X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ও তৃতীয় ঢেউয়ের আশংকা

মোহাম্মদ রুবায়েত হাসান
১৮ জুন ২০২১, ১৬:২৩আপডেট : ১৮ জুন ২০২১, ১৬:২৩

মোহাম্মদ রুবায়েত হাসান মে মাসের শুরুর দিকে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ তিন অঙ্কে নেমে এলেও স্বস্তির তেমন কোনও  অবকাশ ছিল না। কারণ, প্রতিবেশী দেশ ভারতে ভয়াবহ সংক্রমণের প্রভাব যে বাংলাদেশেও পড়বে তা একরকম অবধারিতই ছিল। বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ইন্ডিয়ান ভ্যারিয়েন্ট B.1.617.2 বা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট শনাক্তও হয় সে সময়, কিন্তু এর বিস্তৃতি কতটুকু এ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনও ধারণা ছিল না। সম্প্রতি আইইডিসিআর এবং আইদেশির যৌথ উদ্যোগে করা জেনোমিক সার্ভেইল্যান্স-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, করোনাভাইরাস আক্রান্ত শতকরা আশিভাগ লোকের মধ্যেই পাওয়া গেছে এই ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। যদিও খুব অল্প সংখক নমুনার ওপর জরিপ করে এই তথ্য পাওয়া গেছে , এ থেকে বাংলাদেশে এ সময়ে সার্কুলেটিং ভ্যারিয়েন্টগুলো সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যাচ্ছে। আবার যেসব মানুষের মধ্যে এই ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে তাদের অনেকেরই দেশের বাইরে ভ্রমণ করার বা প্রবাস ফেরত কারও সংস্পর্শে আসার কোনও ইতিহাস নেই। এর মানে হলো কমিউনিটিতে এরমধ্যে বেশ অনেকটাই ছড়িয়েছে এই ভ্যারিয়েন্ট। পাশাপাশি, সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে উদ্বেগজনক হারে সংক্রমণ বৃদ্ধি ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের কারণে বাংলাদেশে করোনাভাইরাস মহামারির তৃতীয় ঢেউয়ের সুস্পষ্ট আভাস দিচ্ছে।

ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট হলো গত কয়েক মাসে, ভারতে উদ্ভূত ভ্যারিয়েন্টগুলোর একটি। অন্য ভ্যারিয়েন্টগুলোর তুলনায় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট বেশি সংক্রামক এবং এই ভ্যারিয়েন্টই ভারতের বিশালাকৃতির দ্বিতীয় ঢেউয়ের জন্য বেশি দায়ী বলে ধরা হয়। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ইতোমধ্যে ভারতের বাইরেও প্রায় ৬২টি দেশে ছড়িয়েছে। যুক্তরাজ্যে এ সময় তুলনামূলক বিচারে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণের হারই সবচেয়ে বেশি, যার কারণে দৈনিক মোট আক্রান্তের সংখ্যা আগের চেয়ে অনেক কম হলেও, এই ভ্যারিয়েন্টের কারণে নতুন ঢেউয়ের আশঙ্কা করা হচ্ছে।
অন্যান্য ভ্যারিয়েন্টের সঙ্গে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের পার্থক্য কী? পার্থক্য হলো স্পাইক প্রোটিনে। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট এ N501Y বা E484K মিউটেশন নেই যেসব মিউটেশনের কারণে সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট এবং ব্রাজিলিয়ান ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ব্যাহত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হয়েছিল। তাহলে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা কেমন হতে পারে, এনিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে অন্যান্য মিউটেশনের পাশাপাশি রয়েছে L452R এবং P681R মিউটেশন।  L452R ইতোপূর্বে ডেনমার্কের মিংক ভ্যারিয়েন্ট এবং ক্যালিফোর্নিয়ার ভ্যারিয়েন্টে পাওয়া গেছে। ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে দেখা তথ্যের ভিত্তিতে ধারণা করা হয়েছে এ’ দুটো মিউটেশনের কারণে ভাইরাসের সংক্রমণের হার বৃদ্ধি পেতে পারে এবং ভাইরাসের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডির কার্যকারিতা ব্যাহত হতে পারে । সম্প্রতি ল্যানসেট জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় ফাইজার ভ্যাকসিনের এক ডোজ বা দুই ডোজ নেওয়া ২৫০ জন মানুষের সেরাম দিয়ে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টসহ অন্যান্য ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডির কার্যকারিতা পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। যে পদ্ধতিতে পরীক্ষা করা হয় তাকে বলে সেরাম নিউট্রালাইজেশন টেস্ট।  অর্থাৎ সেরামে থাকা অ্যান্টিবডি ল্যাবরেটরিতে ভাইরাসকে কতটুকু প্রশমিত করতে পারে তা জানতে এই পরীক্ষা। ল্যানসেটে প্রকাশিত এই গবেষণায় বেশিরভাগ সেরাম স্যাম্পলেই ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডির কার্যকারিতা পাওয়া গেছে, কিন্তু নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডির টাইটার অর্থাৎ অ্যান্টিবডির পরিমাণ, ইউকে ভ্যারিয়েন্টের তুলনায় কিছুটা কম। কিন্তু সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্টের তুলনায় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডির টাইটার প্রায় সমপরিমাণের। আবার এটাও দেখা গেছে, এক ডোজ নেওয়া ব্যক্তির ক্ষেত্রে বা বেশি বয়স্ক ব্যক্তির ক্ষেত্রে নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডির পরিমাণ বেশ কম।

কিন্তু এসব তথ্য থেকে কি প্রমাণিত হয় যে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন কাজ করছে না? মোটেই না। কারণ, নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডি টেস্ট ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা সম্পর্কে একটা প্রাথমিক ধারণা দেয় মাত্র।  কারণ, আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থা শুধু অ্যান্টিবডির ওপরই নির্ভর করে না। আরও রয়েছে, টি সেল ইমিউনিটিসহ অনেক প্রতিরোধী ব্যবস্থা। ভাইরাস একজন মানুষের মধ্যে কতটুকু রোগ সৃষ্টি করতে পারবে তা এসব কিছুর ওপরই নির্ভর করে, শুধু অ্যান্টিবডি নয়। এ কারণেই ল্যাবরেটরির পরীক্ষার পাশাপাশি যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো এপিডেমিওলজিক্যাল সার্ভে এবং তার সঙ্গে ল্যাবরেটরি ডাটা বা ক্লিনিক্যাল ডাটার যোগসূত্র স্থাপন।

এপিডেমিওলজিক্যাল তথ্য বিচারে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট হয়তো আগের ইউকে ভ্যারিয়েন্ট বা সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্টের তুলনায় বেশি সংক্রমণশালী, যার কারণে এই ভ্যারিয়েন্ট আগের ভ্যারিয়েন্টগুলোকে ক্রমশই সরিয়ে দিয়ে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করছে। কিন্তু ভ্যাকসিন-এর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার মতো তথ্য প্রমাণ এখনও তেমন শক্তিশালী নয়। বস্তুত, ল্যানসেটের পেপারের গবেষকরাও এপিডেমিওলজিক্যাল ডাটার সঙ্গে যোগসূত্র ঘটিয়ে এ উপসংহারই টেনেছেন যে, যারা ফাইজারের দুই ডোজ ভ্যাকসিন নিয়েছেন তাদের বেশিরভাগই ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে সুরক্ষা পাবেন। এর আগে ইউকে এবং সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট নিয়েও অনেক আশঙ্কা করা হয়েছিল।  কিন্তু ইসরায়েল ও কাতার থেকে প্রকাশিত দু’দুটো বড় আকারের গবেষণা প্রমাণ করেছে যে ফাইজারের ভ্যাকসিন দুটো ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে কার্যকর। তাই ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নিয়ে সঠিক চিত্র পাওয়ার জন্য শুধু মাত্র ল্যাবরেটরি থেকে পাওয়া প্রাথমিক ডাটার ওপর নির্ভর না করে, পপুলেশন লেভেল-এ গবেষণা বাড়ানো উচিত।

কাজেই এ মুহূর্তে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নিয়ে আশঙ্কা না করে যত বেশি মানুষকে যত দ্রুত ভ্যাকসিনের আওতায় নিয়ে আসা যায় তার জোর চেষ্টা চালানো প্রয়োজন। নতুন ভ্যারিয়েন্টের আবির্ভাব সম্পর্কে দ্রুত তথ্য পেতে, জোর দিতে হবে জেনোমিক সার্ভিলেন্সে। ভাইরাসকে শতভাগ  আটকানোর মতো ক্ষমতা পৃথিবীর কোনও দেশেরই নেই। কিন্তু যা আছে তা হলো উন্নত সার্ভেইলেন্স সিস্টেম। যার মাধ্যমে দ্রুততম সময়ে এসব ভ্যারিয়েন্টকে শনাক্ত করে রোগীদের আইসোলেশনের ব্যবস্থা করা যায়। ইউনিভার্সাল মাস্কিং, সামাজিক দূরত্ব ও ভ্যাকসিন নিশ্চিত করে এসব ভ্যারিয়েন্টকে বাড়তে না দেওয়া। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট এখন ইন্ডিয়ার বাইরে  অনেক দেশেই শনাক্ত হয়েছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত সেসব দেশ এই ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছে। কিন্তু ভারত পারেনি বা পারছে না। কাজেই পার্থক্যটা খুব পরিষ্কার। ভ্যাকসিন কাভারেজ বা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা দুদিক দিয়েই দেশটি অনেক পিছিয়ে আছে।

বাংলাদেশে সম্ভাব্য তৃতীয় ঢেউ ঠেকিয়ে রাখার প্রয়োজনে এ মুহূর্তে স্বাস্থবিধি কঠোর আরোপ করা প্রয়োজন। নামকাওয়াস্তে জেনারেল লকডাউন না করে যেসব জেলায় উদ্বেগজনক হরে সংক্রমণ বৃদ্ধি পাচ্ছে ও ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হচ্ছে, সেসব জায়গায় টার্গেটেড লকডাউন নিশ্চিত করা প্রয়োজন। যেসব কর্মকাণ্ডে ঝুঁকি বেশি আর যেসব কর্মকাণ্ডে মানুষের জীবন ও জীবিকা নির্ভরশীল নয়  সেসব কর্মকাণ্ড কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। তার পাশাপাশি ভ্যাকসিন নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটানো অতি জরুরি। একজন ভ্যাকসিন পাওয়া মানুষ আর না পাওয়া মানুষের মধ্যে পার্থক্য হলো আমাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থায় যেসব সৈন্যসামন্ত আছে সেসবের দক্ষতা ও ট্রেনিংয়ের পার্থক্য। ভ্যাকসিন পাওয়া মানুষটি সংক্রমিত হলেও আমাদের ট্রেনিং পাওয়া রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভাইরাসকে আগেভাগেই ঠেকিয়ে দেবে। ভাইরাসকে সংখ্যাবৃদ্ধি করতে বাধা দেবে। এভাবে অন্যের মাঝে রোগ ছড়াতেও বাধা সৃষ্টি করবে। কাজেই জনসংখ্যার মধ্যে যত বেশি মানুষ ভ্যাকসিন পাবে ভাইরাসটির চারপাশে একটা ব্যারিয়ার তৈরি হবে! এই হলো হার্ড ইমিউনিটি! কিছুটা ভ্যাকসিনের বদৌলতে আর কিছুটা ন্যাচারাল সংক্রমণের মাধ্যমে তৈরি হবে এই হার্ড ইমিউনিটির। সে পর্যন্ত চাই আরও ধৈর্য আরও পরীক্ষা!

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ওয়েল কর্নেল মেডিক্যাল কলেজ, দোহা, কাতার।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ