X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরীর কলাম ও স্মৃতি

আনিস আলমগীর
২১ ডিসেম্বর ২০২১, ১৫:৪৪আপডেট : ২১ ডিসেম্বর ২০২১, ১৫:৫৭

আনিস আলমগীর গত বছরের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তায় চিরতরে হারিয়ে গেছেন কলামিস্ট বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী। প্রতি বৃহস্পতিবার তার কলাম প্রকাশিত হতো বাংলা ট্রিবিউনে। লেখার বিষয়বস্তু নিয়ে, শব্দচয়ন নিয়ে তিনি ছিলেন খুব সচেতন, কিন্তু বানানের ব্যাপারে তিনি ছিলেন উদাসীন। কিছু শব্দের বানান বছরের পর বছর একই রকম লিখে গেছেন। প্রায় অপ্রচলিত শব্দ লিখতেন তিনি, আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার করতেন। শব্দের শুরুতে ‘ক’ এবং ‘খ’ বর্ণ থাকলে প্রায় সময় ‘ক’-এর জায়গায় ‘খ’ এবং ‘খ’-এর জায়গায় ‘ক’ লিখতেন। সে কারণে তার কলাম প্রকাশের আগে বেশিরভাগ সময়ে বানান আমাকে দেখে দিতে হতো। তিনি হাতে লিখতেন। সেটা কম্পিউটারে কম্পোজ করে আমাকে মেইল করতো কম্পোজার। সে হিসেবে তার কলামের প্রথম পাঠক ছিলাম আমি।

পড়তে পড়তে আমি অবাক হতাম কী করে একজন মানুষ এত তথ্য মাথায় রাখেন। কথা বলার সময়ও অবলীলায় দিনক্ষণ, নাম, ইতিহাস বর্ণনা করেন। আমি বলতাম আমাদের এনসাইক্লোপিডিয়া। যখনই আমি ইতিহাসনির্ভর কোনও লেখা লিখেছি বা টকশো করেছি, তার সঙ্গে প্রথম আলোচনা করেছি, সাহায্য নিয়েছি। বিশেষ করে উপমহাদেশের ইতিহাস যেন তার মুখস্থ। ভারতে ব্রিটিশ শাসন, দেশ বিভাগ, ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশের বিগত দিনের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ইতিহাস তার মাথায় খোদাই করে রাখা ছিল। আমেরিকার ইতিহাস, ইউরোপের রাজনীতি, মধ্যপ্রাচ্য- সবকিছু জমা ছিল তার মস্তিষ্কের তথ্যভাণ্ডারে।

ধর্মীয় বিষয়েও তার ছিল অগাধ পাণ্ডিত্য। ধর্মীয় নেতারাও জানেন না এমন তথ্য তিনি রেফারেন্স দিয়ে বলতেন। শুধু ইসলাম নয়, অন্য ধর্ম সম্পর্কেও তিনি পড়াশোনা করতেন। তাই তার বুক সেলফের পুরোটাই ভরা ইতিহাস, রাজনীতি, দর্শন আর ধর্মীয় বইতে। আছে বিদেশি সংবাদপত্র-ম্যাগাজিন। বেশিরভাগ বইতে উনার চিহ্ন দেওয়া বিভিন্ন রেফারেন্সের। যখনই প্রয়োজন হতো সেখান থেকেও তথ্য খুঁজে নিতে দেরি হতো না তার।

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী তথ্য সংগ্রহেও খুব যত্নবান ছিলেন। ডায়রিতে তুলে রাখতেন নতুন কোনও তথ্য ও উপাত্ত, যা তিনি কলামে ব্যবহার করতেন বা টকশোতে রেফারেন্স দেবেন চিন্তা করতেন। বাংলাদেশে প্রথম সারির সব কয়টা দৈনিক তিনি পড়তেন। দৈনিক পত্রিকা ছিল তার সমসাময়িক তথ্যের প্রধান সোর্স। অনলাইন খুব কম পড়তেন। আমি দেখতাম ওনার সংগ্রহের বই বা ম্যাগাজিনের অনেক জায়গায় আন্ডারলাইন করা। তিনি বলতেন, যে লেখা পড়ে আন্ডারলাইন করার কিছু নেই সেটি পাঠযোগ্য কিছু না। তার নিজের লেখাতেও থাকতো পাঠকদের জন্য প্রচুর নতুন নতুন তথ্য। প্রচলিত ভাবনার বাইরে নতুন চিন্তা। থাকতো মধুর সব উপমা। নতুন তথ্য নেই এবং চিন্তার খোরাক জোগায় না এমন কলাম আমি ওনার খুবই কম দেখেছি। প্রতি বৃহস্পতিবার তিনি লিখবেন, আমি আগেই পড়বো, তার পাঠকরা পড়বেন, মেইল করবেন; আড্ডায়, টকশোতে, সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনা হবে- সেটি অনুপস্থিত এক বছর ধরে।

গত ২৫ ডিসেম্বর ২০২০ প্রথম প্রহরে তিনি সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভে পরপারে চলে গেছেন। বাংলাদেশের সত্যিকারের পাঠকগোষ্ঠী হারিয়ে ফেলেন তাদের একজন প্রিয় কলামিস্টকে। আমি হারিয়ে ফেলি আমার সবচেয়ে প্রিয় কলামিস্ট, প্রিয় চাচা, প্রিয় বন্ধু, সবচেয়ে আপনজনকে। প্রিয়জন হারানোর ব্যথাটা প্রথম পাই ১৯৯৯ সালের মার্চে আব্বাকে হারিয়ে। তারপর ২০১২ সালের ডিসেম্বরে আম্মাকে হারিয়ে। আব্বা, আম্মাকে হারানোর ব্যথাটা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি কারণ হয়তো তারা মোটামুটি হায়াত পেয়েছিলেন, শেষ বেলায় বিছানায় পড়ে কষ্ট করেছেন বলে। কিন্তু চাচার মাত্র ৭২ বছর বয়সে চলে যাওয়া মেনে নিতে পারছি না। প্রতিটি প্রয়োজনে তাকে খুঁজছি।

আব্বা মারা যাওয়ার পর টানা ২০ বছর চাচা বাবার আসন নিয়েছিলেন। চাচাকে ছাড়া আমার ব্যথা-বেদনা, হাসি-আনন্দের কোনও ঘটনা নেই। এতটা দখলদারিত্ব তিনি আমার জীবনের ওপর নিয়েছেন, সেটা আর কেউ নিতে পারেনি আজও। চাচা ছিলেন আমার মেন্টর, লেখালেখি, সাংবাদিকতার প্রধান প্রেরণা। আমাদের পরিবারের সবার আপনজন। তিনি আমার আব্বা, আম্মা, ভাই, বোন- সবার ভালোবাসা পেয়েছেন। তার সান্নিধ্য সবার কাম্য ছিল। তার বন্ধুবান্ধবও তাকে একইভাবে মিস করতো দুদিন না দেখলে। কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়, এমনকি যারা তার চরম ক্ষতি করেছে তাদের প্রতিও উনার সৌজন্যতার কমতি দেখিনি আমি।

সবাইকে আপন করে নেওয়ার এই গুণটি হয়তো আরও অনেকের মাঝে আছে, কিন্তু বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী ছাড়া শত্রু-মিত্র, ধনী-গরিব, বড়-ছোট সবাইকে আপন এবং সম্মান দেওয়া লোক দ্বিতীয় কারও সঙ্গে আজও দেখা হয়নি। তাকে ছাড়া দেখা হয়নি কোনও বিষয়ে তাৎক্ষণিক লেখা এবং বলার গুণসম্পন্ন মানুষের সঙ্গেও। নিজে যতবার যত সমস্যায় পড়েছি তার শরণাপন্ন হয়েছি। আমি তার জীবনকালেও আফসোস করেছি এবং এখনও করি যে তার মতো মেধাসম্পন্ন একজন ব্যক্তি বাংলাদেশে তার উপযুক্ত স্বীকৃতি পায়নি। যারা তার সংস্পর্শে আসেনি,  তিনি যে এই দেশের শ্রেষ্ঠ গুণীদের মধ্যে একজন ছিলেন, কাছের লোকজন ছাড়া সেটাও অনেকে জানেন না।

তাই আমার মনে হয়, এই দেশের মেধার স্বীকৃতি একটি ফাঁপা বেলুনের মতো। অন্যের দ্বারা তৈরি করা। গুণীদের খুঁজে বের করার, সম্মান দেওয়ার দায়িত্ব কেউ নেয় না। মিডিয়াও খুঁজে তাদের, যারা মিডিয়াকে খুঁজে। রাষ্ট্রযন্ত্র তাদের তালাশ করে যারা তেলের শিশি নিয়ে দিবারাত্র ক্ষমতাসীনদের নয় শুধু, তাদের চামচাদের পেছনে ঘুরে। এ দেশে গুণীজনদের সম্মান পরস্পরের পিঠ-চুলকানির মধ্য দিয়ে আসে। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি, পদক, সাহায্য- সিংহভাগ পারস্পরিক লেনদেনের বিষয়।

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী হতে চেয়েছিলেন রাজনীতিবিদ। ছাত্রজীবনে তিনি চট্টগ্রামের বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহমেদ চৌধুরীর সংস্পর্শে এসে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হন। চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। বঙ্গবন্ধু যখন আওয়ামী লীগকে ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছেন তখন তার সঙ্গে দেখা হয়েছে চট্টগ্রামে, ঢাকায়। মায়ের গহনা বিক্রি করে জহুর চৌধুরীর হাতে দিয়েছেন চট্টগ্রামে বঙ্গবন্ধুর জনসভার জন্য- সে গল্পও আমাকে করেছেন। জহুর চৌধুরী বলতে অজ্ঞান ছিলেন। এই দেশের জন্য বঙ্গবন্ধুর চেয়ে কারও বেশি ত্যাগ আছে বিশ্বাস করতেন না। স্বাধীনতা প্রশ্নে শ্রদ্ধা করতেন ইন্দিরা গান্ধীকেও।

রাজনীতি বিশ্লেষক ও কলামিস্ট বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী


বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরীর সকল কলাম পড়তে ক্লিক করুন

১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান আর ১৯৭১ সালের যুদ্ধে জড়ান। তখন তিনি নগর ছাত্রলীগের ভাইস প্রেসিডেন্ট। ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার যে ঘোষণা দেন জহুর আহমেদ চৌধুরীর নির্দেশে সেটা তারা গভীর রাতে মাইকিং করে প্রচার করেন। ১৯৭১ সালে ভারত থেকে প্রশিক্ষণ শেষে জহুর আহমেদ চৌধুরীর নির্দেশে দেশে এসে তার নির্দেশ মতো কাজ করার সময় এক সকালে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মিলিশিয়া বাহিনীর হাতে বন্দি হয়ে সাকার বাবা ফকা চৌধুরী এবং মিলিশিয়া বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। মৃত ভেবে তারা পাহাড় থেকে ফেলে দিয়েছিল তাকে।

স্বাধীনতার পর তিনি জাতীয় রাজনীতিতে জড়িত হয়েছিলেন কিন্তু শঠতা রপ্ত করতে পারেননি, সত্য বলার চরিত্র বদলাতে পারেননি বলে ইতি টানতে হয়েছে। পরে ব্যবসা, ঠিকাদারি এবং সর্বশেষ পুরোপুরি লেখালেখিতে জড়িত হয়ে পড়েন। লেখালেখি ছাত্রজীবন থেকেই করেছেন কিন্তু সবকিছু ছেড়ে শুধু লেখক হবেন ভাবেননি। তার কলামের নিজস্ব কিছু ভক্ত আছে, তার কিছু শ্রোতা আছে, কলাম লেখকরাও তার কলামের ভক্ত- সেটা তিনি এনজয় করতেন। ‘কলামিস্ট বখতিয়ার’, বা ‘টকশোর বখতিয়ার সাহেব’ বলে তাকে লোকে সম্বোধন করলে সেটাও এনজয় করতেন দেখতাম।

আজ তিনি নেই। তার লেখাগুলো, কথাগুলো রয়ে গেছে। তার স্মৃতি ও কাজের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। প্রার্থনা করছি প্রতিদিনের মতো আল্লাহ যেন তাকে বেহেশত নসিব করেন।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত। [email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজের পাঠদানও বন্ধ
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজের পাঠদানও বন্ধ
রুশ বিদ্যুৎকেন্দ্রে ইউক্রেনের হামলা, ৫০টি ড্রোন ভূপাতিতের দাবি মস্কোর
রুশ বিদ্যুৎকেন্দ্রে ইউক্রেনের হামলা, ৫০টি ড্রোন ভূপাতিতের দাবি মস্কোর
বিয়েবাড়ির খাসির মাংস খেয়ে ১৬ জন হাসপাতালে
বিয়েবাড়ির খাসির মাংস খেয়ে ১৬ জন হাসপাতালে
সরকারি প্রতিষ্ঠানে একাধিক পদে চাকরি
সরকারি প্রতিষ্ঠানে একাধিক পদে চাকরি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ