X
রবিবার, ০৫ মে ২০২৪
২২ বৈশাখ ১৪৩১

এমন ঈদ আসেনি জীবনে

আনিস আলমগীর
২৬ মে ২০২০, ১৪:১৫আপডেট : ২৬ মে ২০২০, ২০:৩৪

আনিস আলমগীর ঈদ মানেই তো পরিবারের সদস্য, বাড়ি-পাড়ার বন্ধুবান্ধব, মুরুব্বি এবং সমাজের নানা স্তরের লোকের সঙ্গে ঈদগাহে নামাজ পড়ে কুশল বিনিময়, হ্যান্ডশেক, কোলাকুলি। কিন্তু তার কিছুই করা গেলো না! নামাজ যদিও পড়া গেলো, কিন্তু কোনও ঈদগাহে না। মুখে মাস্ক, নিজ দায়িত্বে নামাজের জায়নামাজ বহন করে, মসজিদে দূরত্ব রেখে বসে ঈদের নামাজ পড়েছেন অনেকে। কেউ হয়তো করোনার ভয়ে তাও করিনি, ঘরেই প্রথমবারের মতো ঈদের নামাজ পড়েছি আমরা। এমন ঈদের নামাজ আমাদের কারও জীবনে আর আসেনি। অন্যের মুখটাও ঠিকমতো দেখা হলো না, কোনও কোলাকুলি না, হ্যান্ডশেকও না। এমন উষ্ণতাহীন ঈদ জীবদ্দশায় দেখতে হবে কেউ চিন্তাও করিনি। কিন্তু সবাইকে দেখতে হলো এমনটা- মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর ২০২০। শুধু বাংলাদেশে নয়, এই চিত্র ছিল পুরো বিশ্বে।

ঈদুল আজহা বা কুরবানি ঈদে পশু কুরবানি নিয়ে ব্যস্ত থাকে মানুষ, কিন্তু ঈদুল ফিতরে আত্মীয় স্বজনদের বাড়ি যাওয়া হয় বেশি। যারা শহরে থাকেন তাদের অনেকে ঈদের সময় গ্রামের বাড়ি যান- বাবা-মায়ের সঙ্গে, পরিবারের অন্যদের সঙ্গে ঈদ করতে। হালের বড় লোকেরা যেতেন অবকাশে, বিদেশ ভ্রমণে। এবার তাও হলো না। পুরোটাই আনন্দহীন, বিবর্ণ ঈদ। আর দশটা দিনের মতই সাদামাটা ভাবেই ২৫ মে সারাদেশে পালিত হয়েছে ঈদুল ফিতর।

ঈদ অর্থ আনন্দ হলেও এবারের ঈদকে কোনোভাবেই বলা যায় না আনন্দের দিন। অবশ্য আমরা যারা শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য ফিরিয়ে হেঁটে যাচ্ছি বার্ধক্যের দিকে- তাদের অনেককে ঈদ এখন আর আগের মতো আনন্দ দিতে পারে না। যাদের বাবা-মা মারা গেছেন তাদের কাছে তো ঈদ একেবারেই সাদামাটা। যাদের সন্তান আছে তারা তবু আনন্দ খোঁজেন ঈদের মধ্যে। পরিবার নিয়ে ঘুরতে যান, মুভি দেখতে যান, আত্মীয়ের বাড়ি যান অথবা দূরে কোথায় বেড়াতে যান।

আমাদের বয়সী সবার মতো আমিও ঈদ উপভোগ করেছি ছোটবেলায়। এখনকার ঈদের সঙ্গে তার তুলনা হয় না। আমাদের গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের মীরসরাই উপজেলার হিঙ্গুলীতে। ছোটবেলায় ঈদের জামা পেয়ে যতটা খুশি হয়েছি এখন শত জামাতেও সেই খুশি আসে না। ঈদে আব্বা যে সবসময় জামা কাপড় দিতেন তাও না, তারপরও দু’চারবার যা মিলতো তাতেই আনন্দ ধরে রাখা যেত না। সব জামার কথা মনে নেই, তবে একবার আমি একটি পাটের লুঙ্গি পেয়েছিলাম সেটি আমার এখনও খুব মনে পড়ে। ওই ধরনের লুঙ্গি আমি এখন বাজারে দেখি না। ঈদের সালামিও এখনকার মতো শত শত টাকা পাওয়া যেত না। আব্বা, বড় ভাইদের থেকে যেটুকু পাওয়া যেত সেটাতেই সন্তুষ্ট থাকতে হতো।

ঈদ আনন্দের বড় একটি উপসর্গ ছিল ঈদগাহের পাশে বসা অস্থায়ী মেলা। এখনকার বৈশাখী মেলার মতোই সব ধরনের জিনিসপত্র পাওয়া যেত। খেলনা, বাঁশি, জিলাপি, মিষ্টি জাতীয় সব খাবার, তোকমা দিয়ে বানানো রঙিন শরবত, বুট, পেঁয়াজু- সবই থাকতো। নতুন নতুন খেলনার জন্য আমরা ঈদ পর্যন্ত অপেক্ষা করতাম। যা পারতাম কিনে আনতাম ঈদের মেলা থেকে। ভাই বোন সবাই মিলে মজা করতাম। বড় ভাইয়েরাও হয়তো দামি খাবার কিছু কিনে আনতো মেলা থেকে।

এরপর ছিল বাড়িতে এসে সেমাই খাওয়ার জন্য লোকজনকে ঘরে ঘরে গিয়ে ডেকে আনা। এটা আব্বার তৈরি করা ট্রেডিশন ছিল। উনি যতদিন বেঁচে ছিলেন বাড়ির সবাইকে আসতে হতো আমাদের ঘরে সেমাই খাওয়ার জন্য। আর কোরবানির ঈদে ছিল আরও বড় আয়োজন। সবার আগে আমাদের গরু কাটা হয়ে যেত। গরু কাটা অবস্থাতেই আব্বা পেছনের একটি রান আর কলিজা-গুদ্দা-তিল্লি পাঠিয়ে দিতেন ঘরে, বড় পাতিলে রান্না হতো। সেটা অনেকটা মেজবানি টাইপ রান্না। আমাদের বাড়ি, পেছনের বাড়ি মিলে প্রায় ২৫/২৬ ফ্যামিলি ছিল। ঘরে ঘরে গিয়ে প্রত্যেককে আমন্ত্রণ জানাতে হতো। প্রত্যেকের ঘর থেকে অন্তত একজন সদস্য আসতেন। তারা চালের তৈরি রুটি দিয়ে গরম গরম রান্না করা গরুর মাংস খেতেন। রাতভর জেগে আমার আম্মা, ভাবিরা, বোনেরা এবং কিছু কাজের লোক এসব রুটি তৈরি করতো। যারা গরু কাটার জন্য আসতেন, তারাও কাজ শেষ করে যোগ দিতেন মাংস খাওয়ায়। এই যে আনন্দ, এই যে সৌহার্দ্য- আমি আর গ্রামে দেখি না। আব্বা নেই- যেন সব শেষ।

আব্বা-আম্মা মারা যাওয়ার পর আমার ঈদের আনন্দ পুরোটাই মাটি হয়ে গেছে। ওনারা বেঁচে থাকতে যেটুকু বাড়িতে যেতাম, মারা যাওয়ার পর পুরোটাই বন্ধ। দু’-একবার গিয়েছি কিন্তু যতবারই যাই তাদের সেই স্মৃতিগুলো আমাকে আনন্দ দেয় না বরং বেদনা জাগায়। তার ওপর রয়েছে ঈদে বাড়ি যাওয়ার ঝুঁকি-ঝামেলা। পুরো পরিবার চলে যাচ্ছে বাসের নিচে, ট্রাকের নিচে- ঈদযাত্রায়। ঈদে যাওয়ার সময় টিকিট কাটা, ঘণ্টার পরা ঘণ্টা লম্বা ট্রাফিক জ্যামের দুঃসহ স্মৃতি বাবা-মা থাকতে সহ্য করা গিয়েছে কিন্তু এখন সংসারী হয়ে এগুলোকে অসহনীয় মনে হয়। পুরো পরিবার নিয়ে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাওয়া, ঈদ করে ফিরে যথাসময়ে কাজে যোগ দেওয়ার চেয়ে বরং ঢাকা থেকে পশ্চিমা কোনও দেশে যাওয়া-আসা করা সহজ ও নিরাপদ মনে হয় আমার কাছে।

বাড়ি যাওয়ার কথা যখন এলো তখন এবারে বাড়ি ফেরার কথাটা বলতেই হয়। হাজার হাজার মানুষ এই করোনাকালে দুঃসহ যন্ত্রণা নিয়ে ঢাকা থেকে দেশের বাড়িতে গিয়েছে। বিশেষ করে আরিচা ঘাট দিয়ে ফেরি পারাপারের দৃশ্য ছিল খুব চোখে পড়ার মতো। করোনার সময় এভাবে গাদাগাদি করে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার মানে হচ্ছে হাজার হাজার লোক করোনা সংক্রমিত হওয়া। যারা গিয়েছে তাদের পরিবার-পরিজন যদি দেশের বাড়িতে থাকে, তাদের এরা ভাইরাস বিতরণ করছে।

এই যাওয়াটা কি অপরিহার্য ছিল! হয়তো কারও কারও ছিল। ঢাকায় নিম্ন আয়ের যেসব লোকজন বাস করে, ধরেন একজন রিকশাচালক, সে এই দীর্ঘ ছুটিতে করবে কী! ঢাকায় থাকতে হলে তাকে ন্যূনতম প্রতিদিন ১৫০ টাকা খরচ করতে হয় থাকা- খাওয়ার জন্য। এই সময়টাতে সে চলে গেলো গ্রামে ছেলেমেয়ে, স্ত্রী বা অন্য কোনও আত্মীয়-স্বজন থাকলে তাদের সঙ্গে দেখা করে এলো। তার টাকাও বেঁচে গেলো। তাছাড়া এখানে তো বলতে গেলে সে কাজহীন অবস্থায় আছে। এমন কাহিনিই বেশি।

অনেকের বাবা-মা গ্রামে আছেন। এই করোনাকালে যে উপলব্ধি- কেউ জানি না হয়তো আগামী ঈদে নিজের বাবা-মাকে পাবো কিনা। তারাও ছুটে গেছে ঈদ করতে স্বজনদের সঙ্গে। গার্মেন্টসে চাকরি করার ছেলেমেয়েগুলো গেছে একই চিন্তা করে। স্বজনের সঙ্গে ঈদ করা তাদের যে আনন্দ দেয়, ঢাকা, সাভার, নারায়ণগঞ্জের খুপরিতে, বস্তিতে, মেসে,  সেই আনন্দ তারা নিশ্চয়ই পায় না।

আমি আগেও বলেছিলাম, দেশের তো কারফিউ জারি হয়নি যে আপনি তাদের বাধা দিয়ে রাখবেন। কিন্তু সাধারণ পরিবহনে যাওয়া যাবে না, ব্যক্তিগত গাড়িতে যাওয়া যাবে বলে পুলিশ যে সিদ্ধান্ত দিয়েছে সেটি মোটেও প্রজাতন্ত্রের সিদ্ধান্ত হতে পারে না। গাড়িওয়ালা যাবে, বাকিদের পায়ে হাঁটতে হবে? সরকারি হাসপাতালে যদি করোনায় আক্রান্ত মুমূর্ষু কোনও রোগী থাকে- টাকাওয়ালাকে ভেন্টিলেটর দেবো, গরিব রোগী তা পাবে না—এই নীতি কি চলবে? ট্যাক্স কে কত দেয় তখন এটি বিবেচনায় নেওয়া যাবে না, রাষ্ট্রের মালিক সবাই। পুলিশ অ্যাপস দিয়ে চলাচল পাসের ব্যবস্থা করেছে- সেটি বাড়াবাড়ি ধরনের। তার চেয়ে বলে কয়ে কারফিউ থাকাই ভালো। মানুষের গতিবিধি দেখার অ্যাপস থাকলে বরং করোনা রোগীর সংস্পর্শে কারা এসেছে সেটা জেনে লাভ হতো।

যেকোনও পরিস্থিতিতে আমাদের অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ঈদপূর্ব ভাষণে বলেছেন, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পূর্বাভাসে বলা হচ্ছে এই মহামারি সহসা দূর হবে না। কিন্তু জীবন তো থেমে থাকবে না। যতদিন না কোনও প্রতিষেধক টিকা আবিষ্কার হচ্ছে, ততদিন করোনাভাইরাসকে সঙ্গী করেই হয়তো আমাদের বাঁচতে হবে। জীবন-জীবিকার স্বার্থে চালু করতে হবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড।’ গত দুই মাস ধরে যে লকডাউন চলছে তাতে ভাবা উচিত ছিল, যেহেতু আমরা সীমিত আকারে লকডাউন তুলে দিচ্ছি, স্বাস্থ্যসম্মতভাবে দূরপাল্লার যাতায়াতের ব্যবস্থাও চিন্তা করা। মানুষ চলাচল করতে না পারলে অর্থনীতির চাকা চলবে কী করে!

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।

[email protected]

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মন্ত্রী-এমপির স্বজনদের বিরত রাখা নীতিগত সিদ্ধান্ত, আইনি নয়: কাদের
মন্ত্রী-এমপির স্বজনদের বিরত রাখা নীতিগত সিদ্ধান্ত, আইনি নয়: কাদের
আইপিএলের সময়ে হবে পিএসএল!
আইপিএলের সময়ে হবে পিএসএল!
বাড়ি ফেরার পথে বজ্রাঘাতে বাবুর্চির মৃত্যু, সারা রাত রাস্তায় পড়ে ছিল লাশ
বাড়ি ফেরার পথে বজ্রাঘাতে বাবুর্চির মৃত্যু, সারা রাত রাস্তায় পড়ে ছিল লাশ
বাড়িতে বিস্ফোরণে আহত স্কুলছাত্রী মারা গেছে
বাড়িতে বিস্ফোরণে আহত স্কুলছাত্রী মারা গেছে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ