X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

উৎসবের আলোয় খুশিমাখা মুখ

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
১৩ এপ্রিল ২০২২, ১৬:৪৪আপডেট : ১৩ এপ্রিল ২০২২, ১৬:৪৪
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা আবারও নতুন বছর, আবারও উৎসব। কাল পহেলা বৈশাখ। দুটি বছর করোনার দাপটে এই উৎসব হতে পারেনি এবং এবারও পড়েছে রোজার মাসে। গরমের তীব্র আমেজ মেখে এপ্রিল মাস, যে মাসের ১৪ তারিখ প্রতিবার উদযাপিত হয় পহেলা বৈশাখ, সে দিনটি কাল। উৎসবের আতিশয্যে, রঙে খুশি-খুশি অমোঘ প্রবণতায় বৈশাখ। কিন্তু এবারও নানা বিধিনিষেধের খড়গ।

গত কয়েক বছর ধরে বলা হচ্ছিল, সূর্যাস্তের আগে ঘরে ফিরে যেতে হবে। এবার রোজার কারণে নির্দেশনা এলো পহেলা বৈশাখের সব অনুষ্ঠান দুপুর দুইটার মধ্যে শেষ করতে হবে। কিন্তু মাইক বাজিয়ে সারা রাত নসিহতে বা গিবত গাওয়ায় কোনও বাধা আসে না কখনও।

আমাদের যত উৎসব আছে সে সবের মাঝে সবচেয়ে বর্ণিল পহেলা বৈশাখ। এবার পরিস্থিতি এমনিতেই কিছুটা নতুন প্রেক্ষাপটে বাঙালির এই প্রাণের উৎসব। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষিকার টিপ পরা নিয়ে পুলিশ কনস্টেবলের ইভ টিজিং, ধর্মানুভূতির ভুয়া অভিযোগে মুন্সীগঞ্জের বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে জেলে পাঠানো, আরও দুজন সংখ্যালঘু শিক্ষককে একইভাবে ফাঁসানোর চেষ্টা, বাগেরহাটে হিন্দু বাড়িতে আগুন দেওয়ার মাঝে দুয়ারে এসেছে বৈশাখ।

প্রতিটি উৎসব পালনেরই নিজস্ব প্রথা আছে। পহেলা বৈশাখেরও আছে। এটি বাঙালির একটি সর্বজনীন উৎসব। অতীতের ভুলত্রুটি ও ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে নতুন করে সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় উদযাপিত হয় নববর্ষ। আমাদের দেশে পহেলা বৈশাখের সবচেয়ে বড় উৎসব হয় ঢাকা শহরে। আর এই উৎসবের প্রাণকেন্দ্র বলা যেতে পারে রমনা বটমূলে আয়োজিত ছায়ানটের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানকে। সেই উৎসবকেও স্তব্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল একুশ বছর আগে। ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল (বাংলা ১৪০৮ সনের ১ বৈশাখ) পয়লা বৈশাখের দিন ভোরে রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানস্থলে দুটি বোমা পুঁতে রাখা হয় এবং পরে রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে তার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। সকাল ৮টা ৫ মিনিটে একটি ও ১০-১৫ মিনিটে আরেকটি বোমা বিস্ফোরিত হয়। বোমা হামলায় প্রাণ হারান ১০ জন। আহত হন আরও অনেকেই। এরপর থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়াকড়ি।

কারা করেছিল সেই হামলা? বা কারা এখন এই উৎসবের বিরোধিতা করে? উত্তর পাওয়া যাবে ইতিহাসে। পাকিস্তাানি শাসনামলে শাসকরা বাঙালি সংস্কৃতিকে দমিয়ে রাখার জন্য যত প্রকার অন্যায় করা যায় সব করেছিল। একবার ওরা রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এর প্রতিবাদেই ছায়ানট ১৩৭৫ বঙ্গাব্দে তথা ১৯৬৫ সালে রমনা পার্কে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের আয়োজন করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’ গানের মধ্যে দিয়ে স্বাগত জানানো হয় বৈশাখকে। সেই ধারা আজও অব্যাহত আছে। আর ১৯৭২ সাল থেকে জাতীয় উৎসব হিসেবেই পালিত হয়ে আসছে এটি। তাই স্পষ্ট করেই বলা যায়, ১৯৭১-এ পরাজিত পাকিস্তানপন্থী গোষ্ঠী সেই হামলা করেছিল এবং এখনও এর বিরোধিতা করে যাচ্ছে।

পহেলা বৈশাখ ঋতু উৎসব কিন্তু ধর্মোৎসব নয়। সাংস্কৃতিক উৎসব। সেই উৎসবে কারও যোগদানের অসুবিধা নেই। হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টানসহ সবার উৎসব। সবার অংশগ্রহণে এটি সবার উৎসব হয়ে ওঠে। একের নয়, গোষ্ঠীর নয়, সামাজিক আনন্দ এই উৎসবের প্রাণ। সেই উৎসবের পথ রোধ করে বিপন্নতা সৃষ্টি করতে যারা চায় তারা অন্ধকারের জীব।

পহেলা বৈশাখ সুদূর অতীত থেকে সম্প্রীতির অকৃত্রিম নিদর্শন বহন করে চলেছে। সারা বছর ধরে বিভিন্ন উৎসব পালন করা হলেও এই একটি উৎসবের মাজেজা আলাদা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার মঙ্গলশোভাযাত্রা এখন উৎসবের মূল আকর্ষণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন দিনে সব শ্রেণি পেশা ও ধর্মের মানুষ পথে নামে। এ শহর ধরে রেখেছে মিলনের এমনই উজ্জ্বল ছবি। এই শোভাযাত্রাকে ছড়িয়ে দিতে হবে সারা দেশে। তবেই বিঘ্ন সৃষ্টিকারীরা সমুচিত জবাব পাবে।

উন্নয়ন মানে শুধু অবকাঠামো নয়, মাথাপিছু আয় নয়, জিডিপির বাড়বাড়ন্ত নয়। বড় উন্নয়ন মনোজগতের উন্নয়ন যেন আপামর মানুষ উদারতাকে বড় করে দেখে, অসাম্প্রদায়িকতা আর সম্প্রীতিকে আপন করে ভাবে। ব্যক্তিগত স্তর থেকে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়— প্রতিটি ক্ষেত্রেই উন্নতি এবং অগ্রগতির জন্য সম্প্রীতি বজায় রাখা একান্ত প্রয়োজন। অর্থনৈতিক এবং সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অপরিহার্য অবশ্যই। নিজ নিজ ধর্মের প্রতি অতিরিক্ত রক্ষণশীলতায় জন্ম নিলো সাম্প্রদায়িকতার বীজ। সে বীজ বিষবৃক্ষের আকার নিয়েছে এবং নিয়ে চলেছে আজ দেশজুড়ে। বিশ্বের নানা প্রান্তের ছবিও তাই। কিন্তু আমাদের প্রমাণ করতে হবে যে আমরা ব্যতিক্রমী। সম্প্রীতিই এই জনপদের ধর্ম।

দুঃখ লাগে এ জন্য যে বাঙালি কী হতে চেয়েছিল আর আজ কী হলো! উৎসবের প্রতি বিমুখ করার শক্তি নিজেরা উৎসব করছে সবাইকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে। আমরা সব উৎসবে প্রশ্নহীন অবগাহন করতে চাই, সেটা ঈদ হোক, পূজা হোক, বৈসাবি হোক বা বৈশাখ হোক, মহররম হোক বা বড়দিন হোক। পথে পথে নাগরিক জীবনের শত বিপত্তি আমাদের অনিবার্য নিয়তি হলেও দেখতে চাই উৎসবের আলোয় খুশিমাখা মুখ মিলেমিশে একাকার।

লেখক: সাংবাদিক
 
 
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
একসঙ্গে ইফতার করলেন ছাত্রলীগ-ছাত্রদলসহ সব ছাত্রসংগঠনের নেতারা
একসঙ্গে ইফতার করলেন ছাত্রলীগ-ছাত্রদলসহ সব ছাত্রসংগঠনের নেতারা
শনিবার সকালে আবার অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা বুয়েট শিক্ষার্থীদের
শনিবার সকালে আবার অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা বুয়েট শিক্ষার্থীদের
ইসরায়েল যা যা অস্ত্র চেয়েছিল সব পায়নি: মার্কিন সেনাপ্রধান
ইসরায়েল যা যা অস্ত্র চেয়েছিল সব পায়নি: মার্কিন সেনাপ্রধান
ছুটির দিনে নিউ মার্কেটে জনসমুদ্র
ছুটির দিনে নিউ মার্কেটে জনসমুদ্র
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ