X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

আত্মতুষ্টির খেসারত বন্যা: ‘মানুষের যাতে কষ্ট না হয়…’

গওহার নঈম ওয়ারা
২১ জুন ২০২২, ১৬:৪৮আপডেট : ২১ জুন ২০২২, ১৬:৪৮
এমন বন্যার কথা মনে করতে পারছেন না সিলেট অঞ্চলের কেউ। চলতি বন্যায় সরকারি হিসাব মতে  সিলেট জেলার ৩০ লাখ আর সুনামগঞ্জ জেলার ২০ লাখ মানুষ কঠিন সময় পার করছেন।

এখন পর্যন্ত দেশের ১২ জেলার ৭০টি উপজেলা বন্যায় প্লাবিত। নতুন করে ছয়টি উপজেলা প্লাবিত হয়েছে। তবে ত্রাণমন্ত্রী জানিয়েছেন, মঙ্গলবার (২১ জুন ২০২২) থেকে বন্যার পানি সার্বিকভাবে কমতে শুরু করবে। সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপ করতে করতে রবিবার (১৯ জুন) সচিবালয়ে বন্যার বিদায় ঘণ্টার আগাম খবর ফাঁস করে দেন মন্ত্রী।

গত বৃহস্পতিবার থেকে বন্যার হালহকিকত ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছিল। তবে পরিস্থিতি যে এতটা খারাপ হবে সেটা বোধহয় কারও ‘আক্কেলে’ ধরা পড়েনি। কর্তারা মনে করেছিলেন কী আর হবে। বন্যা ব্যবস্থাপনায় আমাদের হাত-পা সবই পাকা। আমরা পৃথিবীর আদর্শ  ‘রোল মডেল’; আলমারিতে-শোকেসে থরে থরে সাজানো আমাদের  স্বীকৃতির নানা ট্রফি, নানা সনদ। আমাদের আত্মতুষ্টির ঢেঁকুরের শব্দে পালানোর পথ পাবে না বন্যা।

পানিবন্দি পরিস্থিতির শিকার আমার এক সাবেক ছাত্রী (দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ছাত্রী, হালে আমলা) খুব কষ্ট থেকে লিখেছেন– ‘যদিও এমন পরিস্থিতির ইঙ্গিত ১০ দিন আগে থেকেই দিচ্ছিলো বিশ্বের বড় বড় আবহাওয়া সংস্থাগুলো। আমাদের আছে শুধু রোল মডেলের ফাঁকা বুলি! আছে এসি রুমে কফির মগ হাতে বসে প্যানেল ডিসকাশন কিংবা টকশোতে গলা ফাটানোর ভাঁওতাবাজি। আমাকে ‘রোল মডেল’এর মেডেলগুলো এনে দেন। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য পাওয়া বড় বড় পদকগুলো এনে দেন। বসে বসে পানিতে ভিজিয়ে খাই।’

সকল প্রযুক্তি আর স্বাচ্ছন্দ্য  হাতের মুঠোয় থাকার পরে পানিবন্দি সেই সাবেক ছাত্রী ৪৮ ঘণ্টারও বেশি সময় তার প্রিয়জনদের সাথে কোনও যোগাযোগ করতে পারেনি; সেই হতাশা থেকেই তিনি আরও লিখেছিলেন– ‘ … স্বামীর সাথে আমার যোগাযোগ নেই। প্রতিটা মুহূর্ত যে কী কঠিন তা শুধু ভুক্তভোগী পরিবারই ভালো জানে! প্রশাসন থেকে যেসব নাম্বার দেওয়া হয়েছে তার একটা নাম্বারেও কল ঢুকে না। মাত্র দুইটা জেলার দুর্যোগ পরিস্থিতি সামাল দিতেই আমাদের এই অবস্থা! পরিস্থিতি মোকাবিলায় কোনও সমন্বয় নাই, আগাম কোনও প্রস্তুতি নাই।’

কষ্টের মাথায় লেখা তার এসব কথার সবটা হয়তো সত্যি নয় কিন্তু তার কষ্টটা মিথ্যা নয়, চাপা থাকেনি তার হতাশাটাও। বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচ বছর ধরে যে কথা আমরা তাকে ‘পাখি পড়ানো’র মতো করে বুঝিয়েছি সেসব পাঠ তার কাছে নিতান্তই ‘ভুয়া’, ‘অতিরঞ্জিত বাক্যের ভাঁওতা বলে মনে হয়েছে। বাস্তব পরিস্থিতির সাথে কোনও মিল খুঁজে পাচ্ছেন না দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সাবেক এই ছাত্রী।

এদিকে বন্যার কারণ আর ভয়াবহতা নিয়ে ধারণাভিত্তিক নানা কথা নানাজনে যার যার অবস্থান থেকে বলে যাচ্ছেন। যেমন বলা হয়েছিল করোনার আগমনী দিনগুলোতে। তার ফলাফল আমরা হাড়ে হাড়ে টের পেলেও কেউ হারতে রাজি নন।

যে কারণেই বন্যা হোক, এর ভয়াবহতা আর ব্যাপকতা যে সকলের মরচে পড়া ধারণার ধারে-কাছেও ছিল না তা বুঝতে রকেট চালানো বিদ্যা জানার দরকার নেই।

তিন দিনে উজানে ২২ হাজার  মিলিমিটার বৃষ্টি হওয়ার মরতবা যাদের বুঝতে অসুবিধা তাদের চেয়ারে বসিয়ে রাখলে দেশটাই বসে যাবে। বসেও যাচ্ছে। সুনামগঞ্জে ২৪ ঘণ্টা একটানা বৃষ্টি হলে বা কত মিলিমিটার বৃষ্টি হলে কোন কোন আটি তলিয়ে যাবে বা শহর রক্ষাবাঁধ না থাকার কারণে সুরমার পানি কূল ছাপালে সিলেট বা সুনামগঞ্জের কোন কোন মহল্লায় হাবুডুবু পানি হবে সেটা জানিয়ে দেওয়া পূর্বাভাসের অংশ হওয়া উচিত।

আমরা শিখতে আর কাজ করতে ভুলে গেছি

আত্মতুষ্টির গাছের মগডালে উঠে যাওয়ায় আমরা আর কিছু শিখতে বা ভুল মানতে রাজি না। মে মাসে যখন ‘ছোটখাটো’ বন্যায় একে একে সিলেটের পাওয়ার সাবস্টেশনগুলোতে পানি উঠলো তখন হায় হায় করে উঠলেও পানি নেমে যাওয়ার পর বেমালুম ভুলে গেলাম ভুলের কথা। সামনে বড় বর্ষাকাল, আরও বড় বন্যা হলে এই সাবস্টেশনগুলো রক্ষার কী কবচ হতে পারে, সেটা নিয়ে ভাবলাম না। কমপক্ষে জরুরি ভিত্তিতে মাটি আর বালুর বস্তা দিয়ে অস্থায়ী বাঁধ দিতে তো কোনও বাধা ছিল না। সেটা করলে কুমারগাঁও নিয়ে আমাদের হোঁচট খেতে হতো না।

সিলেটের বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রাণ কুমারগাঁও বিদ্যুৎ স্টেশনের সর্বনাশ ঠেকাতে শেষ পর্যন্ত প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণকাজে হাত দিতে হয় বন্যার মধ্যে। সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর চেষ্টায় প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণে সিলেট জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে সেনাবাহিনীর সহায়তা নিতে হয়। তারপরও কুমারগাঁওয়ের আংশিক অচল হওয়া ঠেকানো যায়নি। সফলতার সঙ্গে আবার চালু করা গেছে। আবার প্রমাণ হলো আমাদের সক্ষমতা আছে, নিয়ত আর চাপ থাকলে আমরা পারি, কিন্তু করি না। বন্ধ হলো বিমানবন্দর। তালা পড়লো মেডিক্যালে। তাহলে আমাদের কনটেনজেন্সি প্ল্যানে আপৎকালীন পরিকল্পনা কি ছিল না। নাকি আলমারির কোন তাকে ওঠানো ছিল, সেটা আমাদের জানা ছিল না। কে কেন দায়িত্ব পালন করেনি সেটা আগামীর প্রস্তুতির জন্য জানা প্রয়োজন।

এখন কী করা প্রয়োজন

পলাশীর যুদ্ধে ‘পরাজিত’ হওয়ার পর সেনাপতিদের সক্রিয়তা আর নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণের ইচ্ছা নবাবের ছিল, কিন্তু সেই সুযোগ তাকে দেওয়া হয়নি। তাই পলাশীর আমবাগানে আমাদের যে বারুদ ভিজে গেলো তা আর শুকালো না। তাই চারদিকে শুধুই ভেজা বারুদের স্তূপ। এদের জাগাতে হবে। দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে হবে। পানি কমার সাথে সাথে মৌসুমি ত্রাণের গেরিলা তৎপরতা শুরু হবে। নানা পদস্থ-অপদস্থদের মিছিল ছুটবে ব্যানার আর নিজেদের ছবি তুলতে। বেগের সঙ্গে এই আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। উপজেলা আর ইউনিয়ন দুর্যোগ কমিটিগুলোকে সকল ত্রাণ সমন্বয়ের পূর্ণ দায়িত্ব নিতে হবে। এটা করা না গেলে সম্পদ আর সময়ের অপচয় হবে।

‘আফাল’ (তীরভাঙা ঝড়) থেকে সুনামগঞ্জের সিলেটের হাওরের গ্রাম (আটি)-গুলো রক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। সিলেট আর সুনামগঞ্জের শহর এলাকার ভূ-গর্ভের পানির ট্যাংকগুলো যত দ্রুত সম্ভব পরিষ্কার করতে হবে।

সবচেয়ে কম সময়ের মধ্যে স্কুল আর পাঠদানের কার্যক্রম শুরু করতে হবে।

গবাদিপ্রাণীর খাবারের ব্যবস্থা আর তাদের ভ্যাকসিনেশনের কাজকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

সুনামগঞ্জ আর সিলেটকে চলতি বর্ষা মৌসুমে নিরাপদ রাখতে আর দ্রুত আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হলে প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।  ত্রাণ আর পুনর্নির্মাণের জন্য সচিব পর্যায়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দিয়ে একটা সার্বিক পরিকল্পনা তৈরি আর বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।

সকল পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে মানুষ, অন্যথায়  অনারথের আমলটায় বারবার লেখা হবে।

লেখক: গবেষক; বাংলাদেশ দুর্যোগ ফোরামের কর্মী      
[email protected]
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
লাল কৃষ্ণচূড়া, বেগুনি জারুলে ছুঁয়ে যায় তপ্ত হৃদয়
লাল কৃষ্ণচূড়া, বেগুনি জারুলে ছুঁয়ে যায় তপ্ত হৃদয়
টিভিতে আজকের খেলা (২৭ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৭ এপ্রিল, ২০২৪)
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ