X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

মানুষ পুড়ে অঙ্গার হওয়া ঠেকাতেও কি বিদেশি হস্তক্ষেপ লাগবে?

ডা. জাহেদ উর রহমান
১২ জুন ২০২২, ২০:১১আপডেট : ১২ জুন ২০২২, ২০:১১
গত ৩ জুন একযুগ পূর্তি হলো দেশের ইতিহাসের ভয়ংকরতম দুর্ঘটনাগুলোর একটা, পুরনো ঢাকার নিমতলী অগ্নিকাণ্ডের। ২০১০ সালের এই দিনে ঘটা অগ্নিকাণ্ডটিতে পুড়ে মারা যান ১২৪ জন।

এই বীভৎস মর্মান্তিক অগ্নিকাণ্ডের পর কোনও মামলা হয়নি। হয়েছিল নামকাওয়াস্তে একটা জিডি এবং সেই জিডির তদন্ত শেষ হয়নি একযুগেও। আমাদের অনেককে হয়তো অবাক করবে এই তথ্য, কিন্তু অনেক দিন হলো আমি অবাক হই না এসব কিছুতে।

আমরা নিশ্চয়ই জানি নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়েছিল কেমিক্যাল গুদাম থেকে। বিশেষজ্ঞ হতে হয় না, সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান বলে এত ঘনবসতিপূর্ণ আবাসিক এলাকা থেকে এই দোকান এবং গুদামগুলো সরাতে হবে। সুপারিশও এসেছিল সেরকমই। কিন্তু বলা বাহুল্য, হয়নি কিছুই।

পুরান ঢাকায় রাসায়নিক গুদাম কত, তার সমন্বিত ও সুনির্দিষ্ট কোনও হিসাব বা তথ্য নেই। তবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনায় করা সরকারি এক জরিপ বলছে, সেখানে রাসায়নিক ব্যবসার ১ হাজার ৯২৪টি পাইকারি ও খুচরা প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর গত সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত এক গবেষণা বলছে, পুরান ঢাকায় দাহ্য রাসায়নিক পদার্থের প্রায় ১৫ হাজার গুদাম আছে।

কেমিক্যাল গুদাম না সরানোর ফল আবার ফললো নয় বছর পরে। পুরনো ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডে ৭৭ জন মারা যান। চুড়িহাট্টায় আগুনের পর আরেক দফা কেমিক্যাল গুদামগুলো সরিয়ে নেওয়া নিয়ে কিছু কথাবার্তা হলেও এখনও সেখানেই আছে সেগুলো। হঠাৎ যেকোনও একদিন হয়তো আমরা দেখবো সেখানে ঘটছে আরেকটি ভয়ংকর মর্মান্তিক অগ্নিকাণ্ড।

প্রশ্ন হচ্ছে, ওই এলাকার লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন অনিরাপদ রেখে সরকারের এমন নির্বিকার থাকার কারণ কী?

বছরখানেক আগেই ৫৩ জন মানুষ পুড়ে আক্ষরিক অর্থেই অঙ্গার হয়েছিল সেজান জুস ফ্যাক্টরিতে ঘটা অগ্নিকাণ্ডে। দেখা গেছে সেই ভবনটি অগ্নিকাণ্ড এবং অন্যান্য জরুরি অবস্থার ঝুঁকি মোকাবিলার মতো ন্যূনতম পদক্ষেপও নেয়নি। দুর্ঘটনার পর ফায়ার ব্রিগেডের পক্ষ থেকে অন-রেকর্ড বলা হয়েছে, সেই ভবনে এমনকি একটি অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রও ছিল না। এমনকি সেই কোম্পানিতে ছিল অনেক শিশু শ্রমিকও। সব কারখানা সব আইন ঠিকঠাক মতো মেনে চলছে কিনা সেটা তদারক করার জন্য পরিদর্শক আছেন।

বছর দশেক আগে এদের সংখ্যা খুব কম থাকলেও রানা প্লাজার ঘটনার পর এই সংখ্যা এখন পর্যাপ্ত। কিন্তু এরপরও কেন এমন বীভৎসতা ঠেকানো যাচ্ছে না?

বাংলাদেশ গার্মেন্ট সেক্টর অন্তত কর্মীদের জন্য স্বাস্থ্যকর এবং নিরাপদ কর্মস্থল নিশ্চিত করছে। তবে এটা গার্মেন্ট মালিকরা স্বেচ্ছায় কিংবা সরকারি চাপে করেননি। করেছিলেন বিদেশিদের চাপে।

তাজরীন গার্মেন্টসে ২০১২ অগ্নিকাণ্ডে আগুনে পুড়ে কয়লা হয়ে গিয়েছিল কমপক্ষে ১১৭ জন মানুষ। গার্মেন্টে এমন ভয়াবহ না হলেও নানা আকারের, নানা তীব্রতার দুর্ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু বাংলাদেশের সরকার কখনও এসব কারখানার কর্মীদের জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিতে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। এমনকি তাজরীনের বীভৎসতার পরও না।

তাজরীন গার্মেন্টের মাত্র ৫ মাস পর ঘটলো বাংলাদেশের সবচেয়ে ভয়ংকর এবং পৃথিবীর ইতিহাসেরই তৃতীয় ভয়ংকরতম শিল্প দুর্ঘটনা– রানা প্লাজা ধস। প্রায় ১২০০ মানুষের মৃত্যু আর প্রায় এক হাজার মানুষ নিখোঁজ হবার (যারা বেঁচে নেই নিশ্চয়ই) পরও সরকারের দিক থেকে একটি ‘উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি’ গঠন করার চাইতে বেশি কিছু হতো, এটা মনে করার কারণ নেই। কিন্তু এই ঘটনাটি পশ্চিমা ক্রেতাদের প্রচণ্ড চাপ তৈরি করলো গার্মেন্ট মালিকদের ওপর।

পশ্চিমা দুটি সংস্থা একর্ড এবং অ্যালায়েন্স-এর তত্ত্বাবধানে শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ নানা কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করতে বাধ্য হন গার্মেন্ট মালিকরা। ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্য এছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না তাদের সামনে। শ্রমিকদের জন্য নিরাপদ, স্বাস্থ্যকর কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করায় যে বিনিয়োগ করতে হয়, সেটা করলে বাংলাদেশের গার্মেন্ট ব্যবসা লাভজনক থাকবে না, এমন একটি কথা মালিকদের পক্ষ থেকে আকারে-ইঙ্গিতে বলা হতো। কিন্তু সেটাকে মিথ্যা প্রমাণিত করে গার্মেন্ট ব্যবসা আরও ফুলে-ফেঁপে উঠছে।

একইভাবে আমরা দেখবো দশকের পর দশক ঢাকার হাজারীবাগে চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের ট্যানারিগুলো ভয়ংকরভাবে নদীদূষণসহ নানা পরিবেশ দূষণ চালিয়ে গেলেও সেই ব্যাপারে সরকারের ন্যূনতম পদক্ষেপ ছিল না। এই খাতে যখন রফতানি কমে যেতে শুরু করে এবং ক্রেতাদের পক্ষ থেকে চাপ তৈরি হয় পরিবেশ সুরক্ষার পদক্ষেপ নিতে, তখনই কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগারসহ আলাদা চামড়া শিল্প নগরী তৈরি হয়। এই বর্জ্য পরিশোধনাগার তৈরিতে দায়িত্বপ্রাপ্ত চীনা কোম্পানিটির নানা অনিয়ম এবং টালবাহানা এবং তাতে সরকারের নির্লিপ্ততায় সেটা সঠিক আকারে এবং মানে তৈরি হয়নি। তবু এসব পদক্ষেপ নেওয়া শুরু হয়েছে পশ্চিমা ক্রেতাদের চাপে, সরকারের নিজ উদ্যোগে নয়।

অর্থাৎ আমরা দেখছি, যেসব শিল্প অভ্যন্তরীণ বাজারকে টার্গেট করে তৈরি হয়েছে সেগুলোকে নিয়ম-নীতির মধ্যে আনার প্রশ্নে, কিংবা সেগুলোকে কর্মীদের জন্য স্বাস্থ্যকর এবং নিরাপদ করে তোলার ক্ষেত্রে সরকারের তোড়জোড় দূরেই থাকুক, তেমন কোনও পদক্ষেপই নেই।

সীতাকুণ্ডের কন্টেইনার টার্মিনালের বীভৎস অগ্নিকাণ্ড এবং বিস্ফোরণের পর এক পক্ষ আরেক পক্ষের ওপর ক্রমাগত দায় চাপাচ্ছে। কেউ কোনও কন্টেইনার টার্মিনালে রাসায়নিক দ্রব্য রাখার অনুমোদন নিয়েছে কিনা সেটা দেখা, কিংবা অনুমোদন না নিয়ে রেখে থাকলে সেটা খুঁজে বের করার দায়িত্ব সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের। সরকারের এক প্রতিষ্ঠান অপর প্রতিষ্ঠানের ওপরে দায় চাপাতে পারে; কিন্তু সরকারের কেন্দ্রে যারা আছেন, যারা সব প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন, তারা দায় কার ওপর চাপাবেন? বিএনপির ওপর?

আমরা দেখি বর্তমান সরকার আপামর জনসাধারণের স্বার্থের পক্ষে না দাঁড়িয়ে দাঁড়ায় ক্ষমতাধরদের পক্ষে। একজন ক্ষমতাধর মানুষ যেকোনও আইন এবং নিয়ম-নীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে করতে পারেন যা খুশি তা। সীতাকুণ্ডের ঘটনার ক্ষেত্রে মালিক পক্ষে জেলা আওয়ামী লীগের বড় নেতা আর তার ভাইয়ের মালিকানার কথা আমরা জেনেছি। তেমনি জানতাম রানা প্লাজার মালিকের ক্ষমতাসীন দলের নেতা হওয়ার কথা। আবার এখন জানছি তাজরীন গার্মেন্টসের বীভৎস ঘটনার বিচার শেষ হওয়া দূরে থাকুক, এর মালিক দেলোয়ারকে রীতিমতো ঢাকা দক্ষিণ জেলা মৎস্যজীবী লীগের সভাপতি করা হয়েছে।

যে ধরনের শাসন পদ্ধতি বর্তমান বাংলাদেশে চালু আছে, বলা বাহুল্য তাতে এটাই হওয়ার কথা। সরকারের ইচ্ছা না থাকলেও অনেক সময় দেশের নাগরিকদের চাপে অনেক সময় সরকারকে কিছু কাজ করতে হয়, কিছু পদক্ষেপ নিতে হয়। বর্তমান সরকারের কাছে জনগণের প্রয়োজন ফুরিয়েছে বেশ আগেই।

শিল্পে অগ্নিকাণ্ড, ভবন ধস, অন্য দুর্ঘটনা কিংবা শিশু শ্রম, পরিবেশ দূষণসহ অন্য সব অনিয়মের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে হাতে গোনা যে কয়েকটি ব্যবস্থার উদাহরণ আছে সেগুলো সব হয়েছে বিদেশিদের চাপে। তাহলে প্রশ্ন, যে সেক্টরগুলোতে এখনও এসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, সেগুলোর জন্য কি আমাদের অপেক্ষা করতে হবে বিদেশিদের চাপের জন্য? সেটা হওয়ার আগ পর্যন্ত মাঝে মাঝেই কি তবে ভয়ংকর সব দুর্ঘটনায় হতাহত হওয়া কিংবা পুড়ে অঙ্গার হওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে আমাদের?
 
লেখক: শিক্ষক ও অ্যাকটিভিস্ট
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখলে আমাদের লজ্জা হয়: শাহবাজ
বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখলে আমাদের লজ্জা হয়: শাহবাজ
৬ ম্যাচ পর জয় দেখলো বেঙ্গালুরু 
৬ ম্যাচ পর জয় দেখলো বেঙ্গালুরু 
সাদি মহম্মদ স্মরণে ‘রবিরাগ’র বিশেষ আয়োজন
সাদি মহম্মদ স্মরণে ‘রবিরাগ’র বিশেষ আয়োজন
‘নীরব এলাকা’, তবু হর্নের শব্দে টেকা দায়
‘নীরব এলাকা’, তবু হর্নের শব্দে টেকা দায়
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ