দক্ষিণ-পশ্চিম ইউক্রেনের সঙ্গে রোমানিয়াকে সংযোগ করা একটি সেতু ধ্বংস করতে বেশ কয়েকটি ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করতে হয়েছে রাশিয়াকে। এই সেতুটি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধক্ষেত্রে থেকে কয়েকশ’ কিলোমিটার দূরে। সোমবার ক্ষেপণাস্ত্রগুলো বিলহরোদ-দিনিস্ত্রোভস্কি এলাকায় দিনিয়েস্টার নদীর সেতুটিতে আঘাত করে। যা কিয়েভ থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে প্রায় ৪৫০ কিলোমিটার দূরে।
যুদ্ধের খবরে সম্প্রতি অঞ্চলটি অনুপস্থিত থাকলেও অবস্থানগত কারণে রাশিয়ার নতুন যুদ্ধ কৌশলে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
কিয়েভ ও উত্তরাঞ্চল দখলে ব্যর্থ রুশ সেনারা এখন দুটি বিচ্ছিন্নতাবাদী অঞ্চলে মনোযোগ দিয়েছে। যা ইউক্রেনের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত। তারা চাইছে সংখ্যাগরিষ্ঠ রুশ ভাষাভাষী অঞ্চলটির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিতে। তাদের দাবি, এসব মানুষের রাশিয়ার সুরক্ষা প্রয়োজন।
২২ এপ্রিল রাশিয়ার এক শীর্ষ জেনারেল বলেছেন, মস্কো চায় তাদের সেনারা মলদোবার বিচ্ছিন্নতাবাদী অঞ্চল ট্রান্সনিস্ট্রিয়া পৌঁছাতে। এলাকাটির অবস্থান ইউক্রেনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় ওডেসা অঞ্চলের সীমান্তবর্তী।
রুশ মেজর জেনারেল রুস্তম মিনেকায়েভ বলেছেন, এই অঞ্চলটির নিয়ন্ত্রণ নিলে ক্রিমিয়া পর্যন্ত স্থল করিডোর স্থাপন করা যাবে এবং ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ স্থান এবং কৃষ্ণ সাগর বন্দর পর্যন্ত প্রভাব থাকবে। বন্দরটি ইউক্রেনের কৃষি, ধাতু রফতানির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
প্যারাট্রুপারদের অবতরণ?
ধ্বংস করা সেতুর আশেপাশে সুরক্ষা দেয়াল তৈরি করেছিলেন রোমান সম্রাট ট্রাজান। এছাড়া বিধ্বস্ত দুর্গগুলো তৈরি করেছে মঙ্গল, অটোমান ও নাৎসি জার্মানরা।
এই সেতু ধ্বংস করা ট্রান্সনিস্ট্রিয়াতে রাশিয়ার প্যারাট্রুপারদের অবতরণের ঘোষণা হতে পারে। ট্রান্সনিস্ট্রিয়া উত্তরে অবস্থিত। দীর্ঘদিন ধরে ইউক্রেনীয় কর্মকর্তা ও বিশ্লেষকরা অঞ্চলটিকে রুশ আক্রমণের সম্ভাব্য জায়গা হিসেবে বিবেচনা করে আসছিলেন।
ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির এক উপদেষ্টা ওলেকসি আরেস্টোভিজ সোমবার টেলিভিশনে প্রচারিত এক বক্তব্যে বলেছেন, মস্কো এই সেতু ধ্বংস করেছে, যাতে তারা সেখানে প্যারাট্রুপার অভিযান পরিচালনা করতে পারে।
ইউক্রেনীয় এক বিশ্লেষক এটিকে রাশিয়ার প্রকৃত কৌশলগত লক্ষ্যের উন্মোচনের ঘোষণা হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
‘বিচ্ছিন্ন ভাষা’
কিয়েভভিত্তিক বিশ্লেষক আলেকসি কুশচ বলছেন, ‘স্থল সংযোগ’ গড়ে তোলার পাশাপাশি মস্কো চায় কৃষ্ণ সাগর থেকে পুরো ইউক্রেনকে বিচ্ছিন্ন এবং সম্ভাব্য রুশপন্থী সহযোগিতাকারীদের সমাবেশিত করতে। তিনি বলেন, তবে লক্ষ্যের এই গুরুত্বারোপ যারা কিয়েভের প্রতি অনুগত সেই স্থানীয় জনগণের ওপর কোনও প্রভাব ফেলেনি।
ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলে বহু ভাষাভাষী মানুষের বসবাস। এখানে রয়েছেন ইহুদি, গ্রিক, বুলগেরীয়, গাগাউজ ও রোমানিয়ার অভিবাসীরা, যারা রুশ ভাষায় কথা বলতে পছন্দ করে। বিশ্লেষকরা বলছেন, কিন্তু তাদের ভাষাগত পছন্দকে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের প্রতি সমর্থন হিসেবে বলা যায় না।
মানবাধিকার সংস্থা নরওয়েজিয়ান হেলসিঙ্কি কমিটি’র সিনিয়র পলিসি উপদেষ্টা ইভার ড্যাল বলেন, এই ভাষা মস্কো থেকে বিচ্ছিন্ন এবং ক্রেমলিনের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। পুতিনের বিরুদ্ধে বেশিরভাগ মানুষের সমালোচনা রুশ ভাষায়।
ইউক্রেনের এক সামরিক বিশ্লেষক মনে করেন, এমনকি ট্রান্সনিস্ট্রিয়াতে রুশ প্যারাট্রুপাররা অবতরণ করলেও তা ক্রেমলিনের সামরিক ভাগ্যে বড় কোনও পরিবর্তন আনবে না। ইউক্রেনের সাবেক সেনাপ্রধান ও বর্তমানে জেলেনস্কির উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্বরত আনাতোলি লোপাটা নামের এই বিশ্লেষক বলেন, তারা কোনও কিছুতে সফল হবে না। তাদের পরাজয় মেনে ফিরে যেতে হবে।
তিনি বলেছেন, রাশিয়া সেনা সদস্য, সামরিক সরঞ্জাম ও গোলাবারুদের ঘাটতিতে রয়েছে। আর ইউক্রেন পশ্চিমাদের কাছ থেকে সামরিক, আর্থিক ও কূটনৈতিক সহযোগিতা অব্যাহতভাবে পাচ্ছে।
মাইকোলাইভ ও ওডেসা
মার্চের শুরুতে ক্রিমিয়ার সীমান্তবর্তী দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজধানী খেরসন শহর ‘পূর্ণ দখল’ করার দাবি করেছিল। কিন্তু মাইকোলাইভ ও ওডেসা, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় অঞ্চল দুটি ট্রান্সনিস্ট্রিয়া যাওয়ার পথে থাকা শহর দুটি এখন পর্যন্ত রাশিয়া কম সফল হয়েছে।
মস্কোর সেনারা চরনোবাইভকাতে অবতরণ করেন। মাইকোলাইভ পৌঁছানোর একমাত্র পথে খেরসনের পশ্চিমে এখানেই বাধার মুখে পড়ে রুশ সেনারা। এই প্রতিরোধ ভাঙতে ১৭ বার চেষ্টা করে তারা। কিন্তু প্রতিবার ইউক্রেনের ড্রোন ও ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র অবতরণ করা সেনাদের নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। যা কৌতুক ও মিমের রসদ হয়েছে।
মাইকোলাইভে অসংখ্য ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে রাশিয়া। শহরটি জাহাজ নির্মাণের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। কিন্তু প্রাদেশিক রাজধানীর প্রশাসনিক ভবনে প্রবেশ করতে পারেনি।
এই সপ্তাহে, মাইকোলাইভ ও খেরসনের মধ্যবর্তী অঞ্চলে বড় পরাজয়ের মুখে পড়েছে এবং পাঁচটি শহর ছেড়ে চলে এসেছে।
রুশ যুদ্ধ জাহাজ ওডেসা উপকূল অবরোধ করে রেখেছে। কিন্তু পদাতিক সেনাদের সহযোগিতা ছাড়া প্যারাট্রুপারদের অবতরণের চেষ্টা ব্যর্থতায় পরিণত হচ্ছে।
‘অ্যাপেন্ডিসাইটিসের মতো অবরুদ্ধ’
লক্ষ্যে আঘাত হানতে নিপুণ পশ্চিমাদের ক্ষেপণাস্ত্র ইউক্রেনে আসার পর ইউক্রেনে রুশ সামরিক স্থাপনা ঝুঁকির মুখে রয়েছে।
রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদী অঞ্চল ডনেস্কর সাবেক ‘প্রতিরক্ষামন্ত্রী’ ইগোর স্ট্রেলকভ ১২ এপ্রিল একটি রুশ সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, যদি ওডেসা অঞ্চল দখল করা না যায় তাহলে ইউক্রেনীয়রা পুরো কৃষ্ণ ও আজভ সাগর ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে সুরক্ষিত রাখতে পারবে।
তিনি আরও বলেন, “ওডেসাকে ‘মুক্ত’ করা ছাড়া ক্রিমিয়াকে সুরক্ষিত রাখা অসম্ভব।”
রুশ সামরিক বিশ্লেষকরা স্বীকার করছেন, ক্রমবর্ধমানভাবে সুরক্ষিত অঞ্চলটি দখল করা কঠিন এবং এটিকে অস্ত্রোপচারের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
অবসরপ্রাপ্ত রুশ জেনারেল ভ্লাদিমির শামানোভ ২০ এপ্রিল বরেছেন, ওডেসা অ্যাপেন্ডিসাইটিসের মতো অবরুদ্ধ। কিন্তু আমি মনে করি আমরা আমাদের সুযোগ পাবো।
ওডেসা শহর যুদ্ধের বিশেষ অর্জন হিসেবে হাজির হচ্ছে। এটি ছিল জার আমলে রাশিয়ার বৃহত্তম সমুদ্র বন্দর এবং গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। যেটিকে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ওরলিন্স বা লেবাননের বৈরুতের সঙ্গে তুলনা করা যায়।
শহরটি কয়েক প্রজন্ম ধরে সংগীতজ্ঞ, লেখক, রম্যবিদের জন্ম দিয়েছে। যারা সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে সুপরিচিত ছিলেন তাদের কাজের জন্য। সেখানকার অনেকেই পুতিনের পরিকল্পনাকে হাস্যরসের মাধ্যমে উপহাস করছেন।
ইউক্রেনের এক সেনা সদস্য বলেন, তিনি (পুতিন) নিজের চোখের জল ও শ্লেষা গিলতে গিলতে ক্লান্ত হয়ে পড়বেন।
আল-জাজিরা অবলম্বনে।