X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

তথ্য প্রযুক্তি খাতে অসন্তোষের বাজেট

ড. বি এম মইনুল হোসেন
১৩ জুন ২০২২, ১৭:৫২আপডেট : ১৩ জুন ২০২২, ১৮:০৮

একটি দেশের সেবা প্রদান (সার্ভিস ডেলিভারি) করার সক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে বিশ্বের ৬০টি দেশের জন্য নিয়ে ‘কার্নি গ্লোবাল সার্ভিস লোকেশান’ সূচক ২০২১ (The 2021 Kearney Global Services Location Index) প্রকাশ করা  হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার যে চারটি দেশ সে তালিকায় এসেছে, তার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সবার নিচে (৩৩তম)। তালিকার প্রথম দেশটি ভারত, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সপ্তম।

সাশ্রয়ী মূল্য (ফিন্যান্সিয়াল অ্যাট্রাক্টিভনেস), দক্ষতা (শিক্ষাগত, ভাষাগত, আইটিও, বিপিও) ও সেটির সহজলভ্যতা, ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ এবং ডিজিটাল রেজোনেন্সের ওপর ভিত্তি করে ইনডেক্সটি তৈরি করা হয়েছে। ডিজিটাল রেজোনেন্স রাষ্ট্রের ডিজিটাল দক্ষতা, আইনি সুরক্ষা ও সাইবার সিকিউরিটি, করপোরেট কার্যক্রম, ডিজিটাল আউটপুট, এসব বিষয়ের মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয়েছে।

তালিকার প্রথমে থাকা ভারতসহ কয়েকটি দেশের ব্যাপারে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলা হয়েছে, যদিও তারা এখন সাশ্রয়ী মূল্য প্রদান করার মাধ্যমে প্রথম দিকে অবস্থান করছে, কিন্তু ভবিষ্যতে এই অবস্থান বেশি দিন ধরে রাখা সম্ভব হবে না। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে ডিজিটাল রোজোনেন্স বিভাগে তাদের নিম্নমানে অবস্থানের কথা। আর, ঠিক এখানটাতেই বাংলাদেশের অবস্থান ৫৭তম, অর্থাৎ নিচের দিক থেকে তৃতীয়।

আমরা যতই বলতে থাকি না কেন, অমুক সালের মধ্যে আমরা তমুক বিলিয়ন ডলার রফতানি করে ফেলবো, বিভিন্ন সূচক আর র‍্যাঙ্কিংয়ে আমাদের যে অবস্থান, সেটি আমাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী প্রস্তুতির ঘাটতিকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। কিয়ারনি রিপোর্টের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টটি আরও একবার স্মরণ করিয়ে দিই। শুধু সাশ্রয়ী অর্থাৎ কম দামে সেবা প্রদান করার মাধ্যমে বিশ্ববাজারে টিকে থাকা যাবে না, আকর্ষণ করা যাবে না বিনিয়োগকারীদের। মনোযোগ দিতে হবে ডিজিটাল রেজোনেন্সের দিকে।

আমরা যদি ভেবে থাকি যে আমাদের আইসিটি সেক্টরকে অনেক দিন যাবৎ লালন-পালন করা হয়েছে, এই খাতটি এখন প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে গেছে, এসব সূচক আর প্রতিবেদন তথ্য-উপাত্ত দিয়ে আমাদের সে ভাবনাকে বাতিল করে দেয়; বরং বুঝিয়ে দেয় যে আমাদের আইসিটি সেক্টর এখনও শিশুকালই পার করছে। অতএব, আমরা যদি ডিজিটাল রেজোনেন্সে উন্নতি করতে চাই, এই সেক্টরটিকে আমাদের সময় দিতে হবে, আরেকটু বেশি সময় ধরে লালন-পালন করতে হবে। যার প্রতিফলন থাকতে হবে, আগামীর জন্য করা নীতি, পরিকল্পনা এবং বাজেটের মাঝেও।

সম্প্রতি ঘোষণা করা বাজেট উপলক্ষ করে, তথ্যপ্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে সরকারের কাছে বেশ কিছু প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। প্রস্তাবগুলোর মধ্যে ছিল কর অব্যাহতি, সহজ শর্তে ঋণ প্রদান, তহবিল গঠন, ইন্টারনেট সেবাকে বিশেষ শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্তকরণ, ই-কমার্স ডেলিভারি সার্ভিসকে করমুক্ত রাখা ইত্যাদি। বলতে গেলে প্রস্তাবগুলো থেকে কিছুই গ্রহণ করা হয়নি। হয় সংগঠনগুলোর প্রস্তাবের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরায় ঘাটতি ছিল, অথবা সেগুলো কোনও কারণে আমলে নেওয়া হয়নি।

উপরন্তু, প্রস্তাবিত বাজেটে আমদানি করা ল্যাপটপ কম্পিউটার, প্রিন্টার ও প্রিন্টারের টোনারের ওপর ১৫ শতাংশ মূসক, মোবাইল ফোনের ওপর মূসক এবং ইন্টারনেটের ওপর ১০ শতাংশ উৎসে কর আরোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ খাত সংশ্লিষ্টদের হিসাব অনুযায়ী, নতুন মূসক আরোপের কারণে ল্যাপটপ কম্পিউটার আমদানির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য মোট করভার দাঁড়াবে ৩১ শতাংশ। এতদিন যেটি ছিল ১৬ শতাংশ।

এই সিদ্ধান্তগুলো, রাষ্ট্রের আইসিটি খাতের জন্য নেওয়া এতদিনের পদক্ষেপ ও লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও যে ডিজিটাল কর্মকাণ্ড এবং তার ব্যাপ্তি বৃদ্ধি পেয়েছে, সেখান থেকে লাভবান হওয়ার সুযোগটুকু যেন পরিকল্পনা করেই কমিয়ে ফেলার আয়োজন করছি আমরা। ইনফরমেশন টেকনোলজি আউটসোর্সিং (আইটিও), বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং (বিপিও), সফটওয়্যার ও সার্ভিস ডেভেলপমেন্ট, ফ্রিল্যান্সিংসহ বৈদেশিক মুদ্রা আনয়নকারী এসব খাত সরাসরি সুলভ মূল্যে পাওয়া মানসম্পন্ন কম্পিউটার, ল্যাপটপ এবং ইন্টারনেটের সংযোগের সঙ্গে সম্পর্কিত।

একটি মোটামুটি ভালো মানের ল্যাপটপের যে দাম ইতোমধ্যে আছে, বলতে গেলে সেটিই মধ্যবিত্তের ক্রয়সীমার বাইরে। তার ওপর এখন যদি আরও দাম বাড়ানো হয়, তাহলে তো সেটির নাগাল পাওয়াই কঠিন হয়ে যাবে। অন্যদিকে, মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস, মোবাইল ব্যাংকিং, রাইড শেয়ারিংসহ বিভিন্ন সার্ভিস অ্যাপ দেশব্যাপী জনপ্রিয় হতে শুরু করেছে। মোবাইল সেটের দাম বৃদ্ধি পেলে এসব সার্ভিসেও সেটির কিছু না কিছু প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়। আবার কিছু দিন আগেই আমরা ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের জন্য এক দেশ এক রেট ঘোষণা করা হলো। ইন্টারনেটের ওপর যদি এই করারোপ করা হয়, সেই ‘এক দেশ এক রেট’ চালিয়ে নেওয়াও কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে।

ওদিকে, দেশের ই-কমার্স খাত বিভিন্ন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গিয়ে বেশ বড় ধরনের একটি ধাক্কা খেয়েছে। তারপরও, ডেলিভারি ব্যবস্থা, রাইড শেয়ারিং ব্যবস্থাসহ নানা রকমের সেবার বহুল প্রচলনের মাধ্যমে তৈরি করে যাচ্ছে কর্মসংস্থান। চ্যালেঞ্জের মাঝে পতিত হওয়া এই ই-কমার্স খাতের জন্য উৎসাহমূলক পদক্ষেপের অংশ হিসেবে হলেও ডেলিভারির ওপর বর্তমানে আরোপ থাকা মূসক নিয়ে বিবেচনা করা যেতো।

দেশে এখন ল্যাপটপ এবং মোবাইল হ্যান্ডসেট তৈরি হচ্ছে। দেশীয় শিল্পের বিকাশে সহায়তা প্রদান, সেটিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অবশ্যই প্রয়োজন আছে। তবে, বাস্তব দিক বিবেচনায়, আমদানিতে নতুন করে কর আরোপ না করে, দেশীয় পণ্যের ক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধা দিয়েও সেই লক্ষ্য কিছুটা অর্জন করা যেতে পারে। দেশীয় শিল্প বিকাশে আমরা সর্বোচ্চটাই দেবো। কিন্তু এটিও বিবেচনায় রাখতে হবে যে কাজের ধরনের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ধরনের ডিজিটাল ডিভাইস বা সার্ভিস ব্যবহার করতে হয়। সেক্ষেত্রে, বিশেষ কোনও ধরনের দেশীয় পণ্য যদি মানসম্মত না হয়, জোর করে সেটি কিনতে বাধ্য করানোতে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাও থেকে যায়।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে অন্তর্নিহিত বার্তা। স্টার্টআপ নিয়ে যতটুকু ঘোষণা এসেছে, সেটি এই বার্তা দেওয়ার জন্য যথেষ্ট যে স্টার্টআপগুলোর উন্নয়নের জন্য সরকারের আগ্রহ আছে। বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে যেটি সময়োপযোগী এবং প্রশংসার দাবিদার। সেই সঙ্গে এই বার্তা আসাও জরুরি যে ল্যাপটপ, মোবাইল, ইন্টারনেট এগুলো এখন আর বিলাসিতার সামগ্রী নয়, বরং নিত্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি সামগ্রী। এগুলোর সহজলভ্যতা, সুলভ মূল্য এবং গুণগত মানের সঙ্গে ডিজিটাল বাংলাদেশ, স্মার্ট বাংলাদেশ ভিশনের তাৎপর্যপূর্ণ সম্পর্ক আছে। আমরা যদি ভবিষ্যতের স্মার্ট বাংলাদেশ গঠন করতে চাই, আমাদের পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্তগুলোরও স্মার্ট হওয়ার কোনও বিকল্প নেই।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, তথ্য প্রযুক্তি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

ইমেইল: [email protected]

 
 
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপের ফাইনাল আজ
বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপের ফাইনাল আজ
টিভিতে আজকের খেলা (২০ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২০ এপ্রিল, ২০২৪)
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ