X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

বাংলাদেশে নাগরিক সমাজের ভূমিকা কি ফুরিয়ে গিয়েছে?

মামুন রশীদ
২৯ এপ্রিল ২০২০, ১৩:১৩আপডেট : ২৯ এপ্রিল ২০২০, ১৩:১৪

মামুন রশীদ শিরোনামের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগেই নিশ্চিত করতে হবে নাগরিক সমাজ বলতে কী বোঝায়? ব্রিটিশ-ভারতে আমরা সরকার আর রাজনৈতিক দলের বাইরে এক বিদ্ব্যৎসমাজের অস্তিত্ব দেখতে পেয়েছিলাম, যারা অনেকটা সামাজিক ভালোমন্দের তথা অনুশাসনের দেখভাল করতেন, অনেক সময় সরকারকে সহায়তা করতেন, তবে বেশিরভাগ সময় সাধারণ লোকের ওপর সরকার, সরকারি প্রতিষ্ঠান তথা সরকারি লোকের বাড়াবাড়ির নজরদারি করতেন। আমরা মহাত্মা গান্ধী এমনকি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেও এই বিদ্ব্যৎসমাজের সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পাই। তারা ভারতবর্ষের স্বাধীনতা এবং তৎপরবর্তীতে সামাজিক তথা রাজনৈতিক অনুশাসন বলয় গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। তাদের অনেকেই প্রো-ইস্টাব্লিশমেন্ট বা প্রচলিত ধ্যান-ধারণার হলেও সুশিক্ষা বা স্বশিক্ষার কারণে কখনও সামাজিক বা সরকারের বাড়াবাড়িকে প্রশ্রয় দেননি। শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রসারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকাও রাখেন।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পরও আমরা এতদঞ্চলের শিক্ষক, আইনজীবী, বিচারক এমনকি কিছু চিকিৎসক ও সংস্কৃতিকর্মীর সমন্বয়ে একটি বিদ্ব্যৎসমাজ তথা নাগরিক সমাজের সরব উপস্থিতি দেখতে পাই। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন বিশেষ করে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের পাদপীঠ বা যৌক্তিক দর্শন বিনির্মাণে তাদের ভূমিকা ছিল উচ্চকিত। আমরা দেখি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাই তাদের অনেককে শনাক্ত করে হত্যা করতেও দ্বিধা করেনি। 

এমনকি ১৯৭১’র স্বাধীনতার পরও এই নাগরিক সমাজটি পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি। যারা একাত্তরে স্বাধীন বাংলা সরকারের সঙ্গে, বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছিলেন, নিপীড়িত হয়েছিলেন, তাদের অনেকেই আবার সদ্য-স্বাধীন দেশে নতুন সরকার ও তাদের অংশীজনের বাড়াবাড়ির উচ্চকিত প্রতিবাদ করেছিলেন। এমনকি ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পরও তাদের অনেকেই হারিয়ে যাননি এবং জাতির বিভিন্ন ক্রান্তিলগ্নে নাগরিক অনুভূতির পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। ২০০৭ সালের প্রচলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তনের চেষ্টাও অনেকটা নাগরিক সমাজের উদ্যোগ ছিল বলেই অধিকাংশের ধারণা।

২০০৯ সালে যে সরকারটি রাষ্ট্র পরিচালনার ম্যান্ডেট নিয়ে এলো তাদের সঙ্গে নাগরিক সমাজের অনেকেরই ছিল অনেক অনেক দিনের সখ্য। কিন্তু ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলটি যখন অত্যন্ত সফলভাবে ১৯৭১’র অপরাধীদের বিচার ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে একটি রব তুলতে সমর্থ হয়, তখন নাগরিক সমাজেও একটি চিড় ধরাতে সফলকাম হয়। অনেকেরই প্রাধিকার পাল্টে যায় এবং সরকার ও অনুষঙ্গীদের বিভিন্ন অন্যায় তাদের মনোযোগের বা বিবেচনার বাইরে চলে যায়। সেই সঙ্গে সরকার তার বিভিন্ন এজেন্সির মাধ্যমে নাগরিক সমাজের সদস্যদের অনেকেরই বিভিন্ন সময়ে অন্যায় বা অন্যায্য সুবিধা নেওয়া, সামাজিক অনাচার বা পারিবারিক কালো অধ্যায়ের খবর নথিবদ্ধ দেখিয়ে তাদের আকাঙ্ক্ষিত ভূমিকা থেকে পথচ্যুত করতে সফল হয়। সামান্য প্রতিবাদ বা গঠনমূলক সমালোচনার পথও অনেকটা সরু হয়ে যায়। সেই সঙ্গে সরকার অনেকটা বুদ্ধিমত্তার সঙ্গেই নিজেদের অনুগত বা আদর্শিকভাবে নিকটবর্তী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাংবাদিক এবং অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি ও সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি মোটামুটি গ্রহণযোগ্য বুদ্ধিজীবী সমাজ তৈরি করে ফেলে। তারা সমাজের ছোটখাটো বৈপরীত্য নিয়ে কথা বললেও বৃহত্তর অসঙ্গতি বা অনাচার নিয়ে অনেকটাই নীরব। এইসঙ্গে দুষ্ট পুঁজির মালিকদের সংবাদপত্র বা টেলিভিশন বা অন্য গণমাধ্যমের লাইসেন্স প্রদানও তথ্যপ্রবাহকে একমুখী করে ফেলে। ভিন্নমতকে একেবারে আস্তাকুঁড়ে ফেলে না দিলেও এধারাটি অনেক অনেক ক্ষীয়মাণ হয়ে পড়ে। তার সঙ্গে সমাজে দুর্বিনীত পুঁজির দাপটে সততা, নিষ্ঠা, দেশপ্রেম আর সাফল্য নতুন সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত হয়। সরকার এমনকি বিচারালয়ের অনেক সিদ্ধান্তই গণমাধ্যমের রিপোর্ট বা মিডিয়া ট্রায়াল দ্বারা প্রভাবিত হয় বা হচ্ছে। কে ভালো, কী ভালো, তা জানার জন্য সমাজের বিরাট একটি অংশ মিডিয়ানির্ভর হয়ে পড়ে। মিডিয়াকর্মীদেরও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রদান তাদের ধার অনেক কমিয়ে দেয়। সেই সঙ্গে পেশাগত অনিশ্চয়তা, সংসারের ব্যয় বেড়ে যাওয়া আর সমাজে ক্রমাগত লোভ-লালসার আধিপত্য তাদেরও অনেকটা দুর্বল করে দেয়। 

আমাদের মতো প্রায়শই রাজনৈতিক বাড়াবাড়ি, দুর্বল সুশাসন আর ন্যূনতম জবাবদিহি এবং বিচারহীনতার দেশে একটি শিক্ষিত, ন্যায়পরায়ণ, সংস্কৃতিমনস্ক ও আধুনিক নাগরিক সমাজের উপস্থিতির প্রয়োজনীয়তা প্রতিমুহূর্তে অনুভূত হলেও আজকের বাস্তব এবং নির্মম পরিস্থিতি তার সরব অভাবেরই বার্তা দেয়। 

তাই জাতির অনেক ক্রান্তিলগ্নে ন্যূনতম নজরদারি বা দেখভালের জন্যও আমরা আর নাগরিক সমাজের উপস্থিতি তেমন একটা টের পাই না বা সরকার খুব সহজেই তাদের অবজ্ঞা করতে পারছেন। 

পরিস্থিতি হয়তো পাল্টাবে কোনও এক সময়, কোনও এক নতুন সকালে।   

লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক

 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ