X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

দরিদ্র মৃত্যুপথযাত্রী ছাত্র যদি ‘মেধাবী’ না হয়?

ডা. জাহেদ উর রহমান
২২ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৭:৫৯আপডেট : ২২ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৭:৫৯
ডা. জাহেদ উর রহমান মাসখানেক আগে, ১৩ আগস্ট ছিল গুণী নির্মাতা তারেক মাসুদের মৃত্যুবার্ষিকী। তার সঙ্গে মারা যাওয়া আরেকজন মানুষের নামও আমাদের মনে আছে– মিশুক মুনীর। এ বছর সেই ঘটনার এক দশক পূর্ণ হয়েছে বলে মিডিয়ায় সেটি উল্লেখ করে সবাই গুরুত্ব দিয়ে সংবাদটি প্রকাশ করেছে। সেই বছরই এই দুর্ঘটনার ঠিক এক মাস আগে ঘটা আরেকটি ভয়ংকর দুর্ঘটনার কথা কি মনে আছে আমাদের? সেই দুর্ঘটনাটির এক দশক পূর্তি হয়েছে। প্রিয় পাঠক, মনে করার চেষ্টা করুন। একটু পরে আসছি সেই দুর্ঘটনার কথায়।

খুব স্পষ্টভাবে আমি তারেক মাসুদের দুর্ঘটনা এবং তার পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের কথা মনে করতে পারি। মনে আছে, সে সময়ে কী অবিশ্বাস্য তোলপাড় ঘটে গিয়েছিল সারাদেশে। ভীষণ গুণী এই দুই জন মানুষের মৃত্যু আমাদের কাঁপিয়ে দিয়ে যায় ভীষণভাবে। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ সবাই শোকে মুহ্যমান হন। অবহেলাজনিত সড়ক দুর্ঘটনাকে ‘হত্যা’ দাবি করে মানুষ ফুঁসে ওঠে, প্রতিবাদ করে ওই ‘হত্যাকাণ্ডের’। এ ঘটনার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার ছিল – আমাদের বুদ্ধিজীবী, শিল্পসাহিত্য আর সংস্কৃতির মানুষদের ‘অসাধারণ প্রতিবাদী’ হয়ে ওঠা। মিডিয়ায় অনেক খবর, অনেক আলোচনা, অনেক প্রতিবাদ, অনেক ধিক্কার। সারাদেশে মানববন্ধন হলো, এমনকি ঈদের দিন শহীদ মিনারে অবস্থান কর্মসূচি হলো। টিভি ক্যামেরার সামনে সবার শোকের মধ্যেও ছাপিয়ে উঠলো যোগাযোগমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি।

ওই দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমাদের সামষ্টিক উন্মাদনা এমন পরিস্থিতিতে পৌঁছেছিল যে সেটা একজন মানুষের জীবনের ওপর এক বড় সংকট তৈরি করেছিল। এই দুর্ঘটনায় জড়িত বাসটির চালক জামিরকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। গত বছর কাশিমপুর কারাগারে থাকা অবস্থায় তার হার্ট অ্যাটাক হয় এবং তিনি মারা যান।

জমিরের মৃত্যুর পেছনে আমাদের এক সংকটও উন্মোচিত হয়েছে। সেই দুর্ঘটনার ব্যাপারে দেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একজন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. শামসুল হক (সাবেক পরিচালক, দুর্ঘটনা রিসার্চ ইনস্টিটিউট, বুয়েট) দীর্ঘ নিবন্ধ লিখেছেন একটি বিদেশি সংবাদ সংস্থার বাংলা ভার্সনে। সেখানে তিনি দেখিয়েছেন এই দুর্ঘটনার জন্য জমিরের বাসটি দায়ী ছিল না। তিনি আদালতে দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে সাক্ষ্যের সঙ্গে টেকনিক্যাল মতামতের প্রতিও গুরুত্ব আরোপ করেন। এই দুর্ঘটনার দায়ভার নিয়ে তিনি তার বিশ্লেষণ শেয়ার করেছেন তারেক মাসুদের মামলার আইনজীবী, অ্যাটর্নি জেনারেল এবং আইনমন্ত্রীর সঙ্গে। কিন্তু এরপরও প্রক্রিয়াগত কারণে পারেননি সেই বাসচালকের শাস্তি ঠেকাতে।

সড়ক দুর্ঘটনা কি এই দেশে খুব কম হয়? দেশে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো যে সংখ্যা আমাদের জানায়, সেটা পত্রিকায় প্রকাশিত সংখ্যা। বাস্তব সংখ্যা আরও অনেক বেশি। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে বাংলাদেশ সরকার পরিচালিত হেলথ ইঞ্জুরি সার্ভে-২০১৬-তে জানা যায়, এই দেশে প্রতিদিন গড়ে ৬৪ জন মানুষ প্রাণ হারায়। অর্থাৎ বছরে এই সংখ্যা ২৩ হাজারের বেশি। ‘মজার’ ব্যাপার হলো, এই সংখ্যাগুলো আমাদের বিবেককে নাড়া দেয় না, জাগিয়ে তোলে না। আমাদের কাছে ‘নিছকই কতগুলো সংখ্যা, পরিসংখ্যান’।

তারেক মাসুদ আর মিশুক মুনীরের প্রাণ কেড়ে নেওয়া দুর্ঘটনাটির মাসখানেক আগের যে দুর্ঘটনাটির কথা বলছিলাম মনে পড়েছে সেটার কথা? ২০১১ সালের ১১ জুলাই মিরসরাইয়ে ঘটেছিল সেই দুর্ঘটনাটি। মারা গিয়েছিল নিতান্ত ‘সাধারণ’ কিশোররা। দুর্ঘটনায় ‘সাধারণ’ মানুষের মৃত্যু অত্যন্ত তুচ্ছ খবর আমাদের দেশে। কিন্তু তখন এ খবরটি বেশ বড় হয়েছিল। শুধু একটি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৪ জন কিশোর মারা গিয়েছিল। স্কুলের ফুটবল দলের খেলা দেখে পিকআপে করে ফিরছিল তারা। পিকআপটি গিয়ে একটি পুকুরে পড়ে।

দুর্ঘটনাটির পরে কখনও কখনও সেই দিনটিকে স্মরণ করে আমাদের দেশের কোনও কোনও মিডিয়ায় খবর প্রকাশিত হয়েছে। এই বছর তারেক মাসুদের দুর্ঘটনাটির মতো সেই দুর্ঘটনার এক দশক পূর্তি হলো। খুঁজে দেখলাম হাতে গোনা একটি বা দুটি মিডিয়ায় খবরটি হয়েছে।

তবে আমি মিডিয়াকে দোষ দিচ্ছি না। মিডিয়ার সংবাদও প্রায় সব ক্ষেত্রেই মেনে চলে অর্থনীতির 'চাহিদা-জোগান তত্ত্ব'। আসলেই আমরা ‘শিক্ষিত’ মধ্যবিত্তরা মিরসরাইয়ের খবরটি ভুলে যেতে চেয়েছি। নিতান্ত গ্রামের নিম্ন-মধ্যবিত্ত থেকে দরিদ্র কিশোররা ছিল এই দুর্ঘটনার শিকার। ঘটনার সময় সংখ্যার ওজনটা আমাদের কিছুটা প্রভাবিত করলেও সময়ের সঙ্গে ফিকে হয়ে গেছে সব।

অথচ দুর্ঘটনার কথা যদি আমরা ভাবি তাহলে দেখবো একজন বিখ্যাত বা সামর্থ্যবান মানুষের দুর্ঘটনায় মৃত্যুর চেয়ে একটা অতি সাধারণ মানুষের মৃত্যু অনেক বেশি ভয়ংকর। তারেক মাসুদের মৃত্যুর পর তার পরিবার পথে বসে যায়নি কিংবা সেটা ঘটেনি মিশুক মুনীরের পরিবারের ক্ষেত্রেও। কিন্তু সেই দুর্ঘটনায় তাদের বহনকারী মাইক্রোবাসের চালকও মারা গিয়েছিল; তার পরিবারের কথা কি আমরা ভাবি?

বাসচালক জমিরের পরিবারের কী অবস্থা, সেই খোঁজ কি আমরা নিয়েছি? কীভাবে চলছে পরিবারগুলোর জীবিকা? বহু দুর্ঘটনায় পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটি মারা যায় কিংবা বিকলাঙ্গ হয় এবং পরিবারটির জীবন তছনছ হয়ে যায়। কিন্তু এভাবে আমরা কখনও ভাবি না। তাই এসব মৃত্যু আমাদের ক্ষুব্ধ করে না। তাই আমরা সোচ্চারও হই না সড়ক দুর্ঘটনার বিরুদ্ধে।

এই মানসিকতা রয়েছে আমাদের চিন্তার অনেক ক্ষেত্রেই। মাঝে মাঝেই পত্রিকায় চিকিৎসার জন্য সাহায্য চেয়ে বিজ্ঞাপন দেখা যেত আগে; কমে গেলেও এখনও দেখা যায়। এখন তো আবার সামাজিকমাধ্যম আছে এর জন্য। জটিল, দুরারোগ্য কোনও রোগে আক্রান্ত মানুষটি যদি কোনও ছাত্র হয় তাহলে খুব টিপিক্যালি লেখা হতো এভাবে- একজন দরিদ্র, মেধাবী ছাত্রকে বাঁচাতে এগিয়ে আসুন। বাংলাদেশে নিশ্চয়ই জটিল-কঠিন রোগে আক্রান্ত সব ছাত্র মেধাবী নয়; অনেকেই আছে মাঝারি, খুব কম মেধার মানুষ।

এই চর্চাও নিশ্চয়ই অর্থহীন নয়। মানুষের আবেগের সঙ্গে কানেক্টেড হওয়ার জন্য কোনও সাধারণ 'কম মেধার/বোকা ছাত্রের’ মৃত্যুপথযাত্রী হাওয়া হয়তো ঠিকঠাক কাজ করে না। আমরা হয়তো দায়বদ্ধতা বোধ করি ‘মেধাবী’দের বাঁচানোর জন্য। তাই সবাইকে গায়ের জোরে ‘মেধাবী’ বানিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলতেই থাকে।

কথাগুলো এভাবে বলা হয়তো অর্থহীনই। বিদ্যমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বেশি মূল্য কিংবা কম মূল্যের ধারণা তো থাকারই কথা। কিন্তু একই রকম অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পশ্চিমা দেশগুলোর পরিস্থিতি তো এতটা ভয়ংকর নয়। সাধারণ মানুষের জীবন সেখানে এতটা মূল্যহীন নয়। সেখানে এতটা মর্যাদাহীন নয় সাধারণ মানুষ।

বাজারে সব পণ্য যেমন একই মূল্যে বিকায় না, তেমনি প্রতি মানুষের ‘মূল্যও’ সমান নয়। কিন্তু তবু কথা থেকে যায়, মূল্য একটা পারসেপশন। পুরোপুরি না হোক সেই পারসেপশন কিছুটা হলেও পাল্টালে এই সমাজটা হয়তো আরেকটু ভালো হতে পারতো। কিন্তু না, আমরা হাঁটছি না সেই পথে, যাচ্ছি উল্টো দিকে।
 
লেখক: শিক্ষক ও অ্যাকটিভিস্ট
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপের ফাইনাল আজ
বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপের ফাইনাল আজ
টিভিতে আজকের খেলা (২০ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২০ এপ্রিল, ২০২৪)
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ