X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

করোনায় তাড়াহুড়োর ‘রাজনৈতিক’ বিধিনিষেধ

ডা. জাহেদ উর রহমান
১৬ জানুয়ারি ২০২২, ১৯:০৫আপডেট : ১৬ জানুয়ারি ২০২২, ১৯:২৩

ডা. জাহেদ উর রহমান বাংলাদেশে কি মাত্র কয়েক দিন আগেই প্রথমবারের মতো করোনা ধরা পড়লো? প্রশ্নটা উদ্ভট জানি। প্রায় দুই বছর আগে ধরা পড়া করোনার রীতিমতো তৃতীয় ঢেউয়ের সামনে দাঁড়িয়ে এমন প্রশ্ন করার কোনও কারণ নেই। কিন্তু করোনার ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণকে সামনে রেখে সম্প্রতি জারি করা ১১ দফা বিধিনিষেধের দিকে তাকালে সত্যিই যে কারও মনে হতে পারে, এই যাচ্ছেতাই আনাড়িপনা কি হচ্ছে প্রথমবার এমন বিধিনিষেধ দেওয়ার কারণে?

তবে বিধিনিষেধ যতই ‘উদ্ভট’ দেখাক না কেন তার একটি অন্তত সরকারের জরুরি প্রয়োজনে মেটাবে এটা নিশ্চিত। প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এটা ভাবার যথেষ্ট কারণ আছে, মূলত সেই শর্তটি দেওয়ার জন্যই এই তথাকথিত বিধিনিষেধ। সেই প্রসঙ্গে আসছি পরে।

রেস্তোরাঁয় খেতে হলে দুটি টিকা দেওয়া হয়েছে সেই সনদ প্রদর্শন করতে হবে। করোনার ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের কারণে করোনা সংক্রমণ আবার বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে সর্বশেষ ১১ বিধিনিষেধের মধ্যে এটি আছে। আছে গাড়ি চলানোর জন্য পরিবহন চালক এবং অন্যান্য পরিবহন কর্মীদের দুই ডোজ টিকা নেওয়ার শর্তও। ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই আদৌ, প্রায় দুই বছর করোনার সঙ্গে বসবাস করে দেশের যেকোনও নাগরিক জানে কত উদ্ভট প্রস্তাব এগুলো।

রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি সাফ জানিয়ে দিয়েছে, তারা কোনোভাবেই রেস্তোরাঁয় খেতে আসা কোনও মানুষকে ফিরিয়ে দেবেন না।

বিধিনিষেধ দেওয়া অপ্রয়োজনীয় ছিল কিনা সেই প্রশ্ন খুব যৌক্তিকভাবেই আছে। ওমিক্রন সম্পর্কে এখন পর্যন্ত যতটুকু তথ্য আমাদের কাছে আছে তাতে এটা মোটামুটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এই ভ্যারিয়েন্ট দিয়ে হওয়া কোনও ওয়েভে খুব খারাপ কিছু সম্ভবত হবে না।

ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টটির ভিরুল্যান্স অর্থাৎ মানুষকে সংক্রমিত করার ক্ষমতা অন্য ভ্যারিয়েন্টগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। তাই এটা নিশ্চিত, এই ধরনটি দ্বারা অনেক বেশি মানুষ আক্রান্ত হবে। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ইউরোপের যেসব দেশে এখন পর্যন্ত ভাইরাসের এই ধরনটি বেশি মানুষকে সংক্রমিত করেছে, সেখানে দেখা গেছে এই ভাইরাস মানুষের মৃত্যু ঘটানোর মতো ভয়াবহ অসুস্থতা তৈরি করার প্রবণতা আগেরগুলোর চেয়ে অনেক কম। মৃত্যুর হারও অনেক কম। শুধু সেটাই নয়, হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার মতো অসুস্থতাও তৈরি হচ্ছে অনেক কম সংখ্যক রোগীর ক্ষেত্রে।

তাহলে এই ভ্যারিয়েন্টের জন্য পদক্ষেপ হতে পারতো জরুরি ভিত্তিতে অনেক দ্রুত অনেক মানুষকে টিকার আওতায় নিয়ে আসা এবং সব জায়গায় মানুষকে মাস্ক পরার জন্য কঠোর নজরদারি এবং শাস্তির ব্যবস্থা করা। সঙ্গে হাসপাতালগুলোকে প্রস্তুত রাখা, যেন ভর্তি হতে বাধ্য হওয়া রোগীদের চিকিৎসা দিয়ে ভালোভাবে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া যায়।

করোনাভাইরাস বায়ু দ্বারা বাহিত হয় আমরা জানি। আমরা এটাও এখন সবাই জানি মাস্ক পরলেও ঝুঁকিমুক্ত থাকার জন্য দুটি মানুষের মধ্যে ন্যূনতম দূরত্ব হওয়া উচিত কমপক্ষে ৩ ফুট। তাই জনসমাগম বেশি হয় এমন স্থান করোনা সংক্রমণের জন্য অনেক বেশি উপযোগী।

করোনা ছড়ানোর জন্য উন্মুক্ত স্থানে জনসমাবেশের চাইতে আবদ্ধ স্থানে জনসমাগম অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। আবদ্ধ স্থানে করোনার জীবাণু দীর্ঘ সময় ধরে বাতাসে ভেসে বেড়াতে পারে। এটুকু যদি আমরা জানি, তাহলে বুঝতে পারবো আবদ্ধ স্থানে করোনা ছড়ানোর ক্ষেত্রে শীতকাল অনেক বেশি উপযোগী। শীতকালে আমরা যেহেতু দরজা-জানালা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বন্ধ করে রাখি, তাই ভেন্টিলেশন খুব কম হবার কারণে করোনার জীবাণু টিকে থাকার সম্ভাবনা অনেক বেশি বেড়ে যায়। তাই শীতকালে আবদ্ধ স্থানে জনসমাগম ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ।

দেশের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দোকান শুধু নয়, কেন্দ্রীয়ভাবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সব শপিং সেন্টার খোলা আছে। বছরের শুরুর দিন থেকে চলছে বাণিজ্য মেলা। এই দফার বিধিনিষেধ দেওয়ার সময় জানিয়ে দেওয়া হয়েছে বাণিজ্য মেলা চলবে। শীতকাল দেশের বিয়ের মৌসুম। গ্রাম ছাড়া বিয়ের অনুষ্ঠানগুলো হয় একেবারে আবদ্ধ জায়গায়। শুধু সেটা নয়, বিয়েতে ভূরিভোজনের ব্যবস্থা থাকে বলে মানুষকে মাস্ক খুলতেই হয় এবং বহু মানুষ অত্যন্ত কম দূরত্বে অবস্থান করে খেয়ে থাকেন।

অনেক বেশি হারে করোনা ছড়ানোর উৎস আসলে এগুলোই। তাই সত্যিকারভাবে কেউ যদি চান করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করবেন, তাহলে সবার আগে এগুলো বন্ধ করতে হবে। কিন্তু এই যাবতীয় সবকিছু খোলা আছে। বন্ধ করা হয়েছে উন্মুক্ত জায়গায় সব রকমের ধর্মীয়, সামাজিক এবং রাজনৈতিক সমাবেশ। এটাই আসলে সেই নিষেধাজ্ঞা, যার জন্য এই ১১ দফা বিধিনিষেধের ‘বাহানা’।

বেগম খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসার অনুমতিদানে সরকারের ওপর চাপ তৈরির প্রয়াসে বিএনপি সারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় জনসভা করছিল বেশ কিছু দিন। শুরুর দিকে ঢাকাসহ বেশ কিছু জায়গায় জনসভা করার ক্ষেত্রে সরকার বাধা দেয়নি। তাতে দেখা গেলো সেসব জনসভায় উপচে পড়া মানুষের ভিড়। এরপর যা হবার কথা হলো সেটাই—নানাভাবে সরকার জনসভাগুলোতে বাধা দিতে শুরু করলো। কখনও পুলিশ দিয়ে (হবিগঞ্জে) কখনও দলীয় নেতাকর্মী দিয়ে (সিরাজগঞ্জ), আবার কখনও নিজস্ব কোনও সংগঠনকে দিয়ে একই জায়গায় সমাবেশ ডাকিয়ে ১৪৪ ধারা জারি করার মাধ্যমে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং কক্সবাজারে ১৪৪ ধারা জারি করার পরও বিএনপির সমাবেশ ঠেকানো যায়নি। ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে তারা ভিন্ন জায়গায় সমাবেশ করেছে। এতে পূর্ব পরিকল্পিত স্থানে সমাবেশটি হলে সেটার আকার যেমন হতো, তার চাইতে ছোট হয়েছে। কিন্তু এটা আবার ভিন্ন একটা বার্তা দিয়েছে দলের নেতাকর্মীদের। সরকারের জারি করা ১৪৪ ধারা না মেনে জনসভা করার সক্ষমতা অর্জন করেছে বিএনপি।

বিশেষ করে ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে থেকে এখন পর্যন্ত বিরোধী দল দমনে সরকার রাষ্ট্রযন্ত্রকে নির্দয়ভাবে ব্যবহার করেছে। সরকারি বাহিনীগুলোর বিরুদ্ধে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং মামলার মাধ্যমে হয়রানির অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে এই ক্ষেত্রে সরকার সমস্যায় পড়েছে।

গ্লোবাল ম্যাগনিটস্কি হিউম্যান রাইটস অ্যাকাউন্টেবিলিটি অ্যাক্ট নামের আইনটির অধীনে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে পুলিশের এলিট ফোর্স র‍্যাব এবং এর বর্তমান এবং সাবেক সাত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। প্রাথমিকভাবে খুব আক্রমণাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখালেও পরবর্তী সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার চেষ্টা দেখা গেছে। এবং কিছু প্রাথমিক পদক্ষেপ লক্ষ করা যাচ্ছে। নিষেধাজ্ঞাটি দেওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত একটি ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধও ঘটতে দেখা যায়নি।

এই পরিস্থিতিতে বিএনপির জনসভাগুলো সরকারের জন্য সংকটের কারণ তৈরি করেছে। জনসভাগুলো ছত্রভঙ্গ করার জন্য যদি অনেক বেশি পরিমাণ বল প্রয়োগ করা হয় তবে সেটা আবারও পশ্চিমাদের চোখে পড়বে; সরকারের কর্মকাণ্ডের ওপরে পশ্চিমাদের বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টি এখন বহু বছরের তুলনায় অনেক বেশি।

সরকারের জারি করা ১৪৪ ধারা ভেঙে বিএনপি যদি একের পর এক জনসভায় করে যায়, সেটা বর্তমান সরকারের মতো একটি কর্তৃত্ববাদী সরকারের জন্য খুবই নেতিবাচক হবে। কে না জানে কর্তৃত্ববাদী সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকে বল প্রয়োগ করা এবং বল প্রয়োগ করার সক্ষমতার ভীতি তৈরির মাধ্যমে। সেই ভীতি যদি একবার ভেঙে যায় তাহলে এটা তার ক্ষমতার ভিতকেই নড়বড়ে করে দেবে।

ওমিক্রন সংক্রমণ ছড়াচ্ছে চারদিকে। বেশ কয়েক মাস ৩ শতাংশের নিচে থাকার পর দেশেও করোনা শনাক্তের হার আট শতাংশের বেশি হয়ে গেছে। এই সংক্রমণ ঠেকানোর অজুহাতে কিছু ধর্মীয়, সামাজিক আর রাজনৈতিক সমাবেশের বিধিনিষেধ চাপিয়ে দেওয়া হলো। এই একটি নিষেধাজ্ঞাই সরকারের জন্য প্রয়োজনীয় ছিল। শুধু এমন একটি নিষেধাজ্ঞা দেওয়া যায় না বলে তার সঙ্গে তাড়াহুড়ো করে যুক্ত করা হয়েছে আরও ১০টি বিধিনিষেধ। টিকা সনদ নিয়ে রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়া কিংবা বাস পরিচালনার মতো উদ্ভট নিয়ম করার কারণ এই তাড়াহুড়োজনিত অসতর্কতা।

লেখক: শিক্ষক ও অ্যাকটিভিস্ট

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আজকের আবহাওয়া: ঢাকাসহ ৩ বিভাগে বৃষ্টির পূর্বাভাস
আজকের আবহাওয়া: ঢাকাসহ ৩ বিভাগে বৃষ্টির পূর্বাভাস
ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়ার কাজ শুরু করেছেন প্রধানমন্ত্রী: ওয়াশিংটনে অর্থমন্ত্রী
ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়ার কাজ শুরু করেছেন প্রধানমন্ত্রী: ওয়াশিংটনে অর্থমন্ত্রী
ইউরোপা লিগ থেকে বিদায়ের ভালো দিক দেখছেন লিভারপুল কোচ
ইউরোপা লিগ থেকে বিদায়ের ভালো দিক দেখছেন লিভারপুল কোচ
রাশিয়ায় বোমারু বিমান বিধ্বস্ত
রাশিয়ায় বোমারু বিমান বিধ্বস্ত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ