X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

মধ্যবিত্তের কষ্টের জীবন

প্রণব মজুমদার
১০ মে ২০২২, ১৭:৫৪আপডেট : ১৭ আগস্ট ২০২২, ১৬:৩১
সমাজে মধ্যবিত্ত এমন একটা শ্রেণি, যারা কষ্টের শেষ অবধি অপেক্ষা করে। কিন্তু প্রকট আত্মসম্মান বোধের কারণে মুখ ফুটে কিছু বলে না। না পারে উপরে উঠতে, না পারে নিচে নামতে। সিদ্ধান্তহীনতার দোদুল্যমান অবস্থা! ফলে নীরবে ধুঁকে ধুঁকে শেষ হয়ে যায় তারা। যাপনের কষ্টের কথা এরা খুব কমই প্রকাশ করে। অথচ সমাজ ও রাষ্ট্রের সব কাজের শ্রমে মধ্যবিত্তের মানুষের অবদান সবচাইতে বেশি। মধ্যবিত্তের শ্রেণির লোকদের কষ্ট মোচন ও মানবিক উন্নয়নে কেউ এগিয়ে আসে না। না সমাজ, না রাষ্ট্র।

বৈশ্বিক বড় একটা ধাক্কা গেলো সম্প্রতি। সামনে হয়তো আরও আসবে। তাছাড়া আমাদের দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ তো লেগেই থাকে। অতিমারি করোনার মন্দ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে আমাদেরও। করোনা সংকটের নেতিবাচক প্রভাব আমরা কীভাবে কাটিয়ে উঠবো; আমাদের অর্থনীতিতে তা সীতার অগ্নি পরীক্ষার মতোই। দীর্ঘমেয়াদের নেতিবাচক প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। আর সবচেয়ে বেশি লাভবান খাদ্যপণ্য, চিকিৎসা ও ওষুধ ব্যবসায়ীরা।

সংকটেও তারা অসহায় মানুষের ওপর জুলুম করেছে। অতি মুনাফার লালসা তারা দমন করেনি। মুনাফার কাছে তাদের মানবিক বোধ ও মনুষ্যত্ব ভূলুণ্ঠিত। মধ্যবিত্তের মানুষ সাহায্যের জন্য হাত পাততে চায় না। রিলিফের লাইনে দাঁড়ায় না। এ শ্রেণির লোকদের কষ্টে কেউ এগিয়ে আসে না।

ক্রমবর্ধমান দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতিতে আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত সমাজ বেশ নাজুক অবস্থায় রয়েছে। অনেকেই বলছেন মূল্যস্ফীতি না রোধ হলে এই শ্রেণির সংখ্যা কমে যাবে। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড মালপাস আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা বিবিসিকে সম্প্রতি বলেছেন, খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে মানবিক বিপর্যয় হতে পারে। খাদ্যপণ্যের এই উচ্চমূল্যের কারণে বিভিন্ন দেশে লাখ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়ে পড়বে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের নেতিবাচক পরিস্থিতি উল্লেখ করে মালপাস বলেন, খাদ্যের দাম রেকর্ড উচ্চতায়। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে খাদ্যের দাম ৩৭ শতাংশ বাড়তে পারে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবে, গত ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ১৭ শতাংশ। কয়েক মাস ধরেই মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের আশপাশেই আছে। এ ছাড়া স্থানীয় বাজারে চাল, তেলসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী। কোনও বাজারই সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই। করোনার ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার পর সাধারণ মানুষ পড়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অতিমূল্যের রোষানলে। এমন কোনও পণ্য নেই যার দাম বাড়েনি। বৃদ্ধির এই হার ২০ থেকে ৩০ শতাংশ। যাপন কষ্টের নাভিশ্বাস থেকে বাঁচার উপায় কী? করোনা সংকটের দোহাই দিয়ে প্রতিষ্ঠান থেকে ছাঁটাইকৃত কর্মী এবং পারিশ্রমিক বন্ধ রাখা মানুষগুলো বাড়তি অর্থ পাবে কোথায়?

গত ২২ ফেব্রুয়ারি দেশের তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী জনসাধারণের ‘ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির কথা’ দেশবাসীকে শোনালেন। বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় গত ১৩ বছরে সাড়ে চারগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে তিনগুণ। তিনি বেশ গর্বের সঙ্গেই সাংবাদিকদের এসব কথা শোনালেন। সরকারের অনেকেই মাঝে মধ্যে আমাদের এ ধরনের কথা মনে করিয়ে দেন। কিন্তু মাথার মধ্যে এসব ইতিবাচক মন্তব্য ঢুকালেও দেশের সাধারণ মানুষের যাপিত জীবন কিন্তু এসব কথা মোটেও সমর্থন করে না। সাধারণের বাস্তব জীবন এসবের বিপরীত চিত্রই আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।

জাতীয় আয় অথবা মাথাপিছু আয়ের যে অঙ্ক সরকার প্রকাশ করে, তা একটি ‘গড়ের’ হিসাব। এরমধ্যে বাংলাদেশের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তির আয়ের হিসাব যেমন থাকে, তেমনি থাকে সবচেয়ে গরিব লোকের আয়ের হিসাবও। এমনকি যার কোনও আয়ই নেই, তার হিসাবও এর মধ্য ধরা হয়। কোনও দেশের মোট জাতীয় আয়কে সেই দেশের মোট জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করে মাথাপিছু আয় বের করা হয়। এতে দেশের প্রকৃত অবস্থা প্রতিফলিত হয় না। ধনী-গরিব সব সমান হয়ে যায়। শাসকদের শুভঙ্করের ফাঁকি আসলে এখানেই।

সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির হিসাবটি বাস্তবতার সঙ্গে একেবারেই মেলে না। হ্যাঁ, ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে এটা সত্যি; তবে তা কিছু লোকের, যাদের সম্পদের নেই কোনও সঠিক পরিসংখ্যান। এই শ্রেণির লোকের ক্রয় ক্ষমতাকেই ভিত্তি বা ‘স্ট্যান্ডার্ড’ হিসেবে জনগণের সামনে উপস্থাপন করা হচ্ছে। যে হারে দেশে ধনী লোকের সংখ্যা বাড়ছে, সে হারে কি দরিদ্র লোকের সংখ্যা কমেছে? কিংবা ধনী-গরিবের পার্থক্য কমেছে?

বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় গত ১৩ বছরে সাড়ে চারগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে বলে মন্ত্রী মহোদয় ঢোল বাজাচ্ছেন। সরকারি হিসাব বাদ দিলেও দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার হিসাব মতে, দেশে প্রায় চার থেকে পাঁচ কোটি লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বেকার। কোটি কোটি বেকার লোকের কি কোনও ক্রয়ক্ষমতা থাকে? যাদের কোনও আয়ই নেই, তাদের আবার ব্যয় করার ক্ষমতা থাকে কীভাবে? কাজেই সরকার যে কথায় কথায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে বলে বড়াই করে, তা কি পুরোপুরি ঠিক? দেশের মুষ্টিমেয় লোকের ক্রয়ক্ষমতা পরিসংখ্যানভাবে বৃদ্ধি পেলেও, এক্ষেত্রে দেখা দরকার দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তাদের চাহিদা অনুযায়ী মৌলিক পণ্য কিনতে পারেন কিনা। দেখা দরকার, তারা কতটুকু স্বস্তিময় জীবনযাপন করতে পারছেন। শুধু বড় বড় অনুৎপাদনশীল উড়াল সড়ক, সেতুসহ রাস্তাঘাট করে দেখালেই কী দেশের সাধারণ মানুষের আয়-উন্নতি হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায়?

দেশের সব মানুষের ক্রয়ক্ষমতা যদি বৃদ্ধিই পায়, তাহলে তরুণ সমাজ কেন এত বিদেশমুখী হচ্ছেন? ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে দেশের এসব তরুণের সলিল সমাধি হওয়ার খবর আমাদের প্রায়ই ব্যথিত করে। এসব তরুণের বেশিরভাগই শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করে, নয়তো ঋণ করে বিদেশে যায়। দেশ যখন নিম্ন থেকে মধ্যম আয়ের দিকে যাচ্ছে তখন কীসের আশায়, কীসের নেশায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এসব তরুণ দেশ ছাড়ছেন? কেন অপঘাতে প্রাণ হারাতে হচ্ছে তাদের?

দেশের জাতীয় ও মাথাপিছু আয় বাড়লেই যে সব মানুষের জীবনযাত্রার মান বা ক্রয় ক্ষমতা বাড়ে, অর্থনৈতিক সূত্র কিন্তু তা সমর্থন করে না। মাটি এক জায়গায় উঁচু করতে হলে, অন্য জায়গায় নিচু করতে হয়- এটাই প্রকৃতির নিয়ম। দেশে একজন কোটিপতি তৈরি হলে, তার জন্য হাজার হাজার মানুষকে আধপেট খেয়ে থাকতে হয়; অনেককেই নিঃস্ব হতে হয়। এটাই পুঁজিবাদী অর্থনীতির নিয়ম। সামষ্টিক অর্থনীতির পরিসংখ্যান দিয়ে সত্যিকারের তৃণমূল মানুষের অবস্থা বোঝা যায় না। এক্ষেত্রে দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও, অন্যদিকে দেশে বাড়ে চরম বৈষম্য। শহরে বড় বড় শপিং মল গড়ে উঠেছে; গড়ে উঠছে বড় বড় অবকাঠামোও। সেই সঙ্গে বাড়ছে টিসিবির ট্রাকের পিছনে দাঁড়ানো মানুষের সংখ্যাও।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ ‘ওয়েলফেয়ার মনিটরিং জরিপের’ অনুসন্ধান অনুযায়ী, মাত্র ৪ দশমিক ২ শতাংশ মানুষের হাতে দেশের সম্পদের সবচেয়ে বড় অংশ এখন কুক্ষিগত। কোনোভাবে দিন পার করছেন দেশের প্রায় ৫ কোটি ৪৫ লাখ ৬০ হাজার মানুষ। আর দারিদ্র্য নিত্যসঙ্গী এমন মানুষের সংখ্যা দেশে প্রায় ৫ কোটি ১০ লাখ ৪০ হাজার জন। অথচ বঙ্গবন্ধুর জীবন দর্শন ছিল এ দেশের গণমানুষের মুখে হাসি ফোটানো, তাদের সুখ-সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ছিল এক গভীর মানবিক সংগ্রামী দর্শন। অথচ মাত্র ৪০ থেকে ৫০ হাজার লোকের কাছে দেশের ৪০ শতাংশের বেশি সম্পদ আজ কেন্দ্রীভূত হয়েছে। যা খুবই পরিতাপের বিষয়। আর এটাকেই দেশের নীতিনির্ধারকরা উন্নতির মূলধারা বলে প্রচার করে বেড়াচ্ছেন।

অতিমারির সংকটের সময় মহানগরে কর্মহীন মানুষ বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের আর্তনাদ আমরা বেশ ভালোভাবে অনুভব করেছি। রাজধানী ছেড়ে এ শ্রেণির অনেক ভাড়াটিয়া রাতের আঁধারে পালিয়ে গেছেন। সেসব মানুষের যাপিত জীবনের যন্ত্রণা এখনও কাটেনি। বহু এলাকার দেয়ালে এখন অনেক ঝুলছে ‘টু লেট’ বিজ্ঞপ্তি। কিন্তু বাড়ি খালি পড়ে থাকলেও মালিক ভাড়া কমাচ্ছেন না। বহুল প্রচারিত জাতীয় একটি দৈনিক বলেছে ২০২১ সালে বসবাসকারী মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ রাজধানী ছেড়েছে। অধিকাংশই ভাড়াটিয়া।

ঢাকাসহ সারা দেশের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার ২ হাজার ৩৭১ জনের সাক্ষাৎকার নিয়ে ব্র্যাক ২০২০ সালের মে মাসে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। তাতে দেখা যায়, ৩৬ শতাংশ লোক চাকরি বা কাজের সুযোগ হারিয়েছেন। ৩ শতাংশ লোক চাকরি থাকলেও বেতন পাননি। আর দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে যারা কাজ করেন, তাদের ৬২ ভাগই কাজের সুযোগ হারিয়েছেন। করোনার কারণে ১০টি জেলার মানুষের আয় কমে গেছে। ঢাকা জেলার মানুষের আয় কমেছে ৬০ ভাগ।

সঞ্চিত অর্থ হারিয়ে করোনার পর নিম্ন আয়ের বহু মানুষ রাজধানী ছেড়ে গ্রামে চলে গেছে। ঈদুল ফিতরের ছুটিতে লাখো লাখো মানুষ দেশের বাড়ির উদ্দেশে ঢাকা ছেড়ে গেছেন। এদের মধ্যে বেকার ও অর্থকষ্টে থাকা মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির সদস্যরাই বেশি। আয়ের বেশিরভাগ ব্যয় বাসা ও ঘর ভাড়ায় চলে যায়। তাই যাপন কষ্ট ও কর্মসংস্থানের কথা ভেবে এরা মহানগরে ফিরবে কিনা অনিশ্চিত!

বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, আমদানি ব্যয়ের দায় মেটাতে রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়ছে। ঊর্ধ্বমুখী মার্কিন ডলার মূল্যে ব্যয় পরিশোধ করতে হচ্ছে। দেশ অর্থনীতির আগামী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য ৪টি দিকে সরকারকে গুরুত্ব দিতে হবে। আপাতত বিলাস পণ্যের আমদানি বন্ধ রাখা, পণ্য বাজার কঠোর হস্তে নিয়ন্ত্রণ ও দেশে খাদ্যপণ্যে রেশনিং প্রথা পুনরায় চালু করা, কৃষিপণ্য উৎপাদন বৃদ্ধি ও বিপণন ব্যবস্থায় পথে পথে চাঁদাবাজি বন্ধ করা এবং জ্বালানি তেলের মূল্য কমানো।

অর্থশাস্ত্রের ছাত্র হিসেবে মনে করি বর্তমান সরকারের সে সক্ষমতা রয়েছে। উল্লেখিত ব্যবস্থাগুলো কার্যকর করা হলে দেশে মধ্যবিত্ত মানুষের যাপন কষ্ট আস্তে আস্তে কমে যাবে।


লেখক: সাহিত্যিক ও অর্থকাগজ সম্পাদক
[email protected]
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
লিভারপুলের নতুন কোচ স্লট!
লিভারপুলের নতুন কোচ স্লট!
ক্ষমতায় যেতে বিএনপি বিদেশি প্রভুদের দাসত্ব করছে: ওবায়দুল কাদের
ক্ষমতায় যেতে বিএনপি বিদেশি প্রভুদের দাসত্ব করছে: ওবায়দুল কাদের
লেবাননের ইসরায়েলি হামলায় নিহত ২
লেবাননের ইসরায়েলি হামলায় নিহত ২
হামলার ঘটনায় মামলা করায় এবার বোমা হামলা, আহত ১৫
হামলার ঘটনায় মামলা করায় এবার বোমা হামলা, আহত ১৫
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ