা বের করে, তার সঙ্গে যৌক্তিক লাভ যুক্ত করে বিক্রয়মূল্য ঠিক করে দিলেই হয়। তাহলেই তো আর ব্যবসায়ীরা মানুষকে জিম্মি করে ইচ্ছামত দাম বাড়াতে পারবে না। পোল্ট্রি ব্যবসায়ীরা বলছেন, রমজানে তারা ন্যায্যমূল্যে মাংস বিক্রি করবেন। তার মানে এতদিন তারা অন্যায্য মূল্যে মাংস বিক্রি করেছেন। আর রমজানে যে তারা ন্যায্যমূল্যে মাংস বিক্রি করবেন, সেই ন্যায্যমূল্যটা নির্ধারণ করবে কে?

বলছিলাম রমজানের কথা। পাঁচ দিন পর শুরু হচ্ছে পবিত্র মাহে রমজান। ইসলামের পাঁচ ফরজের একটি রমজান নিয়ে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের নানারকম প্রস্তুতি থাকে। কিন্তু বাজারের যে অবস্থা, তাতে ধর্মকর্মের চেয়ে জিনিসপত্রের দাম নিয়ে মানুষকে বেশি ভাবতে হচ্ছে। এটা ঠিক, রমজান হলো সংযমের মাস। কিন্তু সংযমের মাস রমজানেই আমরা অসংযমী ও খাওয়ার ব্যাপারে বেপরোয়া হয়ে যাই যেন। রমজানে খাওয়ার পেছনে খরচ কমে তো নাইই, উল্টো বেড়ে যায়। সাধারণ সময়ের চাহিদা তো আছেই, রমজানে ছোলা, চিনি, খেজুরের মতো বিশেষ কিছু পণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়। চাহিদা যে বাড়বে, এটা সবাই জানে। কিন্তু চাহিদার সঙ্গে সঙ্গে যাতে সরবরাহও বাড়ে সে ব্যবস্থা করার দায়িত্ব সরকারের। শুল্ক ব্যবস্থা পুনর্বিন্যাস করে তারা রমজানের বিশেষ বিশেষ পণ্যের দাম  নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করতে পারতেন। এখন শেষ মুহূর্তে এসে সবাই রমজানে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে নানা চেষ্টা করছেন, বৈঠক করছেন, ব্যবসায়ীদের হুমকি দিচ্ছেন। কিন্তু এখন করে তো আর কোনও লাভ নেই। যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন লোক দেখানোর জন্য হম্বিতম্বি করা যাবে, কিন্তু দাম আর কমানো যাবে না। এখনও শুনছি ছোলার পর্যাপ্ত আমদানি হয়নি। তার মানে এবার ইফাতারিতে ছোলা না রাখলেই ভালো। বাংলাদেশের বেশিরভাগ ব্যবসায়ীই মুসলমান। তারা যে রমজান মাসে রোজাদারদের কাছ থেকে বেশি দাম নেন, তাদের কি খারাপ লাগে না।

রমজান এলেই বদলে যায় বাংলাদেশ। অন্যরকম এক ভাবগাম্ভীর্যের পরিবেশ সৃষ্টি হয়। রমজানে মুসলমানরা সৃষ্টিকর্তার কৃপার আশায় সংযম পালন করেন, ইবাদত-বন্দেগি করেন। এই মাসটা তারা স্বস্তিতে যাপন করতে চান। নিত্যপণ্যের চড়া মূল্যের অস্বস্তি যেন রমজানের স্বস্তিটুকু কেড়ে না নেয়।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

/আরআইজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ