X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

সব ভালো আর সব খারাপের মানসিকতা

মাসুদ কামাল
০৫ জুন ২০২২, ১৮:২০আপডেট : ০৫ জুন ২০২২, ১৮:২০
আমার এক বন্ধু আছেন, তিনি সবকিছুর মধ্যেই সমস্যা খোঁজেন। তাকে মোটামুটি জাত সমালোচক বলা যায়। রাজনৈতিকভাবে তার কিছুটা পক্ষপাতিত্ব আছে, একটু বিএনপি-ঘেঁষা। অথবা বলা যায় আওয়ামী লীগ-বিরোধী। ফলে বর্তমান সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত ও কর্মকাণ্ড নিয়ে সুযোগ পেলেই তিনি সমালোচনা করেন।

দু’দিন আগে তার সঙ্গে টেলিফোনে কথা। আসলে তার সঙ্গে আমার কথাবার্তা টেলিফোনেই হয় বেশি। এবার কিন্তু প্রসঙ্গটা আমিই তুললাম। বললাম, সবকিছুতেই তো ভুল দেখেন, কিন্তু সরকার কি ভালো কিছু করে না? এই যে দেখুন, দেশজুড়ে বিভিন্ন অবৈধ ক্লিনিকগুলোতে অভিযান চালানো হচ্ছে, সেগুলো সিলগালা করে বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে, এটাকে কি আপনি ভালো বলবেন না? অথবা ধরুন, চালের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য মজুতদারদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা, করপোরেট ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কার্যক্রম, কী বলবেন একে?

তিনি একটু বিস্মিত হলেন বোধকরি। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। আমার মনে হলো, তিনি হয়তো ভেবেছিলেন সরকারের ভালো কাজের কথা বলতে গিয়ে আমি বুঝি পদ্মা সেতুর কথা বলবো। কারণ, পদ্মা সেতুই এখন খুব টাটকা ইস্যু। সরকারের সাফল্য বোঝাতে আজকাল সবাই প্রথমেই এর প্রসঙ্গটি তুলে নিয়ে আসে। এমনকি এই সেতু পারাপারে যে টোল ধরা হয়েছে, সেটাকেও যথাযথ বলে প্রমাণের চেষ্টা করে। হিসাব করে দেখিয়ে দেয়, ফেরিতে পার হতে কত সময় লাগতো, কত সময় ঘাটে অপেক্ষা করতে হতো, অপেক্ষা করতে গেলে বাড়তি সময়ের পাশাপাশি বাড়তি অর্থও ব্যয় হতো। তাই সেসব ঝামেলার কথা মাথায় রাখলে ফেরির দেড়গুণ টোল নির্ধারণ খুবই যুক্তিযুক্ত হয়েছে। এর বিপরীতে কেউ কেউ যে যুক্তি দেয় না, তাও নয়।

তাই সে বিতর্কে না গিয়ে বরং নিরাপদ বিবেচনায় অবৈধ ক্লিনিক আর চালের মজুতদারদের বিরুদ্ধে অভিযানের কথা বললাম। শুরুতে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকলেও একটু পরেই তিনি ফর্মে ফিরে এলেন। ‘যেখানে মানুষের ভোটাধিকারই নেই, সেখানে এরকম দু-একটা অভিযানের কথা বলে কী লাভ? এরা তো মানুষের ভোটের অধিকারই কেড়ে নিয়েছে, মানুষ এখন আর চাইলেই ভোট দিতে পারে না। ভোটের দিন কেউ আর আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলতে পারবে না, এই যাচ্ছি ভোট দিতে, নিজের ভোটটা নিজের ইচ্ছামতো দিয়ে আসবো। গণতন্ত্রের মূল কথাই হচ্ছে জনগণের ভোটাধিকার, সেটাই নেই আমাদের। তাই কোথায় অবৈধ ক্লিনিকের বিরুদ্ধে অভিযান হলো, কোথায় চালের মজুত জব্দ করা হলো, সেসবে কী যায় আসে।’

আমাকে তখন আলাপের নেশায় পেয়েছে। একটু রস করেই বললাম, ‘আগামীকালই কি কোনও ভোট আছে? ভোটাধিকার নিয়ে আপনাদের আন্দোলন চলতে থাকুক, যখন ভোটের সময় আসবে তখন দেখা যাবে। তখন না হয় আপনাদের সঙ্গে ভোটাধিকারের কথা আমিও বলবো। কিন্তু এখন যে দুটো ভালো ঘটনার কথা বললাম, তার জন্য কি কোনও সাধুবাদ দেওয়া যায় না?’

ওপাশ থেকে তাৎক্ষণিক কোনও জবাব এলো না। কিছুক্ষণ নীরবতা। আমি বললাম, ‘আচ্ছা হাইপোথেটিক্যালি ধরে নিলাম আপনার কথাই ঠিক। এরা জনগণের ভোটে ক্ষমতায় আসেনি। জোর করে এসেছে। সেজন্য এদের প্রতি আপনার অনেক রাগ, অনেক ঘৃণা। আবার দেখুন, আপনার এত শক্তি বা ক্ষমতাও নেই যে এদের আপনি বা আপনারা এখনই গদি থেকে নামিয়ে দিতে পারবেন। তাহলে কি দাঁড়াচ্ছে, আগামী নির্বাচনের আগ পর্যন্ত এরা ক্ষমতায় থেকেই যাচ্ছে। এমন অবস্থায় তারা যদি অবৈধ ক্লিনিক ও মজুতদারদের বিরুদ্ধে অভিযান না চালাতো, তাহলে আপনি কী করতেন? কী বলতেন? বলতেন নাকি, ওদের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন? নিশ্চয়ই বলতেন। কিন্তু এখন যখন ব্যবস্থা নিয়েছে, তখন সেটাকে ভালো বলতে আপনার মন সায় দিচ্ছে না!’

তিনি বললেন, ‘এদের ক্ষমতায় যাওয়াটাই অবৈধ। অবৈধভাবে ক্ষমতায় বসে তারা যা কিছু করুক না কেন, তার মধ্যে হয়তো কিছু ভালো কাজও থাকতে পারে, সেসব তাদের ওই বড় অন্যায়টিকে বিলুপ্ত করে দেয় না। বরং এসব ছোট ছোট কাজকে প্রশংসা করলে প্রকারান্তরে তাদের ওই বৃহত্তম অন্যায়কেই আশকারা দেওয়া হয়।’

বুঝলাম, কোনোভাবেই উনি সরকারের ভালো কোনও কাজের স্বীকৃতি দেবেন না।

সমস্যা হলো, এ ধরনের মানুষের সংখ্যা সমাজে কিন্তু একেবারে কম নয়। আমাদের এই দেশে এমন অনেক মানুষ রয়েছেন, যারা সবকিছুই দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেন। পুরো দেশের জনসংখ্যার হিসাবে তারা হয়তো সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়, তবে তাদের উপেক্ষা করা যাবে না। কারণ, তারা ক্ষমতাবান, তারাই ডিসিসন মেকার। যখন তারা সরকারে থাকেন, তখন এক ধরনের ক্ষমতা উপভোগ করেন, আবার যখন সরকারের বাইরে থাকেন, তখন অন্য এক ধরনের ক্ষমতা ব্যবহার করেন। এরা বিপক্ষ দলের সবকিছুতেই ভুল দেখেন, আর নিজ দলের সবকিছুকেই সঠিক মনে করেন।

আমরা যদি ৯১ সাল থেকে ২০০৮ পর্যন্ত ধরি, দেশ পরিচালিত হয়েছে একবার খালেদা জিয়া, একবার হাসিনা- এমন করে। এরপর আওয়ামী লীগ টানা ক্ষমতায় আছে। আচ্ছা, এখন যিনি আওয়ামী লীগ করেন তাকে জিজ্ঞাসা করুন তো- এই সময়ে শেখ হাসিনা কী কী ভুল করেছেন? জবাব পাবেন- একটিও না! আর খালেদা জিয়া কী কী ভালো কাজ করেছেন? এক্ষেত্রেও জবাব আসবে- একটিও না! আবার এর উল্টোটিও করে দেখতে পারেন। বিএনপির একজন নেতার কাছে জানতে চান। দেখবেন, তিনিও খালেদা জিয়ার কোনও ভুলের কথা বলবেন না, শেখ হাসিনার কোনও ভালোর কথা বলবেন না। তাহলে দাঁড়ালোটা কী?

আপনার কাছে সরকারের সব কাজ ভালো নাও লাগতে পারে। সে রকম কোনও কাজের সমালোচনা যখন করবেন, তখনই সরকারি দলের লোকেরা, অথবা সরকারি দলের অনুগতরা, আপনার গায়ে বিএনপি বা জামায়াতের দালাল হিসাবে একটা তকমা লাগিয়ে দেবে। আবার এই আপনিই যদি সরকারের কোনও কাজের মধ্যে ভালো পান, প্রশংসা করেন, বিএনপির লোকদের কাছে আপনি হয়ে যাবেন আওয়ামী সরকারের দালাল। এভাবে এই দলকানা লোকগুলো পুরো দেশকেই ভাগ করে বসে আছে। বিভক্ত একটা দেশ সামনের দিকে অগ্রসর হবে কীভাবে? উন্নতি করবে কীভাবে?

সরকারের যে দুটি কাজের প্রসঙ্গ দিয়ে শুরু করেছিলাম, সেটা দিয়েই না হয় শেষ করি। বিষয়টা আরও একজনের সঙ্গে শেয়ার করেছিলাম। ইনি আবার কিছুটা বাম ঘরানার। বললেন, ‌‘সবকিছুকেই এতটা সহজভাবে দেখবেন না। এই যে দুটি কাজ, এর পেছনেও উদ্দেশ্য আছে।’

‘উদ্দেশ্য থাকতেই পারে। উদ্দেশ্য থাকা মানেই তো আর মন্দ কিছু নয়। তা আপনার কী মনে হয়- সেটা ভালো উদ্দেশ্য নাকি খারাপ উদ্দেশ্য?’

‘অবশ্যই খারাপ,’ বললেন তিনি। এরপর দিলেন বিস্তারিত এক ব্যাখ্যা। ‘আচ্ছা বলুন তো, এই মুহূর্তে সরকারের সামনে সবচেয়ে বড় প্রবলেমটি কী? সেটা হচ্ছে বহির্বিশ্ব ও সাধারণ মানুষের কাছে আস্থার সংকট। এক বছর পরই নির্বাচন। সরকারের ইচ্ছা ২০১৮ কিংবা ২০১৪ স্টাইলে আবার ক্ষমতায় যাওয়া। কিন্তু আমেরিকাসহ ইউরোপিয়ান দেশগুলো মনে হয় ব্যাপারটিকে এবার কিছুটা অন্য চোখে দেখছে। তারা বারবার বলছে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কথা। এদিকে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকারের দাবিতে এখনও অনড়। সরকারও জানে, বিরোধী দলের এই দাবি মেনে নেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়, এই দাবি মানা আর আত্মহত্যা সমার্থক। অগত্যা নানাভাবে তারা এখন জনগণের তুষ্টির দিকে নজর দিচ্ছে। সাধারণ মানুষকে তারা বোঝাতে চাচ্ছে, আসলে তারা জনগণের ভালো চায়, জনগণের সুবিধার জন্য কাজ করতে চায়। জনগণ যে বিএনপির প্রতি খুব অনুরক্ত, তাও কিন্তু নয়। বড় এই দুই দলকে তারা মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠই মনে করে। এখন আওয়ামী লীগ যদি জনকল্যাণমুখী কিছু কাজকর্ম করে, তাহলে সাধারণ মানুষ তাদের দিকে থাকতেও পারে। এই আশা থেকেই সরকার করছে এই কাজগুলো!’

তার এই বিশাল ব্যাখ্যার আমি কিছু বুঝলাম, কিছু বুঝলাম না, আর কিছুটা মাথার ওপর দিয়ে গেলো। তবে এতটুকু বুঝলাম- সরকার বা বিরোধী, ডান বা বাম, সবার মানসিকতা আসলে ওই একটাই। যা কিছু ভালো- সেটা কেবল আমিই করি। তুমি যা কিছু করো, তার সবটাই মন্দ। আর আপাতদৃষ্টিতে যদি মন্দ না-ও মনে হয়, তাহলে বুঝতে হবে সেটা মতলবি কোনও কাজ! এই ‘আপাত ভালো’র পেছনে সুগভীর কোনও মতলব আছে!
 
লেখক: হেড অব নিউজ, বাংলা ট্রিবিউন
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ইউক্রেনের শান্তি পরিকল্পনা অর্থহীন: ল্যাভরভ
ইউক্রেনের শান্তি পরিকল্পনা অর্থহীন: ল্যাভরভ
বিএনপির নিগৃহীত নেতাকর্মীদের তালিকা চাইলেন ওবায়দুল কাদের
বিএনপির নিগৃহীত নেতাকর্মীদের তালিকা চাইলেন ওবায়দুল কাদের
৭ বছর পর নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি
৭ বছর পর নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ