X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

ক্যাম্পাস নিরাপত্তা

জহিরুল হক মজুমদার
২৩ মে ২০১৮, ১৫:৫১আপডেট : ২৩ মে ২০১৮, ১৬:০১

জহিরুল হক মজুমদার অধ্যাপক জাফর ইকবাল আক্রান্ত হয়েছেন। তাঁকে মেরে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। এটা ছিল এই সময়ের সবচেয়ে কাঁপিয়ে দেওয়া সংবাদ। এটা কখনও ঘটতে পারে, কেউ কল্পনাও করেনি। এই সদা হাস্যোজ্জ্বল, মেধাবী এবং সাহিত্যস্রষ্টা অধ্যাপকের সামনে শত্রুও বিনয়ী হয়ে পড়বে- এটাই ছিল আমাদের ধারণা। কিন্তু আমাদের হতবাক করে দিয়ে এক জঘন্য ঘাতক ছোরা হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁর ওপর। আহত-রক্তাক্ত করে অধ্যাপক জাফর ইকবালকে।
এরপরের প্রহরগুলো ছিল গোটা জাতির জন্য শ্বাসরুদ্ধকর। স্যার কতখানি আহত হয়েছেন, তাঁর বর্তমান অবস্থা কী, এসব জানার জন্য সবাই ছিল উদগ্রীব। আর এসব সংবাদ জোগান দিয়ে মানুষকে শান্ত রাখার ক্ষেত্রে মিডিয়াগুলো ছিল তৎপর। স্বস্তির কথা এই যে অধ্যাপক জাফর ইকবাল আমাদের মাঝে ফিরে এসেছেন এবং লেখালেখি এবং অধ্যাপনায় ব্রতি হয়েছেন আগের মতই।
অধ্যাপক জাফর ইকবালের ওপর হামলার ঘটনাটি ঘটেছে ক্যাম্পাসে। তাতে যে বিষয়টি প্রথমেই সামনে চলে আসে তা হচ্ছে ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা। বাংলাদেশের কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসই শিক্ষক, ছাত্র এবং শিক্ষা সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য নিরাপদ নয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রধান ফটক দিয়ে কোনও প্রকার পরিচিতি প্রমাণ ছাড়াই যেকোনও লোক ঢুকে পড়ছেন।

অনেকেই বলে থাকেন বিশ্ববিদ্যালয় মুক্ত জায়গা। বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান অর্থে মুক্ত জায়গা। সাধারণের হাঁটাচলার জন্য মুক্ত জায়গা নয়। বিশ্ববিদ্যালয় কোনও পাবলিক পার্ক নয় যে এখানে বৈকালিক অবকাশযাপনের জন্য কেউ নিয়মিত আসবেন। বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু দর্শনযোগ্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা এবং এক ধরনের স্থাপত্য নান্দনিকতা রয়েছে, তাই বিকেলে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পরিচিতি যাচাই সাপেক্ষে সাধারণ নাগরিকদের জন্য উন্মুক্ত রাখা যেতে পারে। অভিভাবক এবং সাবেক ছাত্রদের জন্য সারাদিনই উন্মুক্ত থাকতে পারে। তবে সেক্ষেত্রেও পরিচিত যাচাই আবশ্যক।

পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই কোনও প্রয়োজন ছাড়া সাধারণের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ে হাঁটাচলা বারণ। এতে একাডেমিক কাজের বিঘ্ন ঘটার সম্ভাবনা থাকে। নিরাপত্তার ঝুঁকি তো রয়েছেই। পাশের দেশ ভারতের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, যা শান্তিনিকেতন নামে পরিচিত, সেখানে গেলে দেখা যায়, দিনের বারোটা'র আগে কোনও দর্শনার্থীর প্রবেশ নিষেধ। রবীন্দ্র স্মৃতিধন্য এই জায়গায় প্রতিদিন অনেক পর্যটকের ভিড় হলেও বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার স্বার্থে কর্তৃপক্ষ নির্দিষ্ট সময় ছাড়া সেখানে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি রেখেছেন।

অধ্যাপক জাফর ইকবালের ওপর হামলাকারীকেও দেখা গেছে বিভিন্ন সময় রেকি করার জন্য সাইকেলে চেপে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছে। অথচ সে বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট কেউ নয়। বিশ্ববিদ্যালয় নিরাপত্তারক্ষীরা তাকে বাধাও দেয়নি, এমনকি তার পরিচিতিও যাচাই করেনি।

সবচেয়ে অনিরাপদ পরিস্থিতি হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতি। এখানে ছাত্র এবং শিক্ষক রাজনীতি প্রচলিত আছে। জামাত-শিবির এবং জঙ্গিবাদী মানসিকতার রাজনীতিতে বিশ্বাসী অনেক ছাত্রই এখন ভোল পাল্টে প্রচলিত রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনে ঢুকে পড়েছে। এসব জঙ্গিবাদীর সহযোগিতায় জাফর ইকবালের মতো মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তবুদ্ধির পক্ষের বিদ্বৎজনের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি বেড়ে যায়। অধ্যাপক জাফর ইকবালের ক্ষেত্রে তাই ঘটেছে বলে মনে করি।  

যে জঙ্গি দুর্বৃত্তটি অধ্যাপক ইকবালের ওপর ছুরি নিয়ে হামলা চালিয়েছে সে দীর্ঘ সময় ধরে মঞ্চের ওপর স্যারের পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিল। তার গায়ে ছিল সেই প্রোগ্রামের জন্য স্যুভেনির টি শার্টের মতোই একটি টি শার্ট।  সেক্ষেত্রে হামলাকারীকে অনুষ্ঠানের জন্য তৈরি টি শার্ট সম্পর্কে ধারণা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়েরই কেউ। তাছাড়া এই হামলাকারী দীর্ঘ সময় অধ্যাপক ইকবাল এর পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা নিয়ে কেউ আপত্তি করেনি কেন এটাও প্রশ্নসাপেক্ষ। এরকম আয়োজনে যে কারোর মঞ্চে ওঠে দাঁড়াবার কথা নয়। ছাত্ররা ছাত্রদের চেনে। বহিরাগত কাউকে মঞ্চে দেখামাত্র ছাত্রদের দিক থেকে আপত্তি ওঠার কথা ছিল। এতে মনে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর থেকেই কেউ না কেউ হামলাকারীর মঞ্চে দাঁড়ানোর ব্যবস্থা করেছে।

বিচারের শেষে যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর শুরু হওয়ার পর থেকে শিবির আর স্বনামে ক্যাম্পাসে আগের মতো সক্রিয় নয়। তবে তারা পরিচয় গোপন করে অন্য সংগঠনগুলোতে ঢুকে পড়েছে। কয়েক বছর আগে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষের জের ধরে আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এবং অন্যান্য নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ বলেছিলেন, ছাত্রলীগের মধ্যে শিবির ঢুকে পড়েছে এবং তারাই এসব করছে। বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতিতে কর্মী সংগ্রহের কোনও নির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। কোনও প্রকার বাছবিচার ছাড়া মিছিল বড় করাই থাকে একমাত্র লক্ষ্য। তাই শিবির এবং অন্যান্য জঙ্গিবাদীদের জন্য ভোল পাল্টে যেকোনও সংগঠনেই ঢুকে পড়তে পারা অনেক সহজ একটি ব্যাপার, এমনকি যেকোনও সাংস্কৃতিক সংগঠনেও। এ বিষয়ে সাংগঠনিক কড়া নজরদারি এবং আইনের প্রয়োগ আবশ্যক।  

শিক্ষক রাজনীতিতে জামাতপন্থী এবং জঙ্গিবাদের সমর্থকদের অবস্থান এত প্রকাশ্য নয়। তারা সাধারণত বিএনপি'র শিক্ষকগোষ্ঠীর মধ্যে লুকিয়ে থাকে। অতীতেও তাই ছিল। সম্ভবত নিজেকে জামাতপন্থী হিসেবে পরিচয় দিতে অস্বস্তি বোধ করেন বলেই ওই সমস্ত শিক্ষক বিএনপি'র শিক্ষক জোটের মধ্যে মিশে থাকেন। তবে এতে বিএনপিপন্থী শিক্ষকদের রাজনৈতিক পরিচিতি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। শিক্ষিত সমাজের অনেকেই পেশাগত রাজনীতির ক্ষেত্রে বিএনপি এবং জামাতপন্থীদের আলাদা করে দেখেন না। তবে এটাও মুক্তিযুদ্ধের একটি বিরাট অর্জন যে এদেশে জামাতপন্থী হিসেবে পরিচয় দেওয়া কখনোই সমাজের চোখে সম্মানজনক ছিল না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর অপেক্ষাকৃত তরুণ অনেক জামাত-শিবির সংশ্লিষ্ট শিক্ষক আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষক জোটেও অবস্থান নিয়েছেন এবং প্রশাসনের আনুকূল্যও পাচ্ছেন।

এ অবস্থা চলতে থাকলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ছাত্র-শিক্ষক কেউই নিরাপদ নয়। জঙ্গিবাদী শিক্ষকরাই একাত্তরের মতো সহকর্মীদের গতিবিধি জঙ্গিদের জানিয়ে দেবে। আক্রান্ত হবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের, প্রগতিশীল শিক্ষকরা।

একাত্তরের কথা স্মরণ করলে দেখা যায় কীভাবে ১৪ ডিসেম্বর সেই কাদামাখা বাসের আলবদরদের শিক্ষকদের বাসা চিনিয়ে দিয়েছিল একই আবাসিক এলাকায় বসবাসকারী মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শিক্ষকরাই। 

একাত্তরের পর অনেক মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শিক্ষককেই ক্যাম্পাস ছাড়তে হয়েছিল। ১৯৭১-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোলাবোরেটর উপাচার্য সৈয়দ সাজ্জাদ হোসাইন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক হাসান জামান, ইতিহাস বিভাগের মোহর আলী, পরিসংখ্যান বিভাগের আসকার ইবনে শাইখ এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাম। সে সময়ের বঙ্গবন্ধু সরকার তাদের ব্যাপারে অনমনীয় ছিল।     

বর্তমান পরিস্থিতিতে এ বিষয়ে করণীয় নিয়ে সরকার ভাববে বলে আশা করি। সংসদে কোনও বিশেষ আইন কিংবা রাষ্ট্রপতির কোনও বিশেষ আদেশ বলে এই সমস্যার সুরাহা করা যেতে পারে বলে মনে করি।

একই সঙ্গে ক্যাম্পাসে উচ্চ প্রযুক্তিনির্ভর নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। দর্শনার্থী প্রবেশের ক্ষেত্রে যাচাই করতে হবে পরিচয় এবং প্রবেশের যৌক্তিকতা। তথাকথিত গণ-উন্মুক্ততার দোহাই তুলে ছাত্র-শিক্ষকদের অনিরাপদ পরিবেশে রাখার কোনও সুযোগ নেই। আর তা না হলে ক্যাম্পাস জঙ্গিদের নিরাপদ চারণভূমি হয়ে উঠবে। আক্রান্ত হবেন অধ্যাপক জাফর ইকবালের মতো উদার মনোভাবাপন্ন কোনও শিক্ষক, ছাত্র কিংবা রাজনৈতিক কর্মী।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

 

 

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ