ক্ষমতায় থাকাকালীন মন্ত্রী বা উপদেষ্টা পদমর্যাদার কোনও ব্যক্তির পরিচালনায় মুক্তি পাওয়া প্রথম ছবি ‘৮৪০’। ‘শনিবার বিকেল’ মুক্তি না পাওয়ার নির্মাতার ছবি ‘৮৪০’। ছবি নির্মাণের শুরু ও মুক্তি পাওয়ার সময়কে নিয়ে প্রশ্ন তোলা এক ছবি ‘৮৪০’। ‘ব্যাচেলর’ (২০০৪), ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ (২০০৭), ‘থার্ড পার্সন সিঙ্গুলার নম্বর’ (২০০৯), ‘টেলিভিশন’ (২০১২), ‘পিঁপড়াবিদ্যা’ (২০১৩), ‘ডুবোশহর’ (২০১৪) ‘ডুব’ (২০১৭)-এর পর সিনেমা হলে মুক্তি পাওয়া মোস্তফা সরয়ার ফারুকী পরিচালিত নতুন ছবি ‘৮৪০’। যদিও ওটিটি প্লাটফর্মে ফারুকীর ‘সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’ (২০২৩) এবং ‘লাস্ট ডিফেন্ডারস অব মনোগামী’ (২০২৪) মুক্তি পেয়েছিল। রাজনৈতিক বিবেচনা কিংবা বাস্তবতায় ‘শনিবার বিকেল’ মুক্তি না পেলেও আলোচনার জন্ম দিয়ে মুক্তি পাওয়া এক ছবি ‘৮৪০’।
রাজনৈতিক বাস্তবতায় অনেক কিছুই মানুষের ঘাড়ে চেপে বসেছে বিধায় ২০০৭ সালে (তত্ত্বাবধায়ক আমলে) ফারুকী নির্মিত টিভি ধারাবাহিক ‘৪২০’-এর পর ২০২৪ সালের এই ছবির নাম ৪২০ এর দ্বিগুণ ‘৮৪০’ (এটাও মুক্তি পেল অন্তর্বতীকালীন সরকারের সময়)। জায়গার নাম ফুলমনিরহাট। বাংলাদেশে এই নামে কোনও জায়গা আছে কী নেই সেটা মাথায় আসবে না ফুলমনিরহাটের মেয়রের কারণে। নাম তার ডাবলু। ভোট চুরি করা থেকে শুরু করে এমন কোনও বদকাজ নেই যা সে করে না। সে অবলীলায় মানুষ খুন করে আবার খুন হওয়া মানুষের কফিন ধরে কাঁদে। বিস্কুট ফ্যাক্টরি দখল করে, টেলিফোনে আড়ি পাতে, কার কী পরিকল্পনা সেটা জেনে যায় আগে ভাগে। এমন কী নতুন এক রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর রোমান্টিক সময়ে গোপন ক্যামেরায় সব ধারণ করে তাকে ব্ল্যাকমেইল করে। একই উপায়ে ব্ল্যাকমেইল করা হয় শিক্ষক কাম এক বুদ্ধিজীবীকে। একই সাথে সে তার অনুগতদের মধ্যে বিভাজন ও শত্রুতা জিইয়ে রাখে। শেষমেশ নতুন জেলা প্রশাসক আসলেও তাকে দলে টানার চেষ্টা করে ডাবলু। নিজের মৃত্যুর গুজব ছড়ানো, গুলি খেয়ে আহত হওয়া কোনও কিছুতেই শেষরক্ষা হয় না তার। শেষমেশ দুবাই পালিয়ে যায়।
মেয়র ডাবলুর চরিত্রে দারুণ অভিনয় করেছেন নাসির উদ্দীন খান। এই প্রথম ফারুকীর কোনও ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি। এছাড়া শিক্ষক কাম বুদ্ধিজীবীর চরিত্রে ফজলুর রহমান বাবু, মেয়রের স্ত্রীর চরিত্রে বিজরী বরকতুল্লাহ, প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর চরিত্রে নাদের চৌধুরী, সোনা কাশেমের চরিত্রে শাহরিয়ার নাজিম জয়, প্রধান সাগরেদ জাকিরের চরিত্রে মারজুক রাসেল, ডিসির চরিত্রে জাকিয়া বারী মম এবং তার স্বামীর চরিত্রে জায়েদ খান অভিনয় করেছেন। এছাড়া আশুতোষ সুজন ও মুকিত জাকারিয়াসহ আরও অনেকেই অভিনয় করেছেন এই ছবিতে।
পরিচালনার পাশাপাশি ছবির চিত্রনাট্য লিখেছেন মোস্তফা সরয়ার ফারুকী নিজেই, চিত্রগ্রহণে ছিলেন রাজিবুল ইসলাম। ছবির সংগীত পরিচালক ছিলেন পাভেল আরীন এবং সম্পাদনা করেছেন তাহসিন মাহিম। এই ছবির শুটিং শুরু হয়েছিল ২০২৩ এর নভেম্বরে, কাজ শেষ হয় ফেব্রুয়ারিতে। ‘৮৪০’ ছবির প্রযোজক অভিনেত্রী নুসরাত ইমরোজ তিশা এবং ইমপ্রেস টেলিফিল্ম। ছবির শুটিং হয়েছে নওগাঁ, ঢাকার দিয়াবাড়ি, চট্টগ্রামের ফয়েজ লেক ও দুবাইতে।
এই ছবির সবচেয়ে ভালো দিক এর স্যাটায়ার। যেমন গুলি ফোটার শব্দ শুনে ফজলুর রহমান বাবু টেবিলের নীচে যেয়ে লুকান। এরপর বাবু নিজেই জানান টেবিলের নীচে থাকাকালীন একটা কবিতার লাইন মনে এসেছে। ‘গদি’ শিরোনামের এই কবিতার লাইনটা এমন- ঘোড়া চড়া শেখালে যদি নামা কেন শেখালে না? এদেশে ক্ষমতার ঘোড়ায় যারা চড়েন তারা নামতে চান না কিংবা সুন্দরভাবে নামাটা শিখে আসেন না।
আবার একান্ত মুহূর্তের ছবি দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী একজনকে ব্ল্যাকমেইল করার পর ডাবলু বলে- আগের চরিত্রেই থাকো। আমার নামে যতখুশি বদনাম গাও। বিভিন্ন জনের সাথে মেশো। আমি বুঝতে পারবো কার মনে কী আছে!
রাজনীতির কিছু কিছু জিনিস খুব স্পষ্ট এই ছবিতে। যেমন মরিচতত্ত্ব। জাকিরকে সরিয়ে সোনা কাশেমকে কেন ভালোবাসতে যাচ্ছে ডাবলু? স্ত্রীর এই প্রশ্নের উত্তরে সে বলে, আমার খেলা তুমি বুঝবা না.. এখনই সময় বাইরে আমার সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করার। জাকিরের জায়গায় সোনা কাশেমরে বসাইছি তাই জাকিরের জ্বলতাছে। এরপর সোনা কাশেমের জায়গায় রুপা কাশেম তামা কাশেমরে বসামু। তখন আবার সোনা কাশেমের ড্যাস ড্যাস জ্বলবো। এইটা হইলো রাজনীতির মরিচতত্ত্ব!
ছবিতে আছে নতুন কারও আগমনে তাকে অপমান করার জন্য লুঙ্গি খোলা নীতি। আছে বিদেশে পালিয়ে যাবার পর করুন অবস্থার মুখোমুখি হবার দৃশ্য। যে পোষাকে মেয়রগিরি করতো ডাবলু সেটা টাঙিয়ে রেখে তার সামনে বাসার কাজ করা কিংবা টেলিফোন করে বলা যে, ‘আমি টুস করে চলে আসবো’। এসবই সময়ের আলোচিত ঘটনা।
‘৮৪০’কে রহস্যময় বলা হয়েছে এই কারণে যে, ছবির শুটিং শুরু ও শেষ হয়েছিল হাসিনা সরকারের আমলে। মুক্তি দেয়া হয়েছে শেখ হাসিনার পতনের পর। জুলাই বিপ্লবে বিদেশি মিডিয়ার খবর ও ফুটেজ দিয়ে ছবিটা শুরু করা হয়েছে। ছবির শুরুতে বলা হয়েছে এটা শেখ হাসিনার শাসনকালের এক্সরে রিপোর্ট। পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘শনিবার বিকেল’-এর অভিজ্ঞতা একেবারেই সুখকর নয়। তাই এই রাজনৈতিক স্যাটায়ার নির্মাণ সম্পর্কে তিনিই ভালো বলতে পারবেন।
জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ এখনও আলোচিত এক ছবি। শাড়ির সাধে বাঁধা চাবির গোছার প্রতীকে পাকিস্তানি শাসনের বিপরীতে স্বাধীনতার আন্দোলনে উজ্জীবিত বাঙালির এক প্রাণের ছবি সেটি। ‘৮৪০’ মজাদার রাজনৈতিক স্যাটায়ার হলেও কালজয়ী হয় কি না সময় তা বলে দেবে। ৮৪০: রেটিং ৭/১০
চিত্রনাট্য ও পরিচালনা: মোস্তফা সরয়ার ফারুকী
চিত্রগ্রহণ: রাজিবুল ইসলাম
সংগীত পরিচালক: পাভেল আরীন
সম্পাদনা: তাহসিন মাহিম
প্রযোজক: নুসরাত ইমরোজ তিশা এবং ইমপ্রেস টেলিফিল্ম
মুক্তি: ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৪
সমালোচক: রম্যলেখক, সাংবাদিক ও কবি
*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।
আরও সমালোচনা:
দরদ: দরদহীন নির্মাণের এক প্রশ্নবিদ্ধ ছবি!
৩৬-২৪-৩৬: সিনেমার পর্দায় ‘ওটিটি কনটেন্ট’
তুফান: সন্ত্রাসকে গ্ল্যামারাইজ করতে চাওয়া এক ছবি
ফাতিমা: সাধারণ এক নারীর ‘অসাধারণ’ সংগ্রামের ছবি
দেয়ালের দেশ: মন খারাপ করা সিনেমা
রাজকুমার: ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ এক বিয়োগান্তক ছবি
কাজলরেখা: ঘোড়া, গরু, হাতিগুলো স্বাস্থ্যবান নয়
হুব্বা: সামথিং লাইক আ ক্রিমিনাল’স অটোবায়োগ্রাফি!
খুফিয়া: বাংলাদেশ নিয়ে ‘শঙ্কা ও ভাবনার’ ভারতীয় ছবি!
অন্তর্জাল: সাইবার থ্রিলার নিয়ে স্মার্ট ছবি
এমআর-৯: ‘মাসুদ রানা’ আছে ‘মাসুদ রানা’ নেই!
১৯৭১ সেই সব দিন: ৫৩ বছর আগের বাস্তবতা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা
আম কাঁঠালের ছুটি: দুরন্ত শৈশব মনে করিয়ে দেয়া এক ছবি
প্রিয়তমা: পরিচিত গল্প আর ‘তাড়াহুড়ো’য় নির্মিত ছবি!
প্রহেলিকা: ছবিটি দেখলে কিছু প্রশ্ন উঠবেই
‘পরাণ’-এর আরেক ভার্সন ‘সুড়ঙ্গ’!
সুলতানপুর: ফর্মুলায় আক্রান্ত ধারাবাহিকতাহীন ছবি
আদিম: ‘বস্তি ঘনিষ্ঠ’ এক অপরূপ ছবি!
পাপ: শেষ না হওয়া এক থ্রিলার গল্পের ছবি
কিল হিম: বড়শি দিয়ে মাছ ধরেন অনন্ত, কিন্তু সেটা নড়ে না!
লিডার: স্বস্তি আর অস্বস্তির পাঁচ-ছয়
লোকাল: রাজনীতির ব্যানারে প্রেম ও প্রতিশোধের ছবি!
জ্বীন: ‘জিন ছাড়ানো’র কুসংস্কারাচ্ছন্ন ছবি!