X
রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১

আমেরিকাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন ট্রাম্প!

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী
১১ জুন ২০২০, ১৫:৩২আপডেট : ১১ জুন ২০২০, ১৫:৩৪

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী আমেরিকায় ১৬১৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার গেমস্টন থেকে আসা একটি কালো লোককে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করা হয়েছিল। চার শত বছর পূর্বের এই ঘটনা থেকে ক্রীতদাসের ব্যবসা আরম্ভ হয়েছে। দক্ষিণ আমেরিকা ছিল কৃষি নির্ভর আর উত্তর আমেরিকা শিল্প সমৃদ্ধ এলাকা। কৃষি নির্ভর দক্ষিণ আমেরিকার খামারিদের জন্যই ক্রীতদাসের প্রয়োজন ছিল বেশি। আফ্রিকা থেকে দাস ব্যবসায়ীরা ক্রীতদাস এনে খামারিদের কাছে বিক্রি করত।
এখন আমেরিকায় ক্রীতদাস বংশোদ্ভূত লোক মোট জনসংখ্যার ১৩ শতাংশ। দীর্ঘ একশ’ বছর সংগ্রাম করে আফ্রিকান-আমেরিকানরা পূর্ণ নাগরিক হিসেবে তাদের অধিকার পেয়েছে সত্য, কিন্তু সাদারা অন্তর থেকে এখনও তাদের ঘৃণা করে। আসলে আমেরিকার এটা আদিপাপ। সমাজব্যবস্থায় এটাকে লালন করেছে। সাদা কালোর মাঝে বিয়ে আইনত নিষিদ্ধ ছিল। প্রজাতন্ত্র যখন সৃষ্টি হয়, তখন স্থপতিরা সুন্দর সুবিন্যস্ত একটি শাসনতন্ত্র রচনা করেছিলেন। তখনও ৮৮ লাখ কালো লোক ছিল, কিন্তু স্থপতিরা খুবই অর্থপূর্ণভাবে এত বড় একটা জনগোষ্ঠী সম্পর্কে নীরব ছিলেন।

স্থপতিদের কেউ কেউ বলতেন কালোরা সাদাদের পাঁচ ভাগের দুই ভাগ। সম্ভবত অসম্পূর্ণ মানুষ হয়তো সেই কারণে তারা তাদের সম্পর্কে কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছেননি। অথবা আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় দেখা গেছে যে ফেডারেলিস্ট এবং রয়েলিস্ট এই দুই ভাগে মানুষ বিভক্ত ছিল; রয়েলিস্টরা মনে করতো স্থপতিরা একটি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করবেন এবং সেই রাষ্ট্র ব্রিটিশ রানির আনুগত্য মেনে চলবে, আর দক্ষিণে খামারিরা হালের বলদের মতো ক্রীতদাসীকে ব্যবহার করতো, তাদের সম্পর্কে বেশি কথা বললে দক্ষিণের সমর্থন হারাতে হতো। সেজন্য স্থপতিরা কালোদের সম্পর্কে কিছু বলতে উৎসাহ বোধ করেননি।

জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুতে এখন যে সারা আমেরিকা উত্তপ্ত, ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ ব্যানারে যে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন চলছে, তাতে বর্ণবাদের সমর্থক প্রাচীন নেতাদের মূর্তি ভাঙা হচ্ছে অনেক স্থানে। ট্রাম্প এর বিরুদ্ধে বলছেন। তিনি বলছেন এটা দেশের কালচারাল ঐতিহ্য ধ্বংসের শামিল। বিরোধীরা প্রশ্ন তুলছে কোন কালচার? সেখানে নীরব ট্রাম্প।

বারাক ওবামা কালোদের সন্তান। তিনি রাজ্য বিধানসভায় সাত বছর সদস্য ছিলেন, আবার সিনেটরও ছিলেন। পণ্ডিত ব্যক্তি, সুবক্তা। তিনি ২০০৮ এবং ২০১২ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন সাদাদের সম্প্রীতির ইমোশনকে ব্যবহার করে। কালো ওবামার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়াতে বর্ণবাদী গোষ্ঠী কখনও সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তাই তারা ২০১৬ সালের নির্বাচনে কট্টর বর্ণবাদী ট্রাম্পকে নির্বাচিত করেছিলেন। ট্রাম্প নির্বাচিত হয়ে ওবামার বহু জনহিতকর কর্মসূচি বাতিল করে দিয়েছিলেন। আবার ল্যাটিন আমেরিকানদের যুক্তরাষ্ট্রে আসা বন্ধ করার জন্য মেক্সিকো সীমান্তে প্রাচীর নির্মাণের কথা বলেছিলেন। মুসলমান অভিভাসীদের বিরুদ্ধেও নানা প্রতিবন্ধক কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন।

অর্থাৎ তার ধারণার বর্ণবাদ সাদা-কালোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, তার দৃষ্টিতে সাদারা ছাড়া বাকি আমেরিকানরা এক বর্ণের। তাদের বিরুদ্ধে তার ঘৃণা, তার বর্ণবিদ্বেষ ব্যাপক। এখন বর্ণবাদীরা আগামী নির্বাচনে ট্রাম্পকেই আবার জেতাতে চায়। তাই তারা বর্ণবিদ্বেষকে উস্কে দিয়ে সাদাদের একজোট করতে তৎপর, যেন ট্রাম্প সহজে নির্বাচিত হতে পারেন।

তবে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ক্ষেপে আছে তার দলের অনেক শীর্ষ নেতা। প্রেসিডেন্ট ডব্লিউ বুশ, ২০১২ সালের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার কাছে পরাজিত রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী মিট রোমনি, প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলিন পাওয়েল তাকে সমর্থন করছেন না। ২০০৮ সালের রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী জন ম্যাককেইন বেঁচে থাকলে তিনিও হয়তো ট্রাম্পের বিরোধিতা করতেন, কারণ তার সম্পর্কেও অবমাননাকর বক্তব্য রেখেছেন ট্রাম্প। কাকে আঘাত করেনি ট্রাম্প, সেটা ভেবে দেখার বিষয়!

আসছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পকে নয়, বরং ডেমোক্রেট মনোনীত প্রার্থী জো বাইডেনকে ভোট দেবেন বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও মার্কিন সেনাবাহিনীর চার তারকা জেনারেল কলিন পাওয়েল। আর এ কারণে কলিন পাওয়েলের ওপর বেজায় খেপেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। রিপাবলিকান দলের কৃষ্ণাঙ্গ নেতা কলিন পাওয়েল সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের প্রশাসনে ছিলেন। স্পষ্টবাদী হিসেবে পরিচিত কলিন পাওয়েল ২০১৬ সালের নির্বাচনের আগেই বলেছিলেন, দলের হলেও ট্রাম্পকে তিনি ভোট দেবেন না। ৭ জুন আবার তিনি একই কথা বলেছেন। তিনি বলেন, পরিস্থিতি এবারে আরও নাজুক। তাই ট্রাম্পকে নয়, আসছে নির্বাচনে ডেমোক্রেট মনোনীত জো বাইডেনকে তিনি ভোট দেবেন।

সিএনএন-এর জ্যাক টাপারকে দেওয়া ইন্টারভিউতে কলিন পাওয়েলের অভিযোগ ডোনাল্ড ট্রাম্প সংবিধান থেকে সরে গিয়েছেন এবং তার বিরুদ্ধে প্রাক্তন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের তালিকা বাড়ছে। জর্জ ফ্লয়েডের হত্যার ঘটনায় দেশব্যাপী বিক্ষোভে ট্রাম্প যেভাবে আপসহীন ভাব ধরে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন তার তীব্র সমালোচক তারা।

বর্ণবাদী পুলিশ কর্তৃক জর্জ ফ্লয়েডের হত্যা সারা আমেরিকাতো উত্তপ্তই, সারা বিশ্বেও প্রতিবাদের ঝড় বয়ে যাচ্ছে। বারাক ওবামা এটিকে সমর্থন করেছেন এবং পুলিশ আইনের আমূল সংস্কারের জন্য ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। শুধু তিনি নন বাকি প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ, বিল ক্লিনটনও সংগ্রামরত মানুষদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছেন। জীবিত সব মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিরুদ্ধে। আওয়াজ যখন উঠেছে আইন একদিন নিশ্চয়ই পরিবর্তন হবে।

মিট রোমনিতো স্বয়ং রাস্তায় নেমে ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনকারীদের মিছিলে অংশ নিয়ে সমর্থন জানিয়েছেন। এতে বুঝা যাচ্ছে যে মিট রোমনি ডেমোক্রেট প্রার্থী জো বাইডেনকে ভোট দিতে যাচ্ছেন। পাওয়েল যেদিন প্রকাশ্যে বাইডেনের পক্ষ নিয়েছেন, রোমনি সেদিন রাস্তায় নেমেছেন। সে কারণে সোশ্যাল মিডিয়ায় বর্ণবাদীদের আক্রমণের শিকার হচ্ছেন রোমনি। ‘ট্রাম্প আর্মি’ চরম ক্ষিপ্ত রোমনির ওপর। এসব ঘটনায় প্রাক্তন রিপাবলিকান আর নব্য রিপাবলিকানদের বিরোধও প্রকাশ্যে চলে আসছে।

ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা কমছে জো বাইডেনের তুলনায়। এমনকি চলতি সপ্তাহে ট্রাম্পের সমর্থক ফক্স নিউজও দেখাচ্ছে ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা ১৪ শতাংশ কমেছে বাইডেন থেকে। রিপাবলিকান শিবিরে ট্রাম্পের সমালোচকের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চললেও আগামী ৩ নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তা কোনও গুরুত্ব বহন করে কিনা, এখনও বড় প্রশ্ন হিসেবে রয়ে যাচ্ছে। তবে এটুকু চোখ বন্ধ করে বলা যায়, বর্ণবাদীদের একজোট করে ট্রাম্প যদি পুনরায় নির্বাচিত হন তবে আমেরিকার সংহতি মহাবিপদের মুখে পড়বে।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সিলেটে ট্রাকের ধাক্কায় ৩ মোটরসাইকেল আরোহী নিহত
সিলেটে ট্রাকের ধাক্কায় ৩ মোটরসাইকেল আরোহী নিহত
আবারও জীবিত দুই জিম্মির ভিডিও প্রকাশ করেছে হামাস
আবারও জীবিত দুই জিম্মির ভিডিও প্রকাশ করেছে হামাস
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
টিভিতে আজকের খেলা (২৮ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৮ এপ্রিল, ২০২৪)
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ