X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশে ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজ অর্জন হবে যে পথে (চতুর্থ পর্ব)

ডা. মালিহা মান্নান আহমেদ
১৫ মে ২০২২, ১৫:৪১আপডেট : ১৫ মে ২০২২, ১৫:৪১

বিশ্বের সব স্বাস্থ্য ব্যবস্থারই সুবিধা-অসুবিধা আছে। আমরা সেগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে যুৎসই একটি কৌশল বের করতে পারি। তবে আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে এর ফলাফলটা আমাদের উপকারেই আসবে। প্রচলিত স্বাস্থ্য ব্যবস্থাটা এখনও বিক্ষিপ্ত বলা যায়, এবং এ সংক্রান্ত অনেক সেবা আছে যেগুলোর আনুষ্ঠানিক কোনও হিসাব নেই। এই সামগ্রিক বাস্তুসংস্থানে নতুন কিছু আনতে গেলে একটি পরিষ্কার প্রত্যাশা ও কৌশলের আশ্রয় নিতে হবে। যেটাকে পরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অর্জনযোগ্য লক্ষ্যে ভাগ করতে হবে। তো, ২০৩২ সালের মধ্যে বাংলাদেশের ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজ অর্জনের যে প্রত্যাশা রয়েছে সেটার জন্য কিছু মৌলিক নীতি আগেই ঠিক করে নিতে হবে।

প্রথমত, স্বাস্থ্যের সংস্কার যেমনই হোক না, সেটার কেন্দ্রে থাকবে প্রাথমিক সেবা। একজন ব্যক্তির জীবনের সব স্তরে যখন প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত হবে, তখন এটাই তার স্বাস্থ্য-চাহিদার ৮০-৯০ ভাগ মেটাবে। এমনকি এ সেবা ওই ব্যক্তির ভূমিষ্ট হওয়ার আগেই শুরু হতে পারে।

এ অভিযাত্রা শুরু করা যায় জনসাধারণকে স্বাস্থ্য-শিক্ষা প্রদানের মধ্য দিয়ে, যাতে তাদের মধ্যে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সেবা চাওয়ার মানসিকতা তৈরি হয়। পাশাপাশি হবু মায়েদের প্রসবোত্তর সেবা এবং শিশুর নিরাপদ প্রসবও নিশ্চিত হয়। আবার নবজাতকের টিকাদানসহ প্রতিরোধযোগ্য ও নিরাময়যোগ্য রোগগুলো নিয়ে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে সচেতনতা গড়ে তোলা এবং অসংক্রামক ব্যধিতে আক্রান্ত হলে সেটার জটিলতা যেন না বাড়ে সে সংক্রান্ত ব্যবস্থাপনাও এ অভিযানের অংশ।

আমরা আমাদের জনসাধারণকে যত সুস্থ রাখতে পারবো, ততই তাদের স্বাস্থ্যসেবার খরচ কমিয়ে আনা যাবে এবং গোটা সিস্টেমের ওপর চাপও তত কমে আসবে।

স্বাস্থ্য-বিমা হলো এমন একটি অনুষঙ্গ যার মূল লক্ষ্যই হলো এমনভাবে ঝুঁকি-বিন্যাস করা যেখানে এ সংক্রান্ত তহবিলটাকে সমভাবে বণ্টন করা সম্ভব হয়। এতে করে দুর্বল স্বাস্থ্যের লোকদের স্বাস্থ্যসেবার উচ্চ-ব্যয়টা পূরণ করা যাবে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী লোকদের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত অল্প খরচের মাধ্যমে।

এখানে মূল চাবিকাঠিটা হলো তালিকাভুক্ত ব্যক্তিবর্গের স্বাস্থ্যসেবার ব্যয়ের গড়; যার ফলে এই বণ্টন ব্যবস্থায় যদি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী লোকের সংখ্যা বেশি থাকে তবে বিমার প্রিমিয়ামের অর্থ একটি ভারসাম্যমূলক অবস্থায় থাকবে। এ কারণেই সহজসাধ্য, প্রতিরোধমূলক ও প্রচারমুখী যত্নের মাধ্যমে একটি শক্তিশালী প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাই পারে মানুষজনকে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী বানাতে, যাতে করে তাদেরকে বিমাদাবির পেছনে ছুটতে না হয়।

বাংলাদেশে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কর্মী বেশি। যে কারণে মনে হতে পারে ঝুঁকি বণ্টনের তহবিলটা এক্ষেত্রে যুক্তযুক্ত নয়। তবে বিশ্বব্যাপী দেখা গেছে, পর্যায়ক্রমে আউট-অব-পকেট (ওওপি) খরচ কমিয়ে আনার নেপথ্যে সামাজিক সুরক্ষা স্কিম কার্যকর ভূমিকা রেখেছে।

বর্তমানে, সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য সক্রিয় বিভিন্ন স্কিমে সরকারের তহবিল বণ্টন চোখে পড়ে। এছাড়া কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও এনজিও তাদের কর্মীদের স্বাস্থ্য-বিমা সুবিধা দিচ্ছে।

তথাপি এ সকল সুবিধা এক করলেও তা ১৭ কোটি মানুষের দেশটির সাপেক্ষে যথেষ্ট নয়। তবে তামাক ও কোমল পানীয় প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলো থেকে নেওয়া বাড়তি কর ও অন্যান্য উদ্বৃত্ত শুল্ক মিলিয়ে আমাদের হাতে হয়তো একটা বড়সড় তহবিল থাকতে পারে। ওই টাকা পুরোপুরি স্বাস্থ্যখাতের বিভিন্ন প্রোগ্রামের অর্থায়নের জন্যই সুনির্দিষ্ট থাকবে এবং সবচেয়ে ঝঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দিতেই ব্যয় হবে।

তথাপি, একবার এই বিমা স্কিম চালু হওয়ার পর তা যদি বিনামূল্যে করে দেওয়া হয় তবে সামগ্রিকভাবে সরকারের স্বাস্থ্যসেবা ব্যয় বাড়বে। কারণ, তখন লোকজনের স্বাস্থ্যের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিই বদলে যাবে।

তাই এ ব্যবস্থায় ততক্ষণ রাতারাতি কোনও পরিবর্তন সম্ভব হবে না, যতক্ষণ না স্বাস্থ্যখাতে আরও মানবসম্পদ বাড়ানো হচ্ছে।

দেশের ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্প এখনও অতটা এগিয়ে যায়নি যে তারা গবেষণা করবে ও নতুন ওষুধ আবিষ্কার করবে। তবে বাংলাদেশে এ খাত যথেষ্ট সমৃদ্ধ এবং জরুরি সব ওষুধের অভ্যন্তরীণ চাহিদা সুলভে মেটাতে পারছে।

অনেকের জন্য স্থানীয় ফার্মেসিগুলোই স্বাস্থ্যসেবা খাতের প্রথম যোগাযোগ পয়েন্ট। সে হিসেবে এ খাতটিকেও আমরা উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও জবাবদিহির আওতায় এনে আনুষ্ঠানিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী হিসেবে গড়ে তুলতে পারি।

আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে অন্যসব খাতের চেয়ে স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামোর প্রবৃদ্ধির গতি কিছুটা কম হতে পারে। তবে চাহিদা যেহেতু আছে, এটা সম্ভব হবেই।

সামনে যদি কোনও মেডিক্যাল কলেজ স্থাপন করতে হয়, তবে সেটা গ্রামাঞ্চলে করা যায়। এতে সুবিধা মিলবে অনেক।

গ্রামীণ জনগোষ্ঠী তখন আরও বেশি স্বাস্থ্য, প্রাথমিক সেবার আওতায় আসবে, আরও বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থী মেডিক্যালে ভর্তির সুযোগ পাবে এবং ওই অঞ্চলে অর্থনৈতিক কার্যকলাপ বাড়বে। সেখানকার জমির দাম তুলনামূলক কম বলে অবকাঠামো তৈরির খরচও পড়বে কম।

সেবার আওতা বাড়াতে ই-হেলথ সিস্টেম, টেলিমেডিসিন ও রেফারেল সিস্টেমকে আরও সমৃদ্ধ করাও হতে পারে একটি যুগোপযোগী পদক্ষেপ। এরইমধ্যে মহামারি আমাদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের গতানুগতিক ধারাটাকে ব্যাপকভাবে বদলে দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট নানান পক্ষের সমন্বিত অংশগ্রহণ ও তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় বলা যায় রাতারাতিই রোগীর পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা চলে গিয়েছিল ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে।

অগণিত সমন্বিত কার্যক্রম প্রতিষ্ঠা করতে পারে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম। যেগুলো একযোগে ব্যবহৃত হতে পারে  স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নয়নে, স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে সময়মতো স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, রোগীর অংশগ্রহণ, প্রটোকল মেনে চলা ও সংক্রমণের গুচ্ছের ওপর নজরদারি করার ক্ষেত্রে।

এতে করে আমলতান্ত্রিক নানান স্তরের জটিলতাও কমবে, সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে দ্রুত। একইসঙ্গে সেবা প্রদানকারীরাও তাদের সেবার মানের জন্য আসবে জবাবদিহির আওতায়।

জনসংখ্যার বিচারে বাংলাদেশ অনেক বড় দেশ। এখানকার স্বাস্থ্যসেবা খাতের উন্নয়নে বিকেন্দ্রীকরণের বিকল্প নেই। পরিশেষে, সুস্থ ও উৎপাদনশীল জনগণই একটি অর্থনৈতিকভাবে দৃঢ় জাতির মেরুদণ্ড হিসেবে কাজ করে। যে কারণে এই মানব-মূলধনের যথাযথ যত্নও নেওয়া চাই।

সম্প্রতি হোয়াইট হাউস কোভিড রেসপন্স কো-অর্ডিনেটর হিসেবে বেশ নামকরা একজন ডাক্তারকে নিয়োগ দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। তিনি বলেছেন, সিস্টেমের চেয়েও বড় কথা হলো ফলাফল। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কীভাবে সাজানো হলো সেটা দিয়ে এর বিচার করলে হবে না, বিচার করতে হবে এর ফল কী তা দিয়ে। প্রশ্নটা হবে, একটি স্বাস্থ্যসেবা সিস্টেমের যা করা উচিত, সেটা আদৌ হচ্ছে কিনা।

অনেক উন্নত দেশের চেয়ে ভালোভাবে মহামারি সামাল দিতে পেরেছে বাংলাদেশ। মহামারির বিভিন্ন পর্যায়ে সঠিক কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ফলেই তা সম্ভব হয়েছে। বিশেষ করে জনগণ, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও উন্নয়ন সংস্থার সমন্বিত প্রচেষ্টাতেই এটা হয়েছে। আমাদের স্বাস্থ্য খাত যদি আবার মহামারির আগের অবস্থায় ফিরে যায় তবে সেটা বেশ হতাশাজনক হবে। কারণ, এখন তো এটা পরিষ্কার যে, লক্ষ্য ও অভিপ্রায় যদি সঠিক হয় তবে সব ঠিক করে ফেলতে পারি আমরা।

লেখক: অর্গানিকেয়ার-এর প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক। এমবিবিএস, এমবিএ ও হেলথ কেয়ার লিডারশিপে স্নাতকোত্তর।

প্রথম পর্ব: ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজ ও হেলথ সিস্টেম
দ্বিতীয় পর্ব: ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজ: উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা
তৃতীয় পর্ব: ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজ ও বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা

 

/এফএ/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
টিভিতে আজকের খেলা (২৫ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৫ এপ্রিল, ২০২৪)
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ