X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

তাঁরাই শুধু ‘সাহেব’ হতে পারলেন না

জুবায়ের বাবু
২৮ এপ্রিল ২০২১, ১৬:৫৩আপডেট : ২৮ এপ্রিল ২০২১, ১৬:৫৬

জুবায়ের বাবু আরবি সাহবশব্দটি ইরান তুরান পার হয়ে, কবে কীভাবে ভারতীয় উপমহাদেশে সাহেবহয়ে গেলো, তার ইতিহাস জানা না থাকলেও আমাদের কাছে শব্দটির কদরই আলাদা। আরবি সাহবশব্দের অর্থ হলো সহচর বা সঙ্গী। কিন্তু সাহেববলতে আমাদের সবার কাছেই এখন সম্মানিত বা সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি বোঝায়। আবার এমন সব ক্ষমতাবান বা বিত্তবান ব্যক্তিও আমাদের কাছে সাহেব, যারা আর যাই হোক, আমাদের সঙ্গী-সাথী হতে পারেন না কিছুতেই।

মুঘল আমলে শব্দটির খুব একটা কদর ছিল না। সাহেবের কদর আকাশচুম্বী হয় ইংরেজ আমলে। শুধু সাদা চামড়ার গুণে, বিলেত থেকে দাঁড় টেনে আসা সব সাদারাই এ রাজ্যে হয়ে যান সাহেব

চামড়ার কারণেই সাহেব উপাধিটি তাদের সম্পত্তিতে পরিণত হয়। লাট সাহেব থেকে শুরু করে কত সাহেব যে এই মাটিতে জন্মালো তার ইয়ত্তা নেই। ইংরেজরাও ব্যাপারটা ধরতে পেরেছিলো চটজলদি। শব্দটির পাওয়ারবুঝতে পেরে কাজে লাগিয়েছিল পুরোপুরি। সাহেবশব্দটিকে তারা একেবারে নগদ নারায়ণ করে ফেলে। শুরু হয় ইংরেজ কর্তৃক সাহেবউপাধি প্রদান (কিংবা উপাধি বাণিজ্য)। ওই সময় চাউর হয় প্রবাদ সাহেব খুশ তো দিল ভি খুশ 

রাজা সাহেব, খান সাহেব, চৌধুরী সাহেব, বেগম সাহেব- কত সাহেব এ তারা বঙ্গে তারা বানিয়েছেন তার তালিকা করা দুরূহ ব্যাপার। সেই ইংরেজ সাহেবরা লোটাকম্বল গুটিয়েছেন ৭৫ বছর হলো। কিন্তু পিছে ফেলে গেছেন সাহেবের প্রেতাত্মা। এই ছায়া-সাহেবরা আবার এক কাঠি এগিয়ে। তারা নিজেরা নিজেরাই সাহেব বনে যান, সাহেব বানাতেও পারেন অন্যকে।

চারপাশে এখন সাহেবের ছড়াছাড়ি। আছেন বড় সাহেব, দ্বিতীয় শ্রেণির সাহেব, চতুর্থ শ্রেণির সাহেব। পদপদবীর সঙ্গেও আঠার মতো জুড়ে গেছে শব্দটা- ওসি সাহেব, ডিসি সাহেব, ডাক্তার সাহেব, ইঞ্জিনিয়ার সাহেব, উকিল সাহেব।

লন্ডনে আমার পড়শী মঈন ভাই। রসিক মানুষ তিনি। একদিন আড্ডায় বললেন, ‘লন্ডনে থাকি ১৮ বছরের বেশি। এখন পর্যন্ত একজন ওসি সাহেব, ডিসি সাহেবের সঙ্গে দেখা হলো না।

আমারও মনে হলো, ‘তাই তো! আমিও তো ১৮ বছর বিলাতে, এই দেশে সাহেব কোথায়?’ মঈন ভাইয়ের সাধ অবশ্য কিছুটা পূর্ণ হয়েছে। উনার বড় ছেলে সিভিল সার্জন হয়ে ব্রিটিশ সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পেয়েছেন। কিন্তু আফসোস, তাকেও কেউ সাহেব বলে না।

ওই দিনের আড্ডার পর থেকে মনে মনে সাহেব খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম। কোথাও পেলাম না। এখানে সরকারি চাকুরে যারা তারা রাষ্ট্রের গোলাম। যার যা দায়িত্ব, সেটা করে যাচ্ছেন। পান থেকে চুন খসলে চাকরি নেই। সুতরাং চুন নিয়ে চালবাজী চলে না এখানে।

আপনার অসুখ হয়েছে? কোনও ডাক্তার সাহেবের সঙ্গে পরিচয়ের দরকার নেই। জিপি ওরফে জেনারেল প্র্যাকটিশনাররা আছেন। বাসায় চুরি হয়েছে? আপনার কাজ ৯৯৯-এ ফোন করা। বসে থাকুন, পুলিশ আপনাকে টাইম টু টাইম সব জানাবে। ওসি সাহেবের সঙ্গে দেখা করার প্রয়োজন নেই। কোর্ট-কাচারি করবেন? টাকা-পয়সা না থাকলে সরকার আপনাকে উকিল দেবে। জজ সাহেবের কাছে ধরনা দেওয়ার প্রয়োজন নেই। অর্থাৎ আপনার জীবন সাহেবমুক্ত। এই মুল্লুকে এমপি সাহেব, মন্ত্রী সাহেবও নেই। এমপিরা ব্যস্ত আইন প্রণয়নে, মন্ত্রীরা ব্যস্ত সরকারি পরিকল্পনা বানাতে। জনগণের জন্য রয়েছে স্থানীয় সরকার। তারাই আপনার যাবতীয় দেখভাল করবেন।

এই ফাঁকে আরেক ঘটনা বলি। একবার ঢাকা থেকে লন্ডন ফেরার পথে এয়ারপোর্টে বিমানের চেক-ইন কাউন্টারে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি পরিবারসহ। সামনে এক বিদেশি কর্মী চেক-ইন করছেন। পেছনে আরও দুয়েকজন। হঠাৎ এক বড় সাহেবপাইক-পেয়াদা নিয়ে সবাইকে ডিঙিয়ে সরাসরি কাউন্টারে হাজির। সূর্যের চেয়ে বালি গরম। সাহেবের পাসপোর্ট টিকিট কাউন্টারে রেখেই পেয়াদারা তাড়া দিতে থাকলেন। বেচারা বিদেশি হা করে তাকিয়ে আছেন। কাউন্টারের ভদ্রলোক কাজ বাদ দিয়ে সাহেবের চেক-ইন শুরু করলেন। আমি পেছন থেকে কঠিন প্রতিবাদ করলাম। সাহেব এসে আমাকে বললেন, ‘আমাকে চেনেন আমি কে?’ আমি বেশ কিছুক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে চেনার চেষ্টা করে ব্যর্থ হই। তখন মনে পড়লো, এই কথাটা আমি বিলেতে কোনোদিন শুনি নাই। সবিনয়ে বললাম, ‘আরেকবার বলেন প্লিজ। অনেক দিন হলো কথাটা শুনি না।তিনি খুব রেগে গেলেন। আমিও নাছোড়বান্দা। অবশেষে সেই সাহেব লাইনের শেষে গিয়েই দাঁড়ালেন। আমাকে দেখে নেবার হুমকিও দিলেন। আমি আমার ভিজিটিং কার্ড দিয়ে বলেছিলাম, ‘যখন দেখতে ইচ্ছা করবে, কল করবেন, নিজেই হাজির হবো।তিনি অবশ্য আর কল-টল করেননি। 

কিছুদিন আগে ভাইরাল হওয়া সেই ডাক্তার সাহেব বনাম ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব বনাম পুলিশ সাহেবের কথা মনে পড়লো। সাহেবে সাহেবে সে কি যুদ্ধ! এক সাহেব আরেক সাহেবকে চিনতে না পারায় লঙ্কাকাণ্ড ঘটে গেলো। চিনতে পারলে কী হতো কে জানে।

তাদের কাণ্ড নিয়ে আমার আফসোস নেই। আফসোস অন্য জায়গায়। সাহেবের এই রাজ্যে দেশটা চলছে যাদের কাঁধে ভর করে, যাদের ঘামে, কবজির মোচড়ে, তারাই শুধু সাহেব হতে পারলেন না। বলছিলাম খেটে খাওয়া মানুষ, কৃষক, গার্মেন্ট কর্মী, জেলে, তাঁতি ইনাদের কথা। তাদের আমার একবার হলেও সাহেব বলে ডাকতে ইচ্ছে করে।

লেখক: চলচ্চিত্র নির্মাতা

/এফএ/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
৩ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না কয়েকটি এলাকায়
৩ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না কয়েকটি এলাকায়
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ