X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

কবে হবে ইতিহাস, ঐতিহ্য ও চেতনার উন্নয়ন

কাবিল সাদি
৩১ জানুয়ারি ২০২১, ১৮:৫০আপডেট : ৩১ জানুয়ারি ২০২১, ১৮:৫০

কাবিল সাদি একটি দেশের অন্যতম সম্পদ সে দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের মূল্যায়ন এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তা সঠিক ও সুন্দরভাবে উপস্থাপন। আবার একইভাবে সে দেশের রাষ্ট্রীয় দীনতা প্রকাশ পায় ইতিহাস ঐতিহ্যকে ভুলে যাওয়া, অবমূল্যায়ন অথবা বিকৃতভাবে উপস্থাপন করার মধ্য দিয়ে। বর্তমান সময়ে এ দেশে অর্থনীতি, শিক্ষা ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রশংসা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেলেও আমাদের মানসিক দীনতার উন্নয়ন কতটা হয়েছে এবং এই উন্নয়নকে টেকসই উন্নয়ন বলা যাবে কিনা সেটা নিয়েই এক ধরনের দ্বিধা রয়েছে।

২.

গত এক দশকে যে বিষয়টি আমাদের সামনে এসেছে, বিশেষত তরুণ শিক্ষিত সমাজের সামনে গুরুত্ব পেয়েছে, তা হলো ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’। কার্যত এই চেতনাকে কেন্দ্র করেই প্রণীত হয় আমাদের মহান সংবিধান বা আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনযাপন কিন্তু এই একটি শব্দকে পুঁজি করেই রাজনীতির নামে পুরো জাতিই যেন দুই ভাগে বিভক্ত। একদল হলো চেতনার পক্ষে আর স্বভাবতই ভিন্ন দল বিপক্ষে। তবে এই চেতনার আদর্শ আমরা আসলেই ধারণ করেছি কিনা বা আদৌ এটার চর্চা সঠিকভাবে হচ্ছে কিনা সেদিকে নজর দেওয়া খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ, অনেকেই ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র নামে নানা ধরনের অনৈতিক সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করে। এটা দল থেকে শুরু করে ব্যক্তিপর্যায়েও চলে গেছে। এদের মূল লক্ষ্য ‘লোক দেখানো দেশপ্রেমে’র পেছনে নানা রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার জন্য চেতনার লেবাস পরিহিত মায়া কান্না।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রায়ই দেখা যায় কিছু তরুণদের কোনও টেলিভিশন থেকে সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় বিশেষ দিবস নিয়ে তারা খুব বেশি ধারণা রাখেন না। বিশেষ করে নিজ দেশের বিশেষ দিবস নিয়ে। অনেক সময় দুঃখজনক হলেও দেখা যায় তারা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ বা ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সদুত্তর দিতে ব্যর্থ হন। বিষয়টা রীতিমতো উদ্বেগজনক। মাস খানেক আগেই একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। যেখানে বর্তমানে নানাভাবে আলোচিত সমালোচিত মাওলানা জনাব গিয়াস উদ্দিন তাহেরি সাহেবের ভিডিও ক্লিপ, যেখানে তিনি অতি আবেগী হয়ে উপস্থিত ব্যক্তিদের বয়ান দিচ্ছেন এই বলে যে, ‘১৯৭১ সালে নাকি বাংলা ভাষার জন্য বুকের তাজা রক্ত দিয়ে ত্রিশ লক্ষ শহীদের বিনিময়ে আমরা দেশের স্বাধীনতা অর্জন করেছি।’ তিনি ইতিহাসের নতুন অনুচ্ছেদ যুক্ত করলেন এবং উপস্থিত সাধারণ ধর্মপ্রাণ জনতাও সেটা মেনে নিলেন বলে প্রতীয়মান হলো। কারণ, কেউ তো প্রতিবাদ করেনি।

এ ধরনের ঘটনা মজা হিসেবে নিলেও এটা কি সত্যিকার অর্থে মজা পাওয়ার বিষয় ছিল? আমরা আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য নিয়ে কি হাসবো অথবা কেউ ভুল তথ্য দিলেই সেটাকে কৌতুক হিসেবে নেবো? গত একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আবারও দৃষ্টিগোচর হলো একটি সংবাদ, যেখানে এ দিবস উপলক্ষে করা ব্যানারে দেওয়া হয়েছে সাত বীর শ্রেষ্ঠদের ছবি এবং তাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলো ভাষা শহীদ হিসেবে। আর এসব কাজে প্রশাসন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় সকলেই সম্পৃক্ত। শিক্ষা ও চেতনার মননশীলতার কতটা তলানিতে আমরা অবস্থান করছি একবার ভেবে দেখুন, একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ও শিক্ষার্থীরা ভাষা শহীদ এবং মুক্তিযুদ্ধের বীর শ্রেষ্ঠদের চিনতে পারেননি।

যদি শিক্ষকরাই ভুল করে বসেন তাহলে তারা শিক্ষার্থীদের কী ইতিহাস শেখাবেন, জানাবেন এবং চর্চায় উদ্বুদ্ধ করবেন। একজন প্রথাগত শিক্ষাহীন কথিত মাওলানার সাথে এদের পার্থক্য কোথায়? যদিও বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষকরা দাবি করেছেন, বিষয়টি নজরে পড়েনি। এটা বলেই তারা দায় এড়িয়ে গেলেন। তারা কি এভাবে দায় এড়াতে পারেন? ইতিহাসকে তাচ্ছিল্য করার বিষয়কে এভাবে এড়িয়ে যাওয়া কতখানি আইনসম্মত বা নীতিসম্মত?

হয়তো এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলেই আমরা মেনে নীতি শিখে গেছি আর এজন্যই ২০২০ সালের মহান বিজয় দিবসে আমাদের দেখতে হলো আরেক নজিরবিহীন বিজয় দিবস উদযাপন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শহীদ মিনারের ছবি যুক্ত করে উদযাপন করেছেন মহান বিজয় দিবস। যে অনুষ্ঠানেও উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণ শিক্ষকসহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা। অন্যদিকে সদ্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা করা বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এগুলো ছাপিয়ে আরও এগিয়ে গেছেন। তাদের অনুষ্ঠানের পতাকার সবুজের বুকে লাল বৃত্ত হয়ে আছে চতুর্ভুজ। কতটা ধৃষ্টতা দেখালে এমন কাজ করা সম্ভব। আমাদের মহান সংবিধানে যে জাতীয় পতাকার চিত্র উল্লেখ করে দেওয়া হয়েছে সে চিত্রকে তারা অস্বীকার করে ভিন্ন পতাকার জন্ম দিয়ে সাংবিধানিক অসম্মানের সাথে দেশবিরোধী অপরাধ করেছেন কিনা তা আমাদের আইন প্রণেতারাই ভালো বলতে পারবেন।

যারা এসব কাজে যুক্ত তারা কেউই মানসিক ও মানবিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী কিনা সেটা ভাববার বিষয়। আর তাদের দায়িত্ব জ্ঞানহীন ইতিহাস চর্চার আদৌ কোনও প্রয়োজন আমাদের আছে কিনা সেটাও ভাবার সময় এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জ্ঞানচর্চা ও এদের দায়িত্বে কারা রয়েছেন এবং তারা শিক্ষা ব্যবস্থা ও আমাদের দেশপ্রেমকে কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছেন তা নিয়ে সংশ্লিষ্টদের এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে এবং সেই সাথে এগুলো দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের অংশ কিনা সেটাও আমলে নিতে হবে।

৩.

আমরা আসলে অবাক হতে হতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি, তাই আর অবাক হই না। আমাদের রাজনৈতিক দীনতাই হয়তো এসব কর্মকাণ্ডের জন্য অনেকটা দায়ী। ক্ষমতার পালাবদলে যে দেশে ইতিহাসের বিষয়বস্তু পরিবর্তন হয় সে দেশের ইতিহাসে আস্থা রাখা বা সঠিক ঐতিহ্য চর্চা অসম্ভব। বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এলে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঠাঁই হয় ইতিহাস বইয়ের গুরুত্বহীন পাতার এক কোনায়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ইতিহাসের সত্য ফুটে ওঠে বইয়ের পাতায় পাতায়। এখন একজন শিক্ষার্থী ক্ষমতার পালাবদলে দু’ধরনের ইতিহাস পাঠ করেন কয়েক বছরের ব্যবধানে। এসব তো আমাদের সময়ই হতে দেখেছি। যার ফলে কে ভাষা শহীদ, আর কে মহান মুক্তিযুদ্ধের বীরশ্রেষ্ঠ তা চেনাও অনেকের কাছে ধাঁধার মতো মনে হয়। আর আমাদের অনেক শিক্ষকরা শিক্ষকতার চেয়ে সাদা-কালো, লাল-নীল বাহারি রঙে বিভক্ত হয়ে শিক্ষা বা জ্ঞানচর্চার চেয়ে রাজনীতি চর্চায় ব্যস্ত থাকতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, আর এজন্য ভাষা শহীদ বা বীরশ্রেষ্ঠ চেনা তাদের কর্মসূচিতে পড়ে না।

৪.

কথায় আছে, ‘যে দেশে গুণীদের কদর করা হয় না, সে দেশে গুণীর জন্ম হয় না।’ আমরা অনেকে ভাষা শহীদদের চিনি না, বীরশ্রেষ্ঠদের চিনি না। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, সম্পাদক শামছুল হক অথবা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, এ. কে ফজলুল হক এবং বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সুদীর্ঘ নয় মাস স্বাধীন দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনসহ তৎকালীন জাতীয় নেতাদের অবদান তো দূরের কথা, নামও হয়তো অনেকে জানেন না। তাদের চোখে কে বীরশ্রেষ্ঠ বা কে ভাষা শহীদ, সেটা তো আরও কঠিন হবে এটাই স্বাভাবিক।

এই না জানার পেছনে রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক অনীহার পাশাপাশি জাতীয় পর্যায়ের গণমাধ্যমগুলোর ভূমিকাও দুঃখজনকভাবে দায়ী। এসব ত্যাগী নেতাদের জন্ম-মৃত্যু বার্ষিকীতে স্থান দেওয়া হয় পত্রিকাগুলোর চেহলাম বা ভেতরের পাতার এক প্রান্তে। একটি সময় সে পাতাতেও তাদের ঠাঁই হবে না তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

৫.

বর্তমান সময়ের সরকার উন্নয়নমুখী সরকার, কিন্তু তার এই উন্নয়ন গতিধারা ধরে রাখতে হলে উন্নয়নের অন্যতম ভীত ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঠিক চর্চা এবং আমাদের সূর্য সন্তানদের সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। কারণ, টেকসই উন্নয়নের অন্যতম উপাদান হলো প্রত্যেকটি দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের চর্চা ও যথাযোগ্য মূল্যায়ন। না হলে
ভিত মজবুত না করা বিল্ডিংয়ের মতো দূর থেকে যেমন দৃশ্যমান হয়ে অনেক দূর পর্যন্ত তার উপস্থিতি জানান দিলেও তা যেকোনও মুহূর্তে ধসে পড়তে পারে। তাই আমরা যদি আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ভিতকে শক্ত না করে ফিজিক্যাল (অবকাঠামো ও অন্যান্য দৃশ্যমান) উন্নয়নেই সান্ত্বনা খুঁজি তাহলে যেকোনও সময় সে উন্নয়নকে থামিয়ে ধসিয়ে দিতে পারে পুরো উন্নয়ন কাঠামোকে। তাই সংশ্লিষ্ট সবার উচিত বিষয়গুলোর গুরুত্ব অনুধাবন করে আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য মূল্যায়নের পাশাপাশি মহামানবদের অবদান যথাযোগ্যভাবে পাঠ্যবই, গণমাধ্যম, অবকাঠামো নামকরণের মাঝে তুলে ধরতে হবে জাতি-ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বাস্তবে রূপ দিতে এটাই হোক আমাদের মুজিববর্ষের মহান চেতনা।

লেখক: ব্যাংক কর্মকর্তা।
[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রেলের প্রতিটি টিকিটের জন্য গড়ে হিট পড়েছে ৫ শতাধিক
রেলের প্রতিটি টিকিটের জন্য গড়ে হিট পড়েছে ৫ শতাধিক
একসঙ্গে ইফতার করলেন ছাত্রলীগ-ছাত্রদলসহ সব ছাত্রসংগঠনের নেতারা
একসঙ্গে ইফতার করলেন ছাত্রলীগ-ছাত্রদলসহ সব ছাত্রসংগঠনের নেতারা
শনিবার সকালে আবার অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা বুয়েট শিক্ষার্থীদের
শনিবার সকালে আবার অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা বুয়েট শিক্ষার্থীদের
ইসরায়েল যা যা অস্ত্র চেয়েছিল সব পায়নি: মার্কিন সেনাপ্রধান
ইসরায়েল যা যা অস্ত্র চেয়েছিল সব পায়নি: মার্কিন সেনাপ্রধান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ