X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

যৌন হয়রানি ছাড়া কি সংবাদ নেই?

মোস্তফা হোসেইন
২০ এপ্রিল ২০২২, ১২:২৫আপডেট : ২০ এপ্রিল ২০২২, ১২:২৫

মোস্তফা হোসেইন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি মাদ্রাসায়ও হচ্ছে যৌন আক্রমণ। গণমাধ্যমে চোখ রাখলে কখনও কখনও মনে হয়, দেশে কি আর কোনও সংবাদ নেই? কী হচ্ছে একের পর এক। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন বিখ্যাত শিক্ষকের বিরুদ্ধে তারই শিক্ষার্থী অভিযোগ করেছেন নির্যাতনের। অভিযোগ প্রমাণ হয়েছে, প্রাতিষ্ঠানিক শাস্তি পেয়েছেন ওই শিক্ষক। কিন্তু প্রায় প্রতিদিনই এমন ঘটনা ঘটছে। পত্রিকায় সংবাদ হয়, পাঠক একটু আফসোস করেন, কষ্ট পান। তারপর? আবার সেই একই ঘটনা, একইরকম সংবাদ এবং পাঠকের দুঃখবোধ। কিন্তু কেন এই অধঃপতন?

নির্যাতনের মাত্রা এবং ধরনে নৃশংসতাও লক্ষণীয়। এই তো ১৬ এপ্রিল প্রকাশিত একটি সংবাদে দেখা গেলো, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীর জামা কাটার দিয়ে কেটে দিয়েছে মধ্যবয়সী এক পুরুষ। তাকে হাতেনাতে ধরে পুলিশেও দেওয়া হয়েছে। সংবাদে জানা গেলো, এই লোক শুধু ওইদিনই নয়, আগেও এভাবে অনেক মেয়ের জামা কাটার দিয়ে কেটেছে। প্রকাশিত সংবাদগুলোর বিশ্লেষণ করলে মনে হতে পারে এটা ক্ষুদ্র ঘটনা। ধর্ষণের পর হত্যার মতো ঘটনাও যেন কোনও বিষয়ই না। প্রায়ই এমন সংবাদ প্রকাশ হচ্ছে।

মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কথা বলা হয়, ধর্মীয় অনুশাসনের ঘাটতির কথাও বলা হয়। অথচ আমাদের দেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বলতে গেলে ধর্মীয় আচার-আচরণে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। প্রতিটি গ্রামে ২/৪টি করে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে। দুয়েক বাড়ির পর পর মসজিদ হয়েছে। গ্রামে গ্রামে আলেম ওলামা এখন সাধারণ বিষয়। যে পরিমাণ সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ আছে, মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা তার  চেয়ে কম নয়।

মসজিদগুলোতেও মানুষের ভিড় আছে। শুক্রবার রাস্তায় মসজিদ ফেরত মানুষের মিছিল দেখতে পাওয়া যায়। পবিত্র রমজানের পবিত্রতা রক্ষায় আগে প্রচার প্রচারণা চালানো হতো। মনে থাকার কথা সবারই, ঢাকা শহরের হোটেলগুলোর সামনে পর্দা টানিয়ে রমজানের সময় খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করা হতো। এ বছর পাড়া-মহল্লার ছোট রেস্টুরেন্টগুলোও বন্ধ দেখা যায়। তার মানে মানুষ আগের চেয়ে বেশি রোজা রাখছেন।

সাধারণ শিক্ষাক্ষেত্রেও লক্ষণীয় পরিবর্তন হয়েছে। ১৯% শিক্ষিতের বাংলাদেশে এখন শিক্ষিতের হার ৭০%-এর বেশি। যে দেশে যাত্রা হয়েছিল ৪/৫টি বিশ্ববিদ্যালয়সহ সেই দেশে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা প্রায় দেড়শত। প্রতিটি বাড়িতে উচ্চশিক্ষিত মানুষ পাওয়া যায় খোঁজ নিলেই।

অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কথাও যদি বলি, বলতে হবে, দেশটিতে এখন মানুষের খাবারের অভাব নেই। যে দেশে তিন বেলা খাবারের ব্যবস্থা করতে পারতো না ৯০ ভাগ মানুষ, সেই দেশে হতদরিদ্রের সংখ্যা কমতে কমতে সহনীয় মাত্রায় যাওয়ার পথে। কিন্তু মানুষের জৈবিক দুর্নীতির এই পর্যায় কেন?

শিক্ষা, অর্থনীতি সবদিকেই এগিয়ে যাওয়ার পরও নৈতিক অধঃপতন নিয়ে গবেষণা হচ্ছে শুনতে পাই। মাঝে মাঝে পত্রপত্রিকাতে এ বিষয়ে লেখাও প্রকাশ হয়। কিন্তু কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে কিনা তা প্রশ্নবিদ্ধই থেকে যায়।

স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা মাদ্রাসাগুলোতে যৌন হয়রানি বন্ধ করার শিক্ষা দেওয়ার কথা, মূল্যবোধ জাগ্রত রাখার কথাই শিক্ষা দেওয়ার কথা, তাহলে এসব প্রতিষ্ঠান কি মানবিক গুণাবলিতে সুস্থ ধারা প্রবাহের কথা বলে না?

এত সংবাদ হচ্ছে যৌন নির্যাতনের, এর বিপরীতে শাস্তির সংবাদ কয়টা পাচ্ছি আমরা? বলাৎকারের ঘটনায় জড়িত ব্যক্তির ছবিসহ ফেসবুকে পোস্ট দেওয়া হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের জড়িত থাকার বিষয়ও ফেসবুকে ভাইরাল হয়। পরিসমাপ্তিটা কী?

একজন বললেন, হাল আমলে আগের চেয়ে বেশি সংবাদ চোখে পড়ে, মূলত যোগাযোগ প্রযুক্তির প্রসারের কারণে। ক্ষেত্রবিশেষে মন্তব্য উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। আবার যুক্তিতে মিলেও না। যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নয়নের বিরূপ প্রতিফলন হবে বেশিরভাগ এটা মেনে নেওয়া যায় না। বলতে পারেন ইউটিউবে উত্তেজক ছবি কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে নারী বিদ্বেষী ওয়াজ মানুষকে কুপথে পরিচালিত করছে।

বিনোদন মাধ্যমে ইউটিউব এবং ইন্টারনেট সুবিধা যৌন নির্যাতনে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে প্রায় সবাই এটা বলেন। এ প্রসঙ্গে আমরা ভিডিও সুবিধা সম্প্রসারণকালের কথা মনে করতে পারি। আশির দশকেও পুরনো ঢাকার গলিতে গলিতে ভিডিও ব্যবসায় পর্নোগ্রাফির কথা অনেকেরই মনে থাকার কথা। রিকশায় করে সন্তানসহ বাবার যাত্রাপথে দালালদের খপ্পরে পড়ে অনেক সময় বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হতো।

ধীরে ধীরে সেই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। এখন তো সেই ভিডিও সুবিধা প্রতিটি মানুষের হাতের মুঠোয়, পকেটেই থাকে। যে কারণে অশ্লীল এবং উত্তেজক ছবি কিংবা পর্নোগ্রাফির সুযোগ বেড়ে গেছে। এমন পরিস্থিতি থেকে নিজেকে রক্ষা করার কৌশলই অবলম্বন করতে হবে আগে। তার উপায় কী?

আমাদের বিনোদন ব্যবস্থায় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এখন নেই বললেই চলে। আগে পাড়ায় পাড়ায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান কিংবা অন্যান্য বিনোদন ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য ক্লাব ছিল। তারা পাঠাগারও পরিচালনা করতো। আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো, পাঠাগার ব্যবহার ছিল বাধ্যতামূলক। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠাগার থাকলেও সেগুলো ব্যবহার হয় না। আমি মনে করি প্রতিটি স্কুলে বার্ষিক সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা, বই পড়ার ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করলে সুফল পাওয়া যেতে পারে। সমাজকল্যাণ বিভাগের নেতৃত্বে পাড়া মহল্লার ক্লাবগুলোকে আবার চালু করতে হবে। যাতে করে তারা সাংস্কৃতিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে। ইউটিউবে উত্তেজনাকর ওয়াজ মাহফিল প্রচার চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। পাশাপাশি পর্নোগ্রাফি প্রচারে প্রতিবন্ধকতার জন্য বিটিআরসির শক্ত অবস্থান গ্রহণ করতে হবে।

দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তথা স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসাকে সরকারের কাছে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। সামাজিক বিজ্ঞানীদের গবেষণারও প্রয়োজন আছে। কারণ, আমরা এখন প্রযুক্তি ব্যবহারের নতুন একটি ধারায় চলছি। এর সু-ব্যবহার এবং কু-ব্যবহার কীভাবে আমাদের ভালো-মন্দ করছে। এ থেকে কীভাবে মুক্তি পাওয়া যায় সেই পথ আমাদের বের করতে হবে। সবশেষে বলতে হবে, বিষয়টি নিয়ে আমাদের আরও গুরুত্বসহ ভাবতে হবে।

লেখক: সাংবাদিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হলো সেনাসহ ২৮৫ বিজিপি সদস্যকে
মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হলো সেনাসহ ২৮৫ বিজিপি সদস্যকে
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে করারোপ: আইনের বিশ্লেষণ
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে করারোপ: আইনের বিশ্লেষণ
ইউক্রেনে মার্কিন সামরিক সহায়তা আইনে বাইডেনের সই
ইউক্রেনে মার্কিন সামরিক সহায়তা আইনে বাইডেনের সই
নামাজ শেষে মোনাজাতে বৃষ্টির জন্য মুসল্লিদের অঝোরে কান্না
নামাজ শেষে মোনাজাতে বৃষ্টির জন্য মুসল্লিদের অঝোরে কান্না
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ