X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

‘আমারে মাইরেন না, আমি আর নিউজ করবো না’

প্রভাষ আমিন
০৬ নভেম্বর ২০২০, ১৯:২৪আপডেট : ০৬ নভেম্বর ২০২০, ১৯:২৬

প্রভাষ আমিন ফেসবুকে অনেকেই সাদাত হাসান মান্টোর একটা গল্প শেয়ার করছেন। দেশভাগ ও দাঙ্গা নিয়ে গল্প ‘খোল দো’– ‘কিশোরী একটা মেয়ে। গণধর্ষণের শিকার মেয়েটিকে মুমূর্ষু অবস্থায় নেওয়া হয় হাসপাতালে। হাসপাতালের অন্ধকার ঘরে অর্ধচেতন অবস্থায় শুয়ে আছে মেয়েটি। ডাক্তার এসে ঘরের অবস্থা দেখে বললেন, ‘এমন অন্ধকার কেন, আলো-বাতাস তো আসছে না, জানালাটা খুলে দাও।’ অর্ধচেতন মেয়েটি শুধু শেষ শব্দ দুটোই শুনলো। দুর্বল আর কাঁপা হাতে পাজামার ফিতাটা খুঁজলো। কোমর থেকে নিচের দিকে নামিয়ে নিলো পাজামাটা।’
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের কুমিরা থেকে উদ্ধার হওয়া সাংবাদিক গোলাম সরোয়ারের অবস্থাও হয়েছে সেই মেয়েটির মতো। অপহরণের তিন দিন পর দুর্বৃত্তরা তাকে অর্ধচেতন এবং অর্ধউলঙ্গ অবস্থায় একটা খালের পাড়ে ফেলে যায়। যারা তাকে উদ্ধার করতে গিয়েছিল, তাদের দেখেও তার ভয় কাটেনি। তিনি বারবার বলছিলেন, ‘আমারে মাইরেন না, আমি আর নিউজ করবো না।’
বারবার তার কণ্ঠে এই আকুতি শুনে একজন সাংবাদিক হিসেবে ভয়, লজ্জা, ক্ষোভ, ঘৃণা, অসহায়ত্ব গ্রাস করে নেয় আমাকেও। গোলাম সরোয়ার সাপ্তাহিক আজকের সূর্যোদয় পত্রিকার চট্টগ্রাম ব্যুরোর নিজস্ব প্রতিবেদক। গত বৃহস্পতিবার (২৯ অক্টোবর) সকাল সাড়ে নয়টার দিকে চট্টগ্রাম নগরের ব্যাটারি গলির বাসা থেকে বের হওয়ার পর নিখোঁজ হন তিনি। ঘটনার তিনদিন পর রোববার (১ নভেম্বর) কুমিরায় দুর্বৃত্তরা তাকে ফেলে যায়। বুঝতে অসুবিধা হয় না, এই তিনদিন তাকে অমানবিক নির্যাতন করা হয়। ফেলে যাওয়ার পরও তার ট্রমা কাটেনি। তিনি আসলে বুঝতেই পারেননি, তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এই তিনদিনে পুলিশ তার কোনও হদিস বের করতে পারেনি। অপহরণকারীরা দয়া করে তাকে ফেলে রেখে গেছে বলে, পুলিশ তাকে উদ্ধার করে হাসপাতাল পর্যন্ত নিতে পেরেছে। তারা সরোয়ারকে মেরে কর্ণফুলী বা বঙ্গোপসাগরে লাশ ফেলে দিলে হয়তো তার আর কোনও খোঁজও মিলতো না।
পরে সরোয়ার জানিয়েছেন, অপহরণকারীরা টেলিফোনে কাউকে বলছিল, ‘ও সাংবাদিক, খবরদার ওকে হত্যা করা যাবে না। সাংবাদিকদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য সরোয়ারকে তুলে এনেছি, হত্যার জন্য নয়।’ তুলে নেওয়ার পর তাকে লোহার রড, লাঠি ও গাছ দিয়ে মারধর করা হয়েছে। অপহরণকারীরা মারতে মারতে তাকে বারবার জিজ্ঞেস করছিল, ‘আর নিউজ করবি?’ তারপর থেকেই সরোয়ারের অবচেতন মনে গেঁথে গেছে, ‘আমারে মাইরেন না, আমি আর নিউজ করবো না’।
স্থানীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, সরোয়ার একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির জমি দখলের বিরুদ্ধে নিউজ করেছিলেন। আর সেই নিউজ করার অপরাধেই তাকে শিক্ষা দিতে তুলে নেওয়া হয়েছিল। মাত্র তিনদিনেই তারা যথেষ্ট শিক্ষা দিতে পেরেছেন। ভয়টা হলো, এই শিক্ষাটা শুধু একজন সাংবাদিককে নয়, দেওয়া হয়েছে আসলে সব সাংবাদিককে। দেখিয়ে দেওয়া যে আমাদের বিরুদ্ধে নিউজ করলে কী হয় দেখো। আমরা শিক্ষাটা পেয়ে গেছি। বুঝে গেছি, বাংলাদেশে সাংবাদিকতা করাটা দিন দিন আরও কঠিন এবং ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে।
এমনিতেই বাংলাদেশে সাংবাদিকদের নানান চাপের মুখে থাকতে হয়। প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ নানান হুমকি তো আছেই, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন যেন করাই হয়েছে সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধ করার জন্য। ঢাকায়ও সাংবাদিকতাটা ঝুঁকিপূর্ণ, তবে ঢাকার বাইরে ঝুঁকির মাত্রাটা আরও বেশি। ঢাকার বাইরে বিভাগীয় বা জেলা শহরে সবাই সবাইকে চেনে। তাই কারও বিরুদ্ধে লিখতে গেলেই হুমকি-ধমকি চলতে থাকে। সরোয়ারের মতো ‘ভাগ্যবান’ কেউ কেউ প্রাণে বেঁচে যান, কাউকে কাউকে জীবনও দিতে হয়। ফটোসাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল অপহরণের পর প্রাণে বেঁচে গেছেন বটে। কিন্তু নিজ দেশে অনুপ্রবেশের হাস্যকর মামলায় তাকে এখনও কারাগারে থাকতে হচ্ছে।
সাংবাদিকরা আসলে উভয় সংকটে থাকেন। সব সরকারই সবসময় গণমাধ্যমের ওপর অসন্তুষ্ট থাকে। আর এখন জনগণের সব আক্রোশ যেন সাংবাদিকদের ওপর। গত সপ্তাহে এ কলামে ‘মরা সাপ পেটানো’র সাংবাদিকতা! শিরোনামে সেই সমস্যাগুলোর ওপর কিছুটা আলোকপাত করার চেষ্টা করেছি। অনেকেই অভিযোগ করেন, সাংবাদিকরা সরকারের বিরুদ্ধে লেখে না কেন। সাংবাদিকদের কাজ কিন্তু কারও বিরুদ্ধে লেখা নয়। সাংবাদিকদের কাজ হলো বস্তুনিষ্ঠভাবে সত্য তুলে ধরা। সেটা কার পক্ষে গেলো, কার বিপক্ষে গেলো সেটা বিবেচনার দায়িত্ব সাংবাদিকের নয়। যেহেতু বর্তমান সরকার টানা একযুগ ক্ষমতায়, তাই গণমাধ্যমের খবর সরকার বা সরকারি দলের নেতাকর্মীদের বিপক্ষেই যায় বেশিরভাগ সময়। তাই সাধারণ জনগণ যেমন, সরকারি দলও সবসময় সাংবাদিকদের ওপর অসন্তুষ্টই থাকে। গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে বিভ্রান্তি ছড়ানো, জাতীয় স্বার্থের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ার মতো গুরুতর অভিযোগও আনা হয়। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারি দলের নেতাকর্মীরা সাংবাদিকদের প্রায়শই উপদেশ দেন, সাংবাদিকতা শেখান। সমালোচনাকে ‘গঠনমূলক’ মাত্রা ঠিক করে দেন। তবে আমি সরকারি দলের এই প্রতিক্রিয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন নই। তারা চাইবেই নানান কৌশলে সাংবাদিকদের মুখ বন্ধ রাখতে। একজন সাংবাদিক হিসেবে আমার যেমন মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে, একজন রাজনীতিবিদেরও মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে। একজন রাজনীতিবিদ সাংবাদিকদের ওপর ক্ষুব্ধ হলে সেটা প্রকাশ করাও তার মত প্রকাশের অধিকারই বটে। তবে কে, কী বললো সেটা মাথায় না রেখে; সাংবাদিকদের নিয়ম মেনে নির্ভয়ে নিজেদের সত্য প্রকাশের কাজটা চালিয়ে যেতে হবে। সমস্যা হলো, এই ভয়। চট্টগ্রামে সাংবাদিক গোলাম সরোয়ারকে যেভাবে তুলে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে, তাতে ভয় না পাওয়াটাই বোকামি।
সরকার সরকারের কাজ করবে, সাংবাদিকদেরও তাদের কাজটা করতে হবে।
তুলে নিয়ে ভয় দেখানোটা আইনের বাইরে। তুলে নিয়ে ভয় দেখালে তো আর সাংবাদিকদের কিছু করার থাকবে না। সাংবাদিকদের তো কলম ছাড়া আর কোনও অস্ত্র নেই। দিনভর যারা সাংবাদিকদের গালি দেন, তারা কি গোলাম সরোয়ারকে অপহরণ এবং নির্যাতনের প্রতিবাদ করেছেন? সাংবাদিকরা সবার পাশে দাঁড়াবে কিন্তু সাংবাদিকদের পাশে কেউ দাঁড়াবে না, তাহলে তো হবে না।
গোলাম সরোয়ারকে কে বা কারা অপহরণ করেছে, নির্যাতন করেছে, ভয় দেখিয়েছে আমরা জানি না। কিন্তু পুলিশকে সেটা জানতে হবে। সরোয়ারকে উদ্ধার করতে না পারাটা পুলিশের ব্যর্থতা। এখন পুলিশকে অবশ্যই খুঁজে বের করতে হবে, কারা সাংবাদিকদের ভয় দেখাতে চায়। একজন সাংবাদিককে দিনে-দুপুরে তুলে নিয়ে তিন দিন পর ফেলে রেখে যাবে, আর পুলিশ-প্রশাসন কিছুই জানবে না, এটা হতে পারে না।
বাংলাদেশে অনেক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে গেছে আগেই। বিরোধী দল নেই বললেই চলে। দেশের স্বার্থেই গণমাধ্যমকে স্বাধীন, নির্ভীক, সচল থাকতে হবে। এমন দিন যেন না আসে, মারের ভয়ে সাংবাদিকরা নিউজ প্রকাশ বন্ধ করে দিলো।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জলপাইগুড়িতে বিজেপির ইস্যু বাংলাদেশের তেঁতুলিয়া করিডর
জলপাইগুড়িতে বিজেপির ইস্যু বাংলাদেশের তেঁতুলিয়া করিডর
নদীতে মাছ ধরার সময় জেলেদের ওপর ডাকাতের হামলা
নদীতে মাছ ধরার সময় জেলেদের ওপর ডাকাতের হামলা
ক্রিমিয়া উপকূলে রুশ সামরিক উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত
ক্রিমিয়া উপকূলে রুশ সামরিক উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত
হোয়াইট হাউজের বিড়াল নিয়ে বই প্রকাশ করবেন মার্কিন ফার্স্টলেডি
হোয়াইট হাউজের বিড়াল নিয়ে বই প্রকাশ করবেন মার্কিন ফার্স্টলেডি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ