X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

সাইবার বুলিং ঠেকাতে চাই সমন্বিত পরিকল্পনা

লীনা পারভীন
০৮ নভেম্বর ২০২১, ১৬:৪৮আপডেট : ০৮ নভেম্বর ২০২১, ১৬:৪৮

লীনা পারভীন অনলাইন দুনিয়ায় এখন আর কারও বিচরণকে সুরক্ষিত রাখার উপায় নেই।  অনলাইন দুনিয়ায় যারা সাইবার বুলিংয়ের মতো অপরাধের সঙ্গে যুক্ত তাদের নিয়ে কি আমরা ভাবছি? আসলে সাইবার বুলিং বলতে কী বুঝি আমরা? ডিজিটাল মাধ্যম যেমন নতুন, ঠিক তেমনই অনলাইন হ্যারাসমেন্ট বা সাইবার বুলিং শব্দটিও একদম নতুন বা অনেকের কাছে পরিচিত নয়।

বাস্তবে ‘সাইবার’ বলতে বুঝায় অনলাইনের জগতকে আর ‘বুলি’ মানে কাউকে ব্যক্তিগত আক্রমণের মাধ্যমে হেয় করা বা নিচু করার প্রক্রিয়া। ব্যক্তিগত কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে আমি জানি এই অনলাইন হ্যারাসমেন্ট বা সাইবার বুলিং কতটা মানসিক পীড়ার তৈরি করে। আমি যেহেতু একজন অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট ও অনলাইন বা পত্রিকায় কলামও লিখি তাই মাঝেমাঝেই আমাকে এই তিক্ত অভিজ্ঞতার মাঝ দিয়ে যেতে হয়। এইতো কিছুদিন আগেই আমার লেখা কলামের নিচে এসে অত্যন্ত আপত্তিজনক ভাষায় আক্রমণ করা হয়েছে। একজন নারী হিসেবে আমাকে ‘বেশ্যা’ ‘পতিতা’– এই ধরনের শব্দ প্রায়ই শুনতে হয় কেবল আমার লেখার জন্য। কারণ অনলাইনে যারা এমন বাজে শব্দে আক্রমণ করে থাকে তারা কেউই আমাকে ব্যক্তিগতভাবে চেনে না। ফেসবুকে কিছুদিন আগেও আমার সন্তানদের ছবি সহ আমার আইডির স্ক্রিনশট ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিলো গালিগালাজ করার জন্য। বাধ্য হয়ে আমাকে আইডি রেসট্রিকটেড করতে হয়েছিলো।

একই অভিজ্ঞতা অনলাইনে লেখালেখি করে বা যুক্ত আছে এমন প্রত্যেকেরই কোনও না কোনোভাবে হয়েছে। তবে ভাবনার বিষয় হচ্ছে এই সাইবার বুলিংয়ের বিরুদ্ধে এখনও তেমন কোনও প্রশাসনিক উদ্যোগ আমরা দেখতে পাচ্ছি না। অনেকবার অনেক মিটিংয়ের মাধ্যমে আমরা আমাদের ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছি। অনলাইন পোর্টালগুলোর বিভিন্ন সংবাদের নিচে কমেন্ট সেকশনকে নিয়ন্ত্রণ করার উদ্যোগ গ্রহণেরও একটি অনুরোধ করা হয়েছে। কিন্তু তেমন কোনও কার্যকর পদক্ষেপ কেউই নিচ্ছেন না।

বাস্তবে এই সাইবার বুলিং কিন্তু কেবল পোর্টাল জগতে থেমে নেই। এর জঘন্য থাবা হানা দিয়েছে আমাদের তরুণ সমাজের মাঝেও। সেদিন আমার ১৮ বছরের ছেলে এসে জানালো ফেসবুক কেন্দ্রিক একটি গ্রুপে একদল নারী মিলে একটি ছেলেকে ইচ্ছেমত ‘পচাচ্ছে’। কমবয়সী তরুণ-তরুণীদের কাছে ‘পচানো’ একটি ফ্যাশনে দাঁড়িয়েছে। নিজেদের মতের সাথে না মিললেই চলে এই ‘পচানি’।

এই ‘পচানি’ এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে যাকে পচাচ্ছে সে মানসিকভাবে বিষয়টিকে নিতে পারছে কিনা সেই বিবেচনাবোধটুকুও কাজ করে না বা গড়েও ওঠে না। এই ‘পচানো’ যে একপ্রকার ‘বুলি’ এই বোধটুকু গড়ে উঠছে না আমাদের তরুণদের মাঝে। আবার এই ‘পচানি’ চলে নারী-নারী বা পুরুষ-পুরুষেও। যেহেতু এ ধরনের অপরাধ সাধারণত ঘটে থাকে কমবয়সী তরুণ বা নারীদের সাথে তাই বেশিরভাগ আলোচনাই আসে এদেরকে কেন্দ্র করেই। খেয়াল করলে এটা পরিষ্কার জানা যায় যে অনলাইনে এমন সাইবার আক্রমণ যারা করছে তাদের প্রায় সবারই বয়স কম। অর্থাৎ, আমাদের তারুণ্য আজ ক্ষতিকর চর্চায় লিপ্ত হয়েছে।

বাংলা ট্রিবিউনে প্রকাশিত এক জরিপের ফলাফলে বলা হয়েছে বাংলাদেশে গড়ে ৮ শতাংশ তরুণ সপ্তাহে অন্তত একবার সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান টেলিনর, গ্রামীনফোন ও প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের উদ্যোগে এই জরিপটি পরিচালিত হয় থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে। ৩ হাজার ৯০০ জন অংশগ্রহণকারীর মধ্যে ১৬ শতাংশ ছিল বাংলাদেশের।

জরিপে যদিও বলা হয়েছে সপ্তাহের হিসাবে কিন্তু আমরা যদি সামগ্রিকভাবে বিষয়টিকে বিবেচনা করি তাহলে এই হিসাব দৈনিকে এসে ঠেকবে। বাংলাদেশে ডিজিটাল মিডিয়ার প্রসার খুব বেশিদিনের না। তবে সময়ের হিসেবে এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়েছে কয়েকগুণ। এই মুহূর্তে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০ কোটির ওপর। ফোন কোম্পানিগুলোর নানারকম অফারের কল্যাণে ইন্টারনেট এখন হাতের মুঠোয়। আর এই ইন্টারনেটের ব্যবহার যে কেবল গঠনমূলক কাজে ব্যবহার হচ্ছে তা নয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ডিজিটাল গণমাধ্যম হিসেবে পরিচিত লাভ করেছে এরই মধ্যে। এই ফেসবুক কেন্দ্রিক হামলার কোনও পরিসংখ্যান কিন্তু এখনও সামনে আসেনি।

অভিনয় শিল্পী চঞ্চল চৌধুরী, ভাবনা, মিথিলাদের হয়রানির সংবাদ এখনও টাটকা। আমাদের ক্রিকেট খেলোয়াড়রাও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অনবরত চলা সাইবার বুলিংয়ের কারণে। বর্তমান বিশ্ব ইন্টারনেটকেন্দ্রিক যোগাযোগের ওপর নির্ভরশীল। তাই চাইলেও পরিবার, সমাজ বা রাষ্ট্র কেউই এই জগৎ থেকে তাদের সন্তান বা নিজে বাইরে থাকতে পারবে না। কিন্তু যে হারে এর ভয়াবহতা বেড়ে চলেছে তার সাথে পাল্লা দিয়ে যে কাজটি করা উচিত সেটি একদমই হচ্ছে না। অনলাইনে যারা এমন অপরাধ কর্মের সঙ্গে জড়িত তাদের বেশিরভাগই ফেইক আইডি দিয়ে কাজ চালায়। অর্থাৎ নিজের পরিচয় লুকিয়ে রাখে। আবার একটি গ্রুপ আছে একদম সংগঠিত আকারে পেশাদার ভিত্তিতে এমন কাজ করে থাকে। জানা যায়, এদের কাজই হচ্ছে আক্রমণাত্মক কমেন্ট বা গালিগালাজ করা।

এই সাইবার আক্রমণকে রুখতে হলে দরকার একটি সমন্বিত ও পরিকল্পিত কর্মপরিকল্পনা। এখানে প্রশাসন, পরিবার, ব্যক্তি, রাষ্ট্র, সমাজ, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সার্ভিস প্রোভাইডার, অপারেটর, সংবাদ মাধ্যম, গণমাধ্যম প্রতিটা ক্ষেত্রের এখানে সমান ভূমিকা আছে। অনলাইনে কাউকে খাটো করা বা অপমান করে কিছু বলাটাও যে এক ধরনের শাস্তিযোগ্য অপরাধ– এই বিষয়টিকে সামনে এনে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে। এ ধরনের অভিযোগগুলোকে আমলে নেওয়ার মানসিকতা আমাদের পুলিশ বাহিনীর মধ্যে এখনও কম। তাই মামলা করতে যেতে চায় না অনেকেই। অনেক নারী এমন পরিস্থিতিতে অসহায় হয়ে পড়ে। স্থানীয় প্রশাসনকে সচল রাখতে হবে যাতে করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে এ ধরনের কার্যক্রমকে ঠেকানো যায়। নিরাপদ অনলাইন হোক ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার হাতিয়ার।

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বিকল্প অর্থনীতি ও গ্রাম্য কায়কারবার
উপন্যাসবিকল্প অর্থনীতি ও গ্রাম্য কায়কারবার
ইরান-সমর্থিত ইরাকি সেনা ঘাঁটিতে বিস্ফোরণ, নিহত ১
ইরান-সমর্থিত ইরাকি সেনা ঘাঁটিতে বিস্ফোরণ, নিহত ১
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অ্যাসেম্বলি বন্ধ
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অ্যাসেম্বলি বন্ধ
দ্বিতীয় বিয়ের চার দিন পর বৃদ্ধকে হত্যা, দুই ছেলে পলাতক
দ্বিতীয় বিয়ের চার দিন পর বৃদ্ধকে হত্যা, দুই ছেলে পলাতক
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ