X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

ডিজিটাল সুরক্ষা আইন নিয়ে বিতর্ক, সমাধান কোন পথে?

মো. জাকির হোসেন
০৯ মার্চ ২০২১, ১৩:৪২আপডেট : ০৯ মার্চ ২০২১, ২২:০৩

মো. জাকির হোসেন ১০ মাস কারাবন্দি থাকার পর কারা হেফাজতে মুশতাক আহমেদের মৃত্যুকে ঘিরে আবারও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক শুরু হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা বা সাইবার সুরক্ষা আইন কি কেবল বাংলাদেশেই আছে, না পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও আছে? জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থা আঙ্কটাড-এর Cybercrime Legislation Worldwide-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের ৮০ শতাংশ দেশে ইতোমধ্যে সাইবার সুরক্ষা আইন প্রণীত হয়েছে, ৫ শতাংশ রাষ্ট্রে খসড়া আইন রয়েছে, ১৩ শতাংশের সাইবার আইন নেই আর ২ শতাংশ রাষ্ট্রের বিষয়ে তথ্য নেই। প্রতিবেদন অনুযায়ী সাইবার সুরক্ষা আইনে চারটি বিষয় স্থান পেয়েছে–ই-লেনদেন, ডাটা ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা, সাইবার অপরাধ এবং ভোক্তা সুরক্ষা। ই- লেনদেন বিষয়ে আইন রয়েছে ৮২ শতাংশ রাষ্ট্রে, ডাটা ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা সুরক্ষা বিষয়ে আইন রয়েছে ৬৬ শতাংশ রাষ্ট্রে, সাইবার অপরাধের বিরুদ্ধে আইন রয়েছে ৮০ শতাংশ রাষ্ট্রে আর ভোক্তা সুরক্ষা বিষয়ে ৫৬ শতাংশ রাষ্ট্রে সাইবার আইন রয়েছে। আমাদের আশপাশের রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে যাদের সাইবার সুরক্ষা আইন রয়েছে তাদের মধ্যে ভারত, শ্রীলংকা, নেপাল, চীন, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপিন, ইন্দোনেশিয়া, তাইওয়ান, জাপান, ভিয়েতনাম ও হংকংয়ের নাম উল্লেখযোগ্য। এসব রাষ্ট্রের মধ্যে ভিয়েতনামের সাইবার নিরাপত্তা আইনের সঙ্গে বাংলাদেশের ডিজিটাল সুরক্ষা আইনের ব্যাপক সাদৃশ্য রয়েছে। সাইবার স্পেস বিশেষ করে ফেসবুকে মানুষের ব্যক্তিগত বিষয়, মানহানি, অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ ভাষায় কাউকে আক্রমণ, ধর্মীয় অনুভূতিতে আক্রমণ, মিথ্যাচার, অপপ্রচার, গুজব, উসকানি, পর্নো দৃশ্য ছড়িয়ে দেয়া, ধর্ষণ করে ধর্ষণের ভিডিও ছড়িয়ে দেয়া, মিথ্যা এডিট করা ভিডিও কিংবা প্রেমিক-প্রেমিকা, এমনকি স্বামী-স্ত্রীর ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের দৃশ্য তথা নারীর প্রতি ভয়ানক সাইবার ভায়োলেন্সের কথা প্রতিনিয়ত পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়। আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সাইবার হামলা, হ্যাকিং নৈমিত্তিক বিষয় হয়ে উঠছে। এমন জাতীয় ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে সাইবার বা ডিজিটাল সুরক্ষা আইনের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার উপায় নেই।

প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের ডিজিটাল সুরক্ষা আই নিয়ে কেন এত বিতর্ক, উদ্বেগ? কী আছে এই আইনে? মোটা দাগে এই আইনের বিষয়গুলো হলো–

এক. এই আইনে ১৯২৩ সালের অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট যুক্ত করা হয়েছে। ফলে কোনও সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থার অতি গোপনীয় বা গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত ধারণ, প্রেরণ বা সংরক্ষণ করা হয়, বা প্রকাশ করে বা কাউকে করতে সহায়তা করে ওই আইন ভঙ্গ করলে এই আইনে সর্বোচ্চ ১৪ বছরের সাজা হতে পারে, ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে।

দুই. কোনও সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থার অতি গোপনীয় বা গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত যদি কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনও ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধারণ, প্রেরণ বা সংরক্ষণ করা হয়, তাহলে তা গুপ্তচরবৃত্তি বলে গণ্য হবে এবং এজন্য ৫ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা হতে পারে।

তিন. এই আইনে ডিজিটাল মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা জাতির পিতার নামে প্রোপাগান্ডা বা প্রচারণা চালালে বা মদত দিলে অনধিক ১০ বছরের কারাদণ্ড বা এক কোটি টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে।

চার. ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে আক্রমণাত্মক, মিথ্যা, ভীতি প্রদর্শক তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ, মানহানিকর তথ্য প্রকাশ, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো, ঘৃণা প্রকাশ, অনুমতি ছাড়া ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ, প্রকাশ বা ব্যবহার করলে তিন থেকে সাত বছরের কারাদণ্ড, জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে। দ্বিতীয়বার এরকম অপরাধ করলে ১০ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে।

পাঁচ. ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে প্রতারণা করলে অনধিক ৫ বছরের কারাদণ্ড, ৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয়দণ্ড হতে পারে।

ছয়. কম্পিউটার হ্যাকিংয়ের বিষয়েও বিধান রয়েছে এই আইনে। ১৫ ধারায় বলা হয়েছে, কম্পিউটার, কম্পিউটার প্রোগ্রাম. কম্পিউটার সিস্টেম বা কম্পিউটার নেটওয়ার্ক বা ডিভাইস, ডিজিটাল সিস্টেম বা ডিজিটাল নেটওয়ার্কে প্রবেশাধিকার ব্যাহত করে, এমন ডিজিটাল সন্ত্রাসী কাজের জন্য অপরাধী হবেন এবং এজন্য অনধিক ১৪ বছর কারাদণ্ড অথবা অনধিক এক কোটি অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে।

সাত. ছবি বিকৃতি বা অসৎ উদ্দেশ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে বা অজ্ঞাতসারে কারো ব্যক্তিগত ছবি তোলা, প্রকাশ করা বা বিকৃত করা বা ধারণ করার মতো অপরাধ করলে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে। ইন্টারনেটে পর্নোগ্রাফি ও শিশু পর্নোগ্রাফির অপরাধে সাত বছর কারাদণ্ড বা পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।

আট. কোনও ব্যাংক, বিমা বা আর্থিক সেবা প্রতিষ্ঠান থেকে কোনও ইলেকট্রনিক বা ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে আইনানুগ কর্তৃত্ব ছাড়া অনলাইন লেনদেন করলে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড, পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।

নয়. ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিচার হবে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে। অভিযোগ গঠনের ১৮০ কার্যদিবসের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করতে হবে। তবে এরমধ্যে করা সম্ভব না হলে সর্বোচ্চ ৯০ কার্যদিবস পর্যন্ত বাড়ানো যাবে। এই আইনে অতিরাষ্ট্রিক প্রয়োগের কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশ বা বিশ্বের যেকোনও স্থানে বসে বাংলাদেশের কোনও নাগরিক যদি এই আইন লঙ্ঘন করেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে এই আইনে বিচার করা যাবে।

দশ. আইনের ২৫, ২৮, ২৯ ও ৩১ ধারায় ডিজিটাল মাধ্যমে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, কারো মানহানি কিংবা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি বা আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানোর মতো বিষয়গুলোকে অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এসব অপরাধের শাস্তি ক্ষেত্রবিশেষে তিন থেকে সাত বছরের কারাদণ্ড।

এগারো. ডিজিটাল মাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত কোনও তথ্য-উপাত্ত দেশের সংহতি, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ বা জনশৃঙ্খলা ক্ষুণ্ণ করলে বা জাতিগত বিদ্বেষ ও ঘৃণা সৃষ্টি করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তা ব্লক বা অপসারণের জন্য টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসিকে অনুরোধ করতে পারবে। এক্ষেত্রে পুলিশ পরোয়ানা বা অনুমোদন ছাড়াই তল্লাশি, জব্দ এবং গ্রেফতার করতে পারবে।

এই আইনের বিরুদ্ধে কয়েকটি অভিযোগ-উদ্বেগ হলো –

এক. এটি মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে মারাত্মকভাকে হুমকিতে ফেলবে।

দুই. এই আইন প্রয়োগ করে সরকার ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করে বিরুদ্ধ বা ভিন্ন মতকে দমন করতে চান।

তিন. এই আইনে পরোয়ানা ছাড়াই তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেফতারের বিধান সংযোজন করায় এবং ১৪টি ধারার অপরাধ জামিন অযোগ্য বিধায় এটি মানবাধিকার তথা ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকারকে ঝুঁকির মুখে ফেলবে।

চার. এই আইনের বেশ কিছু ধারা ও বিষয় অস্পষ্ট রাখা হয়েছে বিধায় মারাত্মক অপব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, সরকারি গোপনীয়তা, রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ ইত্যাদি।

এবার দেখা যাক, এই আইনের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ-উদ্বেগ কতখানি সত্যি। আইনের ৩২ ধারায় বলা হয়েছে, ডিজিটাল মাধ্যমে সরকারি গোপনীয়তা ভঙ্গ করা হলে ১৪ বছরের সাজা। প্রশ্ন হলো, সরকারি গোপনীয়তা কী? কোন কোন বিষয় গোপনীয়তার অন্তর্ভুক্ত? গোপনীয়তার সংজ্ঞা বা সুনির্দিষ্ট তালিকা উল্লেখ না থাকায় এই আইনের অপব্যবহারে সুযোগ রয়েছে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি চাকরির মৌখিক পরীক্ষায় একজন প্রার্থী কত নম্বর পেয়েছে তা জানতে দেওয়া হয়নি গোপনীয়তার অস্পষ্টতার অজুহাতে। এটি কী সঠিক? অবশ্যই না। কারণ, একজন প্রার্থীর জানার অধিকার আছে সে লিখিত পরীক্ষা, না মৌখিক পরীক্ষার কারণে যোগ্য বিবেচিত হয়নি। তাছাড়া পরবর্তী পরীক্ষায় তাকে লিখিত না মৌখিক পরীক্ষায় বেশি জোর দিতে হবে সেজন্যও এ তথ্য জানা দরকার। এই আইনে গোপনীয়তার অস্পষ্টতা সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য হুমকি। সরকার অফিসিয়ালি যেটা জনগণকে জানাচ্ছে না, সেটা খুঁজে বের করে জনগণকে জানানো সংবাদপত্রের তথা সাংবাদিকদের কাজ।

বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তাদান করা হইল’। আর ৩৯(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে (ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের, এবং (খ) সংবাদ ক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল’। সংবিধানের বক্তব্য অনুযায়ী চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা শর্তহীনভাবে নিশ্চয়তাদান করা হয়েছে। অন্যদিকে বাক্ ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিরঙ্কুশ নয়, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতা কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধের শর্তযুক্ত। কিন্তু বাক্ ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সরকারি গোপনীয়তার শর্তযুক্ত নয় বিধায় এটি সংবিধানের সাথে অসামঞ্জস্য। আমাদের সংবিধানে মৌলিক অধিকারের বিধানের সাথে অসামঞ্জস্য কোনও আইন প্রণয়ন করতে রাষ্ট্রকে নিষেধ করা হয়েছে।

এই বিষয়ে সংবিধানের ২৬(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র এই ভাগের (মৌলিক অধিকারের) কোন বিধানের সহিত অসামঞ্জস্য কোন আইন প্রণয়ন করিবেন না এবং অনুরূপ কোন আইন প্রণীত হইলে তাহা এই ভাগের কোন বিধানের সহিত যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইয়া যাইবে’।

এই আইনের ৪৩ ধারায় পরোয়ানা ছাড়াই তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেফতারের যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তাতেও গণমাধ্যমকর্মীরা চাপের মুখে পড়বেন বলে আশঙ্কা রয়েছে। কারণ, এই ধারার বিধানের সুযোগ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতি উৎসাহী কোনও কর্মকর্তা যেকোনও সময় গণমাধ্যম অফিসে এসে তল্লাশি করতে পারেন। তিনি যদি মনে করেন তদন্তের স্বার্থে মিডিয়ার সার্ভারে তার ঢোকা দরকার এবং তিনি যদি ইচ্ছাখুশি সার্ভার কিংবা সংবাদ প্রকাশের কাজে নিয়োজিত কম্পিউটার জব্দ করেন, তাহলে অপরাধের আলামত থাকুক আর না থাকুক সার্ভার কিংবা কম্পিউটার জব্দ হওয়ায় ওইদিনের সংবাদপত্র প্রকাশনা বন্ধ হওয়ার হুমকি সৃষ্টি হবে। এই ধারা বিধানকে অপব্যবহার করে এমনকি খবরের কাগজ বন্ধ করার সরকারি আদেশ না দিয়েও সংবাদপত্র প্রকাশে বিঘ্ন সৃষ্টি করা সম্ভব শুধু সার্ভার ও অফিসিয়াল কম্পিউটার জব্দ করার মাধ্যমে।

ডিজিটাল সুরক্ষা আইনের ২৫, ২৮, ২৯ ও ৩১ ধারায় ডিজিটাল মাধ্যমে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, কারো মানহানি কিংবা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি বা আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটানোর মতো বিষয়গুলোকে অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আর এসব অপরাধের শাস্তি ক্ষেত্র বিশেষে তিন থেকে সাত বছরের কারাদণ্ড। এই ধারাগুলোর অপরাধসমূহ সুস্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত না হওয়ায় এর অপব্যবহারের যথেষ্ট সুযোগ থেকেই যাচ্ছে। আইনে ১৪টি ধারা অ-জামিনযোগ্য করা হয়েছে। এসব ধারায় কাউকে গ্রেফতার করলে তার আর জামিন হবে না। তার মানে অপরাধ প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত শুধু সন্দেহের ভিত্তিতে কারাবন্দি থাকতে হবে। ফৌজদারি আইনের একটি মৌলিক নীতি হচ্ছে, উপযুক্ত আদালত দ্বারা যতক্ষণ কেউ দোষী সাব্যস্ত না হন, ততক্ষণ তিনি নিরপরাধ। আটক কোনও ব্যক্তিকে জামিন না দিয়ে যদি মাসের পর মাস বন্দি রাখা হয় এবং পরবর্তীতে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হন, তাহলে তার জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া সেই সময় ফিরিয়ে দেবে কে? আর এই কারণেই সাজা নিশ্চিত না হওয়ার আগ পর্যন্ত মানুষ জামিনের সুবিধা পায়। অন্যদিকে, গ্রেফতার ও আটক সম্পর্কে বাংলাদেশের সংবিধানে কতিপয় রক্ষাকবচ রয়েছে এবং গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির আটককালীন ও বিচারাধীন বন্দি থাকার সময়েও কিছু মৌলিক মানবাধিকারের নিশ্চয়তা রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ‘গ্রেপ্তারকৃত কোন ব্যক্তিকে যথাসম্ভব শীঘ্র গ্রেপ্তারের কারণ জ্ঞাপন না করিয়া প্রহরায় আটক রাখা যাইবে না এবং উক্ত ব্যক্তিকে তাঁহার মনোনীত আইনজীবীর সহিত পরামর্শের ও তাঁহার দ্বারা আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার হইতে বঞ্চিত করা যাইবে না’ (অনুচ্ছেদ ৩৩), ‘এমন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে না, যাহাতে কোন ব্যক্তির জীবন ও দেহের হানি ঘটে’ (অনুচ্ছেদ ৩১), ‘ফৌজদারি অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তি আইনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালত বা ট্রাইব্যুনালে দ্রুত ও প্রকাশ্য বিচারলাভের অধিকারী হইবেন, কোন অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করা যাইবে না, কোন ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাইবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর ব্যবহার করা যাইবে না’। (অনুচ্ছেদ ৩৫)।

প্রসঙ্গত উল্লেখ, সংবিধান প্রদত্ত এসব রক্ষাকবচ ও অধিকার সকল ধরনের ফৌজদারি অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ভয়ের সংস্কৃতি তৈরির জন্য সরকার ডিজিটাল সুরক্ষা আইন তৈরি করেছে এ যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়। আইন বিজ্ঞানে শাস্তির অনেক তত্ত্ব আছে। রাষ্ট্রে ফৌজদারি আইন প্রণয়নের অন্যতম উদ্দেশ্য নাগরিকদের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ফৌজদারি আইন লংঘন করলে শাস্তি দেওয়ার বিষয়ে চারটি মতবাদ প্রচলিত আছে–

এক. শাস্তি দিয়ে অন্যকে ভয় পাইয়ে দেওয়া যে অপরাধ করলে কি পরিণাম হতে পারে (Deterrent Theory), দুই. অপরাধীকে আটকে রেখে তথা কারারুদ্ধ রেখে নতুন করে অপরাধ ঠেকানো (Preventive/ Incapacitation Theory), ৩. অপরাধী যতটুকু অপরাধ করেছে, বিনিময়ে ততটুকু ফেরত দেওয়া বা প্রতিশোধ নেওয়া (Retributive Theory), চার. অপরাধীকে শোধরানোর জন্য সুযোগ দেওয়া (Reformative Theory)।

তার মানে শাস্তির উদ্দেশ্যের চারটি মতবাদের তিনটিরই উদ্দেশ্য সম্ভাব্য অপরাধীকে ভয় দেখানো যাতে সে অপরাধ না করে। এই তো সেদিন জনদাবির মুখে সরকার ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে পরিবর্তে মৃত্যুদণ্ডের বিধান করেছেন। মৃত্যুদণ্ডের উদ্দেশ্য ধর্ষণের বিরুদ্ধে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি।

সাইবার অপরাধ দমনে যে সুস্পষ্ট আইন থাকা দরকার সে বিষয়ে ভিন্নমতের অবকাশ নেই। তবে ডিজিটাল সুরক্ষা আইন যাতে নাগরিকের বাক্ ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে হুমকি সৃষ্টি না করে সেটিও অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষত্রে ডিজিটাল সুরক্ষা আইন ও অধিকারের মধ্যে ভারসাম্য বিধান জরুরি। নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন, ১৯৬৬-এর ১৯(৩) অনুচ্ছেদে সুস্পষ্ট করে বলা হয়েছে বাক-স্বাধীনতার অধিকার চূড়ান্ত, নিরঙ্কুশ ও অবাধ নয়, বরং শর্তযুক্ত। ১৯(৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘এ ধারার (২) অনুচ্ছেদে প্রদত্ত অধিকারসমূহ প্রয়োগের সঙ্গে বিশেষ কর্তব্য ও দায়িত্ব জড়িত রয়েছে। অতএব, এসব অধিকারের ওপর কিছু বাধা-নিষেধ আরোপ করা যেতে পারে।

তবে অনুরূপ বাধা-নিষেধসমূহ কেবল আইনের দ্বারা নির্ধারিত হবে এবং সেগুলো: (ক) অন্যের অধিকার ও সুনামের প্রতি সম্মানের জন্য; (খ) জাতীয় নিরাপত্তা অথবা জনশৃঙ্খলা অথবা জনস্বাস্থ্য অথবা নৈতিকতার জন্য যেরূপ আবশ্যক কেবল সেরূপ হবে।’ অন্যদিকে, এই আইনের ২০(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘বিভেদ, শত্রুতা অথবা সহিংসতা প্ররোচিত করে এমন কোন জাতিগত, বংশগত অথবা ধর্মগত বিদ্বেষের সপক্ষে প্রচার-প্রচারণা করা আইনের দ্বারা নিষিদ্ধ থাকবে।’

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন বিশ্লেষণে এটি প্রতীয়মান হয় যে, বাকস্বাধীনতার নামে ইচ্ছাখুশি সবকিছু করা যাবে না। কারণ, বাকস্বাধীনতার সঙ্গে বিশেষ কর্তব্য ও দায়িত্ব জড়িত রয়েছে। একইভাবে ধর্মগত বিদ্বেষমূলক প্রচার-প্রচারণা যা বিভেদ, শত্রুতা অথবা সহিংসতা উসকে দেয় তা-ও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অতীতে দেখা গিয়েছে অনেক সংবাদপত্র মিথ্যা, বানোয়াট ও উদ্দেশ্যমূলক সংবাদ প্রচার করেছে। ধর্মীয় বিদ্বেষ উসকে দেওয়ার সুস্পষ্ট প্রচারণা করা হয়েছে। এমনকি কাবা শরীফের ইমামকে নিয়ে মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করেছে সংবাদপত্র। এ দেশের শীর্ষ দৈনিকের সম্পাদক নির্দেশিত হয়ে অসত্য সংবাদ পরিবেশন করেছেন এমন ঘটনাও ঘটেছে। আর অনলাইন সংবাদপত্রসমূহের অনেকে আজগুবি, বানোয়াট উদ্দেশ্যমূলক ও নির্লজ্জ মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। এদিকে বাকস্বাধীনতার নামে ফেসবুক দিনে দিনে ভয়ংকর হয়ে উঠছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অশালীন ও কুরুচিপূর্ণ লেখার কারণে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা এক মামলার আসামি সিলেটের গোলাম সারোয়ারের জামিন আবেদনের ওপর আপিল বিভাগে শুনানিকালে প্রধান বিচারপতি চরম ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। কারো বিরুদ্ধে অশ্লীল, কুরুচিপূর্ণ লেখা, ছবি বিকৃত করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার কোনও মানদণ্ডেই সমালোচনা হতে পারে না। বরং এ ধরনের কাজ ভার্চুয়াল সন্ত্রাস আর যারা এমন কাজ করে তারা ভার্চুয়াল জঙ্গি। সরকারের সমালোচনার নামে পুরো রাষ্ট্রের ইমেজকে প্রশ্নবিদ্ধ করাও গ্রহণযোগ্য নয়।

ডিজিটাল সুরক্ষা আইনের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে এই আইনের কিছু বিষয়ের অস্পষ্টতার সুযোগে এর অপব্যবহার স্পষ্টতই লক্ষণীয়। সরকারের প্রণয়ন করা আইনের অপব্যবহার হলে তার দায়িত্ব সরকারের ওপরেই বর্তায়। এ পর্যন্ত এই আইনের প্রয়োগ গভীরভাবে পর্যালোচনা করে, এমনভাবে সংশোধন করা উচিত যাতে কেউ অপব্যবহারের সুযোগ না পায়। বিশেষ করে, সরকারের গোপনীয় বিষয়ের সুস্পষ্ট তালিকা প্রণয়ন, অস্পষ্ট বিষয়সমূহে যতদূর সম্ভব স্পষ্টতা আনয়ন, বিনা পরোয়নায় তল্লাশি ও জব্দের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমকে ব্যতিক্রম হিসাবে এর বাইরে রাখা, জামিন অযোগ্য অপরাধকে আরও সীমিত করা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কোনও অপরাধকে যতই জামিন অযোগ্য বলে ঘোষণা করা হোক না কেন বিচার বিভাগ চাইলে বাস্তবতা ও উচ্চ আদালতের রায়ে প্রতিষ্ঠিত নজিরের আলোকে জামিনের আদেশ দিতে পারেন।

লাখো শহীদ ও কন্যা-জায়া-জননীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত এ দেশকে এগিয়ে নেওয়া আমাদের সকলের দায়িত্ব। জাতিসংঘের স্বীকৃতি পেয়ে বাংলাদেশ সবেমাত্র উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছে। যেতে হবে বহু দূর। লক্ষ্য উন্নত দেশের কাতারে শামিল হওয়া। সামনে এগিয়ে যেতে একতাবদ্ধ হওয়ার বিকল্প নেই। সরকারের কোনও কাজের সমালোচনা, প্রতিবাদ হতেই পারে, কিন্তু সমালোচনা ও প্রতিবাদের একমাত্র উদ্দেশ্য যদি হয় যেকোনও মূল্যে সরকার পতন, আর প্রতিবাদের ভাষা যদি হয় ধ্বংসাত্মক তাহলে সংঘর্ষ অনিবার্য। আর এমন হলে, বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়া বাধাগ্রস্ত হতে বাধ্য।

লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

ই-মেইল: [email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ইউক্রেন ইস্যুতে পুতিন-রামাফোসার ফোনালাপ
ইউক্রেন ইস্যুতে পুতিন-রামাফোসার ফোনালাপ
ভিসা-পাসপোর্ট হারিয়ে প্রবাসী অজ্ঞান, ৯৯৯-এ কলে উদ্ধার
ভিসা-পাসপোর্ট হারিয়ে প্রবাসী অজ্ঞান, ৯৯৯-এ কলে উদ্ধার
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
উত্তর কোরিয়া সফর করলেন রুশ গোয়েন্দা প্রধান
উত্তর কোরিয়া সফর করলেন রুশ গোয়েন্দা প্রধান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ