X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

আবরার ও রাষ্ট্রের বিবেক

সাহাব এনাম খান
১১ অক্টোবর ২০১৯, ১৭:২৩আপডেট : ১৮ ডিসেম্বর ২০১৯, ১৫:২২









সাহাব এনাম খান ‘আবরার’– এই নামটি এখন আর কোনও সাধারণ নাম নয়। আবরারকে বর্তমান সময়ের বাংলাদেশের রূঢ়, ক্ষয়িষ্ণু সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার একটি প্রতীকী নাম হিসেবেই আমি দেখি। আবরারের মৃত্যু আমাদের বিস্মিত করে না, শুধু মনে করিয়ে দেয় আমাদের সৃষ্টি করা অমানবিক, অসহিষ্ণু সমাজের কথা। আবরারের মৃত্যুতে তার পিতামাতার বেদনার কিছুটা হয়তো বা তার সহপাঠী, বন্ধু, আর শিক্ষকরা অনুভব করতে পারবেন, এর বাইরে যারা তার মৃত্যুর জন্য দায়ী এবং সেই দায়ী ব্যক্তিদের যারা পৃষ্ঠপোষক তারা কিছু অনুভব করেন কিনা আমার জানা নেই। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, তারাই এই রাষ্ট্রের মানবিক মূল্যবোধকে নিয়ন্ত্রণ করেন। একজন শিক্ষক হিসেবে তার মৃত্যু আমাকেও স্পর্শ করে এবং এ মৃত্যুর দায় আমার মতে কোনও শিক্ষকই এড়িয়ে যেতে পারেন না।

আবরার হয়তো একদিন বড় প্রকৌশলী হতে পারতো, হয়তো বা সরকারের বড় পদস্থ হতে পারতো, হয়তো বা শুধু একজন ভালো মানুষ হিসেবেই সমাজ গঠনে ভূমিকা রেখে যেত। ফেসবুকে তার বাংলাদেশ-ভারতকে নিয়ে চিন্তা আমাদের যুবসমাজের মুক্তচিন্তাভিত্তিক গণতন্ত্রের প্রতি আগ্রহরই প্রকাশ। এত অল্প বয়সে রাষ্ট্রের নীতি নিয়ে তার চিন্তার বিস্তার আমাদের মুগ্ধ করেছে। তার মতের সঙ্গে সবার মিল থাকতে হবে এমন কোনও আইন বা সাংবিধানিক বাধা রাষ্ট্র দেয় না। তার হত্যাকারীরা হয়তো বাকিদের বাকস্বাধীনতা রোধের ইঙ্গিত দিতে চেয়েছে। এটি সরাসরি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দুর্নীতি ও সন্ত্রাসবিরোধী বর্তমান অবস্থানের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার শামিল। আমি মনে করিয়ে দিতে চাই, প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মানুষ যত ওপরে ওঠে, তত ভদ্র হতে হয়, হাম্বল হতে হয়। আর আমাদের হয় উল্টোটা। এটা হয় তখনই, যখন হঠাৎ করে পয়সার জোরে নিচ থেকে অনেক ওপরে যায়, তখন তারা ভাবে ‘মুই কী হনুরে’। সমাজের এই জায়গাটায় একটি আঘাত দেওয়ার প্রয়োজন ছিল। অসৎ উপায়ে অর্জিত অর্থের বাহাদুরি, সে সম্পদের শো-অফ করা, আর যারা সৎপথে চলবে, তারা একেবারে মরে থাকবে, এটা তো হতে পারে না।’
তবে এটা পরিষ্কার, আমি যে সমাজে বসবাস করি এবং যে রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ, সেই সমাজ বা রাজনীতি আবরারের মৃত্যুতে যে অপূরণীয় ক্ষতি হলো তা পূরণ করার ক্ষমতা রাখে না। তোষামোদকারী ছাড়া কারোরই এই বাস্তবতা অস্বীকার করার উপায় নেই। তাই বিষয়টিকে অযথা রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে ভিন্নখাতে নিয়ে যাওয়ার অবকাশ নেই।
বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা ১৯৫২ সাল থেকে শুরু করে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। ছাত্র আন্দোলনগুলোতে তো সর্বসাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন দিয়েছিলেন, তাই সাধারণ মানুষ-ই ছাত্র নেতৃত্বকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন। ভেবে দেখার সময় এসেছে আদতে সাধারণ মানুষ এই ছাত্র রাজনীতিতে কতটুকু ভরসা রাখেন এবং পিতামাতা যারা তাদের সন্তানকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়াতে পাঠান তারা কতটুকু নিশ্চিন্ত থাকেন। তাছাড়া তৎকালীন সময়ে অসাধারণ মেধাবী শিক্ষকরা যথাযথ জ্ঞান বিতরণ ও শিক্ষার পরিবেশের মাধ্যমে এই আন্দোলনগুলোর জন্য যোগ্য নেতৃত্ব এবং মেধাবী কর্মী তৈরি করে দিয়েছিলেন। এর সুফল এই জাতি পেয়েছে।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও, নব্বইয়ের দশকের পরবর্তীতে ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখার মতো গঠনমূলক কাজের উদাহরণ সাংগঠনিক দলগুলো দিতে পারবে কিনা তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। যোগ্যতাসম্পন্ন ছাত্রকেন্দ্রিক রাজনৈতিক অঙ্গসংগঠনগুলোর নৈতিক অবক্ষয় এবং এর প্রাসঙ্গিকতার অভাব বাংলাদেশের মানুষ অনেক দিন ধরেই অনুভব করছেন। তাই, ছাত্রলীগ বা যুবলীগের মতো ঐতিহাসিক অঙ্গসংগঠনগুলোর ‘সন্ত্রাসী প্রতিষ্ঠান’ হিসেবে আখ্যা পাওয়ার আগেই ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। ইতিহাসের পাতায় শুধু কালো আর লাল কালির দাগই পাওয়া এখন যায়।
২০০২ সালে শামসুন্নাহার হলে পুলিশি হামলার ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। অধ্যাপক চৌধুরীর পদত্যাগের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থীদের সমাগম ঘটে। ২০১২ সালে শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম, ছাত্রলীগের অঞ্চলভিত্তিক অংশকে মদত, বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে বাধা দেওয়ার অভিযোগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। সে সময়ে ছাত্রলীগ নেতাদের হামলায় সংগঠনটির অন্য অংশের কর্মী ইংরেজি বিভাগের ছাত্র জুবায়ের আহমেদ নিহত হওয়ার পরে এর বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে ওঠে। ২০১৩ সালের শাহবাগ আন্দোলনটি শুরু হয়েছিল সাধারণ ছাত্রছাত্রী এবং সাধারণ জনগণের এক অভূতপূর্ব সম্মিলনে। এই আন্দোলনের মধ্যে যখন বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক স্বার্থবাদী কর্মকাণ্ডের প্রতিফলন ঘটা শুরু করে তখন এই আন্দোলনটি নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্নও তৈরি করে।
নিরাপদ সড়কের জন্য যৌক্তিক আন্দোলন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভ্যাটের বিরুদ্ধে আন্দোলন, অথবা কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রত্যেকটিতেই ছিল সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের অংশগ্রহণ। সাংগঠনিক রাজনীতির যথার্থ ভূমিকা এখানে খুঁজে পাওয়াটা দুষ্কর। এসব আন্দোলন এতটাই সরল ছিল, যা শুধুমাত্র রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং প্রশাসনিক দক্ষতার মাধ্যমে মিটিয়ে ফেলা যেত। স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, এখানে বল প্রয়োগ করার মতো অবস্থায় না নিয়ে যাওয়ার মতো রাজনৈতিক দূরদর্শিতা বা প্রশাসনিক দক্ষতা কি ছিল না?
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের কারণে জুবায়েরের মৃত্যুতে আমাদের রাজনৈতিক চেতনায় যেমন কিছুই শিখিনি তেমনি বাংলাদেশের গর্ব বুয়েটের ছাত্র আবরারের মৃত্যু থেকেও আমাদের রাজনৈতিক চেতনায় খুব বেশি পরিবর্তন আসবে বলে আশা করি না। নিশ্চিতভাবেই এই মৃত্যুকে কেন্দ্র করে অনেক জ্ঞানগর্ভ আলোচনা, উপদেশ বাণী, ব্যাপক পরিবর্তনের আশ্বাস, শিক্ষাব্যবস্থার দুর্গতিতে অতীতে কার কী ভূমিকা ছিল, এমনকি যারা এ ধরনের রাজনীতিকে সমর্থন দিয়ে আসছেন তাদের কাছ থেকেও বিস্তর আশার কথা আমরা শুনবো। এতে মূল অবস্থার পরিবর্তন হবে না, তবে কিছু কসমেটিক লেভেলের আইনি এবং এডহক রাজনৈতিক সমাধান আমরা দেখবো। এর মানে হলো, শিক্ষাঙ্গনে পূর্ণাঙ্গ প্রাতিষ্ঠানিক রিফর্ম এবং ছাত্র রাজনীতির ব্যাপক সংস্কার করার মতো টেকসই রাজনৈতিক পরিকল্পনা এবং প্রশাসনিক দক্ষতার প্রতিফলন ঘটানোর মতো প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক নিষ্ঠার অভাব আছে।
জনগণের ট্যাক্সের টাকায় যাদের আইন প্রয়োগ এবং প্রণয়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় তারা আদতে প্রধানমন্ত্রীকে কতটুকু বাস্তবসম্মত সহায়তা করেন তা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন আছে। প্রতিটি সাধারণ নাগরিক বিষয়েই যদি সরকারের সর্বোচ্চ ব্যক্তির এবং রাষ্ট্রের হাইকোর্টের নির্দেশনার প্রয়োজন হয় তবে দায়িত্বপ্রাপ্ত রাজনীতিবিদ বা সরকারি কর্মচারীদের যোগ্যতা ও নিষ্ঠা নিয়ে ভেবে দেখা দরকার। দুই জন ছাত্রলীগ নেতার অপসারণ যে যথেষ্ট নয় তা আবরারের মৃত্যুই প্রমাণ করে।
যুবলীগ সভাপতির বয়স পত্রপত্রিকা অনুযায়ী ৭০-এর ওপরে এবং তাদের অনৈতিক কার্যক্রমের পরিধি সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে অনেক প্রবীণ রাজনীতিবিদকে হতাশ এবং বিস্মিত করেছে। এর পেছনে মূলত দুটি কারণ দায়ী। প্রথমটি হলো তোষামোদ, অনৈতিক আর্থিক সুবিধা আদায় ও বল প্রয়োগের রাজনীতি। তোষামোদি বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি বড় দুর্বলতার জায়গা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক ও ছাত্র রাজনীতি অনেকটাই তোষামোদ কেন্দ্রিক। এর সাথে যুক্ত হয়েছে কিছু আনুগত্যপ্রবণ ‘বুদ্ধিজীবী’ ও ‘মিডিয়া’ শ্রেণি, যারা বিভিন্নভাবে কলুষিত ছাত্র রাজনীতিকে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ মদত দিয়ে আসছেন। এটা আরও ভয়ঙ্কর। এরা ভুলকে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য জনগণকে বিভ্রান্ত করেন এবং অনেক ক্ষেত্রেই সত্য গোপন করেন। এটাকে বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি বলা যায়।
দ্বিতীয়টি হলো রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ব্যবহারের নির্লজ্জ প্রতিযোগিতা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দলীয় ভোট ব্যাংক তৈরি করার জন্য অনেক সময় শিক্ষকদের নিয়োগ দেওয়া হয়, এবং হালে তো আমরা দেখছিই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনগুলোর কার্যকলাপের নমুনা। এদের কার্যকলাপের সঙ্গে বা নিয়োগ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংখ্যাগুরু শিক্ষক কোনও অবস্থাতেই যুক্ত থাকেন না। এই ভোট ব্যাংকের উদ্দেশ্যটাই হলো যৌক্তিক ছাত্র আন্দোলনকে বা শিক্ষকদের ডিসেন্ট দেওয়ার ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করা। অতীত ইতিহাসে সরকার পরিবর্তন, রাজনৈতিক মেরুকরণ, বলাই বাহুল্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের মতো মহান কর্মকাণ্ডে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অসামান্য ভূমিকা যেকোনও রাজনৈতিক দলের জন্যই নব্বই পরবর্তী দশকে হুমকি হিসেবে দেখা দেয়। ফলে, একশ্রেণির শিক্ষক দুর্নীতি এবং ক্ষমতাপরায়ণ আমলা-রাজনীতিবিদের সাথে যুক্ত হয়ে দুষ্টুচক্র সৃষ্টি করেন। বিচারহীনতার সংস্কৃতি বিষয়টিকে আরও ভয়ঙ্কর করে তুলেছে। জুবায়ের এবং আবরারের মৃত্যু দুষ্টচক্রের কার্যকলাপেরই ছোট একটি উদাহরণ মাত্র।
অতি উৎসাহী দলীয়করণে সাময়িকভাবে কোনও একটি দল হয়তো বা লাভবান হয় কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে সরকার বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে, রাষ্ট্রের প্রতি জনগণের আস্থার অভাব ঘটে, এবং সিভিল ও সামাজিক আনরেস্টের দিকে সমাজ ধাবিত হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিষয়টি অনুধাবন করেছেন বলেই ব্যাপক আকারে শুদ্ধি অভিযান বাংলাদেশে চলছে। বাংলাদেশের তথাকথিত বুদ্ধিজীবী সমাজ, টকশোতে দলীয় তোষামোদকারীদেরও এ শুদ্ধি প্রক্রিয়ার আওতায় আনা উচিত। গঠনমূলক সমালোচনা সকলের জন্যই মঙ্গল কিন্তু বিভ্রান্তিকর তথ্য এবং যুক্তি অমঙ্গলই ঘটায়।
ওপরের দুটো বিষয়ই বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির অগ্রগতির গতি-প্রকৃতি ও ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরির প্রক্রিয়াকে ভীষণভাবে বাধাগ্রস্ত করে। যে পর্যন্ত বাংলাদেশের মূল রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে শুদ্ধি অভিযান সম্পূর্ণ না হবে এবং তোষামোদ ও শক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতির পরিবর্তে মেধাভিত্তিক রাজনীতির প্রবর্তন না হবে, সে পর্যন্ত ছাত্র রাজনীতি নিয়ে আশান্বিত হওয়ার কিছু নেই। বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর রাজনীতির বাইরে অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতির পরিবেশ আরও বেদনাবহ।
এই বাস্তবতায় দুটি বিকল্প চিন্তা পাবলিক প্ল্যাটফর্মে আলোচনা করা যেতে পারে। প্রথমটি হলো, বুয়েটের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করা। কারণ, বুয়েটের শিক্ষার্থীরা প্রশাসনিক পরিবর্তন ও সাংগঠনিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি তুলেছেন। বুয়েটের মতোই অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও হলে হলে ত্রাসের রাজনীতি কায়েম করে রাখা হয়। তাই বর্তমান বাস্তবতার নিরিখে প্রধানমন্ত্রীর শুরু করা শুদ্ধি অভিযান চলাকালে সাংগঠনিক লেজুড়ভিত্তিক রাজনীতি সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা শ্রেয়। বিএনপি-জামায়াত বা অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো এই সুযোগে হল ও বিশ্ববিদ্যালয় দখল করবে, অতীতে ছাত্রলীগ মার খেয়েছে ইত্যাদি অতি ব্যবহৃত যুক্তিগুলোর সামাজিক আপিল অনেক আগেই হ্রাস পেয়েছে। অথবা ১৫ বছর আগের বিএনপি যে নির্যাতন করেছিল তা নিয়ে তুলনা করে যুক্তি দেওয়া হয়। বিএনপি বা শিবির সন্ত্রাস করেছিল বলেই ২০০৮ সালে মানুষ এই সরকারকে নির্বাচিত করে। ছাত্রলীগ বিএনপি বা শিবির যা করেছিল সেটার পুনরাবৃত্তি করবে সেই ম্যান্ডেট মানুষ সরকারকে দেয়নি। এটা মনে রাখা দরকার।
রাজনৈতিক বাস্তবতা হলো বাংলাদেশের জনগণ উগ্র ডানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোকে বর্জন করেছে এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের অবস্থান সুস্পষ্টভাবেই দুর্বল। এহেন বাস্তবতায় অচল যুক্তি দিয়ে সন্ত্রাসকে পরোক্ষ প্রশ্রয় দেওয়ার অপচেষ্টা ও সাধারণ মানুষকে বিরক্ত করার প্রবণতা বন্ধ করা প্রয়োজন। এ ধরনের যুক্তি সাধারণ মানুষের সাধারণ বোধকে আহত করে। বরং অনেক গবেষণায় দেখা গেছে রাজনৈতিক দমন-পীড়ন এবং মত প্রকাশের বাধা যুব সমাজের একটি অংশকে ধর্মীয় উগ্রবাদের দিকে ঠেলে দেয়। যারা রেডিক্যালাইজেশন বা এক্সট্রিমিজম বা ক্রিমিনাল সাইকোলজি নিয়ে কাজ করেন তারা বলতে পারবেন রাজনৈতিক নিগ্রহ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে আতঙ্কজনক পরিবেশের কারণে অনেক শিক্ষার্থীই উগ্রপন্থী মতাদর্শে বা বিকল্প আদর্শের দিকে ঝুঁকে পড়েছে।
সাংগঠনিক রাজনীতি যদি উগ্রবাদের পরিবেশকে তৈরি করে দেয় তাহলে রাজনৈতিক উন্নয়ন হবে কী করে? বিষয়টা সরাসরি সামাজিক স্থিতিশীলতা এবং জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পৃক্ত। র্যাাব বা সিটিটিসিইউ’র সাম্প্রতিক সময়ে জঙ্গিবাদবিরোধী অভিযানগুলোতে যেসব যুবক আটক হয়েছে বা যারা সম্পৃক্ত বলে ধারণা করা হয় তাদের অনেকেই শিক্ষিত। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, জুডিশিয়ারি এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে যোগ্য মানবসম্পদের মাধ্যমে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিলে এ ধরনের অনেক সমস্যার সমাধান হবে।
দ্বিতীয় বিকল্পটি হলো, সাংগঠনিক রাজনীতির ওপর থেকে সরাসরি দলীয় সহায়তা তুলে নিয়ে তাদের সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক নৈতিক রাজনীতি করার পথ করে দেওয়া। একই সঙ্গে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের নিজেদের রাজনৈতিক ভাবনা ও মত প্রকাশের স্বাধীন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে দেওয়া দরকার। এর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসন ও মিডিয়াকে উৎসাহিত করা প্রয়োজন। পুরনো ধ্যান-ধারণা থেকে বের হয়ে এসে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ঢেলে সাজানো এবং ছাত্রছাত্রীদের নির্ভীকভাবে মুক্ত রাজনৈতিক চর্চার ক্ষেত্র তৈরি করার জন্য উন্মুক্ত রাজনীতির ব্যবস্থা বেশি কার্যকর হবে। এক্ষেত্রে সরকারকে শুধু মেধাভিত্তিক শিক্ষকদের সহায়তায় এই ব্যবস্থাটি করা প্রয়োজন।
শিক্ষার্থীরা কোন দলকে এবং নীতিকে ধারণ করবেন সেটা তাদের ওপরেই ছেড়ে দেওয়া ভালো। জোর করে অর্পণ করা আত্মঘাতী হয়ে দাঁড়ায়। এটাই আমরা দেখছি। এখানে উল্লেখ্য, আবরারের মৃত্যুর সঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সম্পর্ক ও জাতীয় স্বার্থও জড়িয়ে গেছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের ইতিহাসে আমরা এটা কখনও দেখিনি। সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের অতি সাধারণ দাবিগুলোর মধ্যে আমরা আমাদের অযোগ্যতা ঢাকার ও স্বার্থরক্ষার জন্য ষড়যন্ত্রের মন্ত্র খুঁজে বেড়াই। এই ষড়যন্ত্র তত্ত্বের সংস্কৃতি থেকে বের আসার সময় এখন। ষড়যন্ত্রের মন্ত্র না খুঁজে বরং বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থী বা শিক্ষকদের দাবির ওপর আস্থা রাখা দরকার। কারণ, এদের বেশিরভাগই দেশের সেরা মেধাবী সন্তান। তাই বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ থেকে শিক্ষার্থীদের মুক্তচিন্তার জায়গা করে দেয়া এখন সময়ের প্রয়োজন। এ বিষয়টি আমরা যত তাড়াতাড়ি অনুধাবন করবো ততই মঙ্গল। অন্যথায় আমি মোমবাতি হাতে শুধু অন্ধকার দেখি।
লেখক: অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

 

/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
উখিয়া ক্যাম্পে রোহিঙ্গা যুবককে কুপিয়ে হত্যা
উখিয়া ক্যাম্পে রোহিঙ্গা যুবককে কুপিয়ে হত্যা
গরমে পানির সংকট রাজধানীতে, যা বলছে ওয়াসা
গরমে পানির সংকট রাজধানীতে, যা বলছে ওয়াসা
গরমে নাকাল পথচারীদের জন্য পানির ব্যবস্থা করলো ফায়ার সার্ভিস
গরমে নাকাল পথচারীদের জন্য পানির ব্যবস্থা করলো ফায়ার সার্ভিস
বাংলাদেশ ও মরিশাসের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা
বাংলাদেশ ও মরিশাসের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ