X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

পদ্মা ক্রেজ: অস্থিরতা ও সামাজিক অসঙ্গতির বাইপ্রোডাক্ট

আমীন আল রশীদ
০১ জুলাই ২০২২, ১৭:৩৫আপডেট : ০১ জুলাই ২০২২, ১৭:৩৫

পদ্মা সেতুই সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র স্থাপনা, যেটির নির্মাণকাজ শুরুর আগে থেকে জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া পর্যন্ত প্রতিটি দিনই সংবাদ শিরোনাম হয়েছে। এর পেছনে কিছু যৌক্তিক কারণও আছে।

আমাজনের পরে পৃথিবীর সবচেয়ে জটিল এই নদীর ওপরে বাংলাদেশের ইতিহাসে এ যাবত নির্মিত সবচেয়ে দীর্ঘ সেতুটি যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার প্রথম দিনেই যেসব ঘটনা ঘটেছে, তা শুধু  বিস্ময়করই নয়, বরং কিছু ঘটনায় বাঙালির অতি আবেগের পাশাপাশি অশিক্ষা-কুশিক্ষা-অস্থিরতা ও বাড়াবাড়িরও চূড়ান্ত প্রদর্শনী হয়ে গেলো। কেন এরকম ঘটনা ঘটলো এবং চূড়ান্ত বিচারে এগুলোর পরিণতি কী—তার নির্মোহ বিশ্লেষণ হওয়া প্রয়োজন।

পাঠক এরইমধ্যে গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পরের দিন ভোর থেকে রাত পর্যন্ত ঘটনা-দুর্ঘটনার নানা খবর জেনেছেন, দেখেছেন। বাংলাদেশ তো বটেই, পৃথিবীর আর কোনও স্থাপনার উদ্বোধন হওয়ার পরে একদিনে এত ঘটনা, গণমাধ্যমে এত বেশি শিরোনাম এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় এত বেশি প্রতিক্রিয়া এসেছে কিনা সন্দেহ।

২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ছিল দেশের ইতিহাসের স্মরণীয় একটি দিন। কারণ এদিন পদ্মা সেতুর প্রথম স্প্যানটি বসানো হয়। অর্থাৎ প্রমত্তা পদ্মার বুকে সেতুটি দৃশ্যমান হয়। এর পৌনে তিন বছর পরে ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর শেষ স্প্যানটি বসানোর মধ্য দিয়ে যেদিন সেতুটি পুরোপুরি দৃশ্যমান হয়, সেদিন অসংখ্য মানুষ পদ্মার তীরে জড়ো হন। অনেকের হাতেই ছিল জাতীয় পতাকা। নিজেদের টাকায় এত বড় একটি স্থাপনার বাস্তব রূপ দেখে অনেকে আবেগে কেঁদে ফেলেন।

দেশের আর দশটি স্থাপনা, এমনকি যমুনা নদীর ওপরে নির্মিত বঙ্গবন্ধু সেতু নিয়েও মানুষের এত উচ্ছ্বাস বা আবেগ ছিল না। কারণ পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে যখন বিশ্ব ব্যাংক সরে গেলো, তখন এটি অনেকেই বিশ্বাস করতে পারেননি যে, বাংলাদেশ এই সেতুটি নির্মাণ করতে পারবে। কারণ যখন বিশ্ব ব্যাংক সরে গেলো, তখন অর্থায়নকারী অন্যান্য বিদেশি প্রতিষ্ঠানও আর থাকেনি। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল, বিশ্ব ব্যাংক এই প্রকল্প থেকে সরে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কোনো প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশ নেয়নি। কারণ তারা হয়তো ভেবেছিল, বাংলাদেশ কাজ শুরু করলেও মাঝপথে গিয়ে আর টাকা দিতে পারবে না। অতএব সেতুটি অসম্পূর্ণ অবস্থায় পড়ে থাকবে। এরকম শঙ্কা থেকে সেতু নির্মাণে অভিজ্ঞ বড় কোনো কোম্পানি আসতে চায়নি।

এরকম একটি বিরুদ্ধ পরিস্থিতিতে নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো একটি বিরাট প্রকল্প এগিয়ে নেওয়ার জন্য যে দৃঢ় রাজনৈতিক নেতৃত্ব, সুদূরপ্রসারী চিন্তা, সাহস এবং সর্বেপারি যে স্পর্ধার প্রয়োজন ছিল, তা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দেখাতে পেরেছেন বলেই দুই দশক আগে যা ছিল মানুষের কল্পনাতীত—তাই এখন বাস্তব। সুতরাং, এই স্থাপনাটি নিয়ে মানুষের আগ্রহ, আবেগ ও উচ্ছ্বাস যে একটু বেশি থাকবে, সেটিই স্বাভাবিক। কিন্তু সেতুটি যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত হওয়ার প্রথম দিনেই যা কিছু ঘটেছে, তার মধ্যে অনেক কিছুই বাড়াবাড়ি এবং বাঙালির অতি আবেগ, অস্থিরতা এবং কিছু ঘটনায় আমাদের অশিক্ষা ও কুশিক্ষার যে প্রদর্শনী হয়ে গেলো, তা অত্যন্ত লজ্জার। 

প্রথম যা কিছু:

পদ্মা সেতুর প্রথম পিলার বা প্রথম স্প্যান বসানোর ঘটনাগুলো যেমন গণমাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ শিরোনাম হিসেবে প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়, তারই ধারাবাহিকতায় সেতুটি যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার পরে প্রথম কোন গাড়িটি সেতু পার হলো; কোন নারী বাইকার প্রথম সেতুতে উঠলেন; প্রথম কোন গাড়িটি সেতুতে বিকল হলো; প্রথম কোন মোটরসাইকেল আরোহী টোল দিলেন; প্রথম কে টিকটক করলেন ইত্যাদি খবরগুলো যখন গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় আসতে থাকলো, তখন সঙ্গত কারণেই এ নিয়ে কিছু রসিকতা, কিছু ট্রলও হয়।

অনেকে প্রশ্ন তোলেন, পদ্মা সেতুতে আর কী কী প্রথম হতে পারে এবং এখানে আর কী কী ঘটনা বাকি আছে? কেউ কেউ লিখেছেন, প্রথম এই সেতুতে দাঁড়িয়ে কে গান গাইলেন; প্রথম সেতুর ওপর থেকে নিচের দিকে কে থুতু ফেললেন; প্রথম এখানে দাঁড়িয়ে কে তার প্রিয়জনকে চুম্বন করলেন ইত্যাদি। পদ্মা সেতু নিয়া প্রথম কবিতা, প্রথম গল্প, প্রথম উপন্যাস, প্রথম নাটক, প্রথম সংকলন হতে পারে কিনা—সে প্রশ্নও তুলেছেন কেউ কেউ।

মানুষের এই রসিকতার ভেতরে গণমাধ্যমের প্রতি তাদের কিছু তীর্যক মন্তব্যও এড়িয়ে যায়নি। একটি সেতু যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত হওয়ার পরে প্রথম সেখানে কোন মোটরসাইকেল চালক টোল দিলেন; কোন নারী বাইকার প্রথম সেতুতে উঠলেন; কোন বাসটি প্রথম সেতু পার হলো—এইসব সংবাদ প্রকাশ ও প্রচারের কোনও প্রয়োজন ছিল কিনা বা এরকম খুব স্বাভাবিক ঘটনাকেও বড় করে প্রকাশের কোনও যুক্তি আছে কিনা—তা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তোলেন। প্রশ্ন তোলেন মূলত এই কারণে যে, মূলধারার গণমাধ্যমও যদি এরকম সিলি বা হালকা বিষয়গুলোও সংবাদ আকারে প্রকাশ ও প্রচার করে তাহলে ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গে তার কী তফাৎ থাকে? যদিও মূলধারার টেলিভিশনের এখন মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়িয়েছে ইউটিউব। যে কারণে বাণিজ্যিক ও স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেলগুলোকেও ইউটিউবের সঙ্গে লাইক ও শেয়ারের অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নামতে হয়েছে।

টিকটক ও নাটবল্টু:

যেহেতু পদ্মা সেতু নিয়ে শুরু থেকেই মানুষের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা-আগ্রহ ছিল, সে কারণে সেতুটি যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত হওয়ার পরেই হাজার হাজার মানুষ একসঙ্গে ছুটে যান সেতুতে উঠতে। সাম্প্রতিক সময়ে টিকটকের প্রবণতা যেহেতু বেড়েছে, ফলে অনেকেই সেতুতে উঠে নানা অঙ্গভঙ্গিতে টিকটক করেছেন।

তবে টিকটক করতে গিয়ে ফেঁসে গেছেন বায়েজিদ তালহা নামে এক যুবক—যিনি পদ্মা সেতুর রেলিংয়ের নাটবল্টু খুলে সেই ভিডিও ছড়িয়ে দিয়েছেন। তার দাবি, ৩০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সেতুর নাটবল্টুও ঠিকমতো লাগানো হয়নি। ভিডিওটি দ্রুত ভাইরাল হয় এবং নানারকম আলোচনা-সমালোচনা ও বিতর্ক শুরু হয়। সত্যিই হাত দিয়ে পদ্মা সেতুর নাটবল্টু খোলা যায় কিনা; ঠিকমতো কেন এগুলো লাগানো হয়নি; যারা এই কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত তারা কাজগুলো সঠিকভাবে করেছেন কিনা; নাকি ওই যুবক কোনও যন্ত্র দিয়ে নাটবল্টু খুলে ভাইরাল হতে চেয়েছেন; নাকি তিনি কোনও দল বা গোষ্ঠীর পার্পাস সার্ভ করতে এত বড় একটি প্রকল্পের দুর্বলতা চিহ্নিত করতে কাজটি করেছেন—এরকম নানা প্রশ্ন মানুষের মনে তৈরি হয়েছে।

এমতাবস্থায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে গ্রেফতার করে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানায় দায়েরকৃত বিশেষ ক্ষমতা আইনের মামলায় সাত দিনের রিমান্ডেও নেওয়া হয়। বায়েজিদ তালহাকে গ্রেফতারের পরে সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডির পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নাটবল্টুর ভিডিওটি ছড়িয়ে তিনি পদ্মা সেতু নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন এবং এই ভিডিও প্রচারের মাধ্যমে তিনি মানুষের অনুভূতি ও রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছেন। এটা অন্তর্ঘাতমূলক অপরাধ।’

ঘটনা এখানেই থেমে থাকেনি। বরং পদ্মা সেতুর রেলিংয়ের নাট খোলার ঘটনায় গ্রেফতার বায়েজিদ তালহার  গ্রামের বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটেছে। সোমবার বিকেলে পটুয়াখালী সদর উপজেলার লাউকাঠি ইউনিয়নের তেলিখালী গ্রামে তার বাড়িতে হামলা হয়। ব্যক্তিগতভাবে বায়েজিদের অপরাধ থাকলে সেজন্য আইন অনুযায়ী তার বিচার হবে। কিন্তু তার বাড়িতে হামলার ঘটনা নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য নয়।

প্রথম প্রাণহানি বেপরোয়া বাইকে:

পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পরদিন, অর্থাৎ সেতুটি যেদিন যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হলো, সেদিনই দুজন তরুণের বেঘোরে মৃত্যু হয়—যারা সেতুতে বেপরোয়াভাবে মোটরসাইকেল চালাচ্ছিলেন এবং একশো বা তারও বেশি গতিতে মোটরাসাইকেল চালানো অবস্থায় মোবাইল ফোনে ভিডিও করছিলেন।

তাদের একজনের নাম আলমগীর হোসেন, আরেকজন ফজলু মিয়া। দুজনেরই বয়স ২৫। ফজলু মিয়ার বাড়ি ঢাকার নবাবগঞ্জের হরিশকুল গ্রামে। বেশ কিছুদিন ইরাকে ছিলেন। চার মাস আগে দেশে ফিরেছেন। নিহত আলমগীরের বাড়িও নবাবগঞ্জেরর শামসাবাদ এলাকায়। তিনি নবাবগঞ্জে মোটর মেকানিকের কাজ করতেন।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, পদ্মা সেতু খুলে দেওয়ার পরে তারা তিনটি মোটরসাইকেলে ৬ বন্ধু মিলে সেতুতে ঘুরতে যান। তারা দুটি মোটরসাইকেল নিয়ে আগে চলে যান। আর তাদের পেছনের দিকের মোটরসাইকেলে ছিলেন আলমগীর ও ফজলু। কিন্তু বেপরোয়া ড্রাইভিং তাদের প্রাণ কেড়ে নেয়। সেতু দেখতে যাওয়ার আনন্দ বিষাদ নামিয়ে আনে এই দুই তরুণের পরিবারে। 

মোটরসাইকেলে বেপরোয়া ড্রাইভিং এরকম নির্মম মৃত্যুর ঘটনা এটিই প্রথম নয়। দেশের সড়ক মহাসড়কে প্রতি বছর যারা নিহত হন, তাদের একটি বিরাট অংশই মোটরসাইকেল চালক। চালকদের অস্থিরতা, অদক্ষতা এবং নিয়ম না মানার প্রবণতাই এর জন্য প্রধানত দায়ী। বস্তুত মোটরবাইক একটা আতঙ্কের নাম। রাজধানীসহ দেশের নানা জায়গায় যে কিশোর গ্যাংয়ের কথা শোনা যায়, তাদের প্রধান অস্ত্র এই মোটরসাইকেল। ‘বাইক সন্ত্রাস’ বলে একটি বিষয় এখন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যে কারণে সম্প্রতি মহাসড়কে মোটরসাইকেল নিষিদ্ধেরও সুপারিশ করেছে বিআরটিএ।

ত্রিমজ বাচ্চা:

জমজ সন্তান হওয়ার ঘটনা নতুন কিছু নয়। কিন্তু একসঙ্গে তিনজন সন্তানের জন্ম হওয়ার খবর সচরাচর শোনা যায় না। কিন্তু কাকতালীয়ভাবে এবার পরপর একাধিক নারী একসঙ্গে তিন সন্তানের জন্ম দিয়ে আলোচিত হয়েছেন। প্রথম আলোচনায় আসেন নারায়ণগঞ্জের এ্যানি বেগম। তার স্বামী ব্যবসায়ী আশরাফুল ইসলাম। এই ঘটনাটি আলোচনায় আসে মূলত তিন সন্তানের নামের কারণে। বাবা-মা পদ্মা সেতুর সঙ্গে মিলিয়ে তাদের নাম রাখেন স্বপ্ন, পদ্মা ও সেতু—যা গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। ঘটনাটি নতুন মাত্রা পায় এই তিন নবজাতকের জন্য প্রধানমন্ত্রীর উপহার ও শুভেচ্ছাবার্তা পাঠানোর মধ্য দিয়ে।

এই ঘটনার পরে বরিশাল শহরেও একসঙ্গে তিন মেয়ের জন্ম দেন নুরুন্নাহার বেগম নামের এক নারী। তার স্বামী বাবু সিকদার ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালক। তারাও তিন সন্তানের নাম রাখেন স্বপ্ন, পদ্মা ও সেতু।

এরপর পদ্মা সেতু উদ্বোধনের দিন পাবনায়ও একসঙ্গে তিন সন্তানের জন্ম দেন এ নারী—যাদের নাম রাখা হয় পদ্মা, সেতু ও উদ্বোধন। এই তিনজনের মায়ের নাম সুমী খাতুন। তার স্বামী মিজানুর রহমান পেশায় রাজমিস্ত্রী। সন্তানদের এমন নাম রাখার কারণ জানতে চাইলে মিজানুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, পদ্মা সেতু আমাদের গর্বের ও স্বপ্নের। এ ছাড়া পদ্মা সেতু উদ্বোধনের দিন তাদের জন্ম হওয়ায় সেই স্মৃতি ধরে রাখতে মূলত এ নাম রাখা হয়েছে। কোনও পুরস্কার পাওয়ার লোভে সন্তানদের এমন নাম রাখা হয়নি বলে তিনি দাবি করেন।

পরপর তিনজন নারীর একসঙ্গে তিন সন্তানের জন্মদান এবং পদ্মা সেতুর সঙ্গে মিলিয়ে তাদের নাম রাখার ঘটনাগুলোর পদ্মা সেতুর ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকবে নিশ্চয়ই। তবে ভবিষ্যতে এই শিশুরা যেহেতু তাদের নামের কারণেই পরিবার ও সমাজে আলাদাভাবে চিহ্নিত হবেন, ফলে এটি তাদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার ক্ষেত্রে যাতে কোনও ধরনের সমস্যার সৃষ্টি না হয়—সে বিষয়ে তাদের অভিভাবকদের সতর্ক থাকতে হবে।

তবে শুধু মানুষের নাম নয়, অতি উৎসাহী বাঙালি গরুর নামও রেখেছে পদ্মা সেতুর সঙ্গে মিল রেখে। গণমাধ্যমের খবর বলছে, কোরবানির ঈদ সামনে রেখে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের হীরাঝিল এলাকার একটি ফার্মে বিশেষ একটি গরুর প্রতি ক্রেতাদের আগ্রহ বাড়ছে। কারণ গরুটির নাম রাখা হয়েছে ‘পদ্মা সেতু’—বিক্রেতা যেটির দাম হাঁকিয়েছেন ৫ লাখ টাকা। প্রসঙ্গত, প্রতি বছর কোরবানির ঈদের আগে বিচিত্র নামধারী অনেক পশুর খবর গণমাধ্যমে আসে। বাদ যায় না তারকাদের নামও। অনেক সময় কোরবানির হাটে সুলতান, নবাব, কালা তুফান ইত্যাদি নামেও গরু ওঠে। নিহত আল কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেন, লিবিয়ার নিহত প্রেসিডেন্ট গাদ্দাফি, ইরাকের নিহত প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনর নামেও বাংলাদেশের বাজারে গরু উঠেছে। বাদ যাননি রেসলিং তারকা রক ও আন্ডারটেকারও।

কোরবানির হাটে আসা গরু বা ষাঁড়দের ক্ষেত্রে মানুষের নাম লক্ষ করা যায় তুলনামূলকভাবে বড় গরুদের। যাতে করে ক্রেতারা নাম দেখেই আকৃষ্ট হয়। সেই ধারাবাহিকতায় এবার পদ্মা সেতুর নামে গরুর নাম রাখা হলো। এর মধ্য দিয়ে বিক্রেতা যে ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন এবং ক্রেতাদের মধ্যেও এই গরুটি কেনা নিয়ে প্রতিযোগিতা হবে—তাতে সন্দেহ নেই। অর্থাৎ এটি হচ্ছে বিক্রেতার ব্যবসার কৌশল আর যিনি কিনবেন, সেটি হবে তার গর্ব করা বা কথা বলার একটি উপকরণ। তবে পদ্মা সেতু নিয়ে যেসব ক্রেজ তৈরি হয়েছে, সেখানে হয়তো গরুর নামকরণটিই বাকি ছিল। এর মধ্য দিয়ে বাঙালি হয়তো তার সেই আবেগ ও অতিউৎসাহের ষোলোকলা পূর্ণ করলো।

সেতুতে নামাজ:

পদ্মা সেতু উদ্বোধনের দিন সেতুর উপরে কয়েকজন ব্যক্তির নামাজ পড়ার একটি ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে গেছে—যেটি নিয়েও মানুষ নানারকম প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। প্রশ্ন উঠেছে, যে দেশে রাস্তার মোড়ে মোড়ে, পাড়ায় মহল্লায় মসজিদ, সেখানে সেতুর উপরে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তে হলো কেন? যদি বিষয়টা এমন হয় যে, সেতুতে ঘোরার সময় নামাজের সময় হয়ে গেছে, তাহলেও তারা সেতু থেকে নেমে কোনও মসজিদে নামাজ পড়তে পারতেন। আবার এই নামাজ পড়ার দৃশ্যটি যিনিই ফেসবুকে ছড়িয়ে দিন না কেন, ছবিতে দেখা যাচ্ছে তাদের নামাজ পড়ার দৃশ্যটি আরও একজন মোবাইল ফোনে ধারণ করছেন। ফলে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, তারা কি ছবি তোলার জন্যই সেতুতে নামাজ পড়লেন? নাকি তারা আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলেন যে, সেতুটি চালু হবার পরে তারা এর উপরে দাঁড়িয়ে সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাবেন? আসলে তাদের কী উদ্দেশ্য ছিল, সেটি যারা নামাজ পড়েছেন, তারাই ভালো বলতে পারবেন। তবে সেতু যে নামাজ পড়ার জায়গা নয়, এ ব্যাপারে দ্বিমতের সুযোগ কম। তাছাড়া যে সেতুতে পায়ে হাঁটাও নিষেধ, সেখানে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়াটা কতখানি যুক্তিযুক্ত, সে প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। মূলত এই ঘটনাকে একটি অতিউৎসাহমূলক কাজ বলাই শ্রেয়। এই ছবি দেখে সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, অন্য ধর্মের মানুষও যদি সেতুতে গিয়ে তাদের ধর্মীয় রীতি-নীতি পালন করা শুরু করেন, সেটি কেমন লাগবে?

সেতুতে মূত্রপাত:

বলা হয়, দেশে পাবলিক টয়লেটের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় কম। কিন্তু তাই বলে পদ্মা সেতুর মতো একটি জাতীয় স্থাপনায় মূত্র ত্যাগ করতে হবে? এই ছবিও দেশবাসীকে দেখতে হয়েছে। স্মার্টফোন ও ইন্টারনেটের যুগে ব্যক্তির গোপনীয়তা বলে যেহেতু আর কিছুই অবশিষ্ট থাকছে না এবং কে কখন কার ছবি তুলছেন, ভিডিও করছেন, তাও যেহেতু বোঝা যায় না, ফলে দুজন ব্যক্তি যে পদ্মা সেতুতে প্রস্রাব করলেন, সেই ছবিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হলো। তাদের এই কাজটি যে কেউ মোবাইল ফোনে ধারণ করেছেন, তা হয়তো তারা দেখেননি। অথবা দেখলেও কিছু মনে করেননি।

প্রশ্ন হলো, সেতুতে ওঠার পরেই তাদের প্রস্রাবের বেগ এলো কেন? সেতুতে ওঠার আগেই তারা কাজটি সেরে উঠতে পারতেন কিংবা সেতু থেকে নামার পরে। সেতুর দুই প্রান্তেই পাবলিক টয়েলেট আছে। না থাকলেও মহাসড়কের পাশে গাড়ি থামিয়ে, গাছের আড়ালে গিয়ে পুরুষদের প্রস্রাব করার ঘটনা অস্বাভাবিক বা অগ্রহণযোগ্য নয়। অথচ দুজন লোক প্রস্রাব করলেন পদ্মা সেতুর উপরে। এখানে তাদের নিয়ত যে খুব পরিস্কার ছিল না, সেটি বোঝা যায়।

অনুসন্ধান করলে হয়তো দেখা যাবে, তাদের পারিবারিক শিক্ষাটিই ত্রুটিপূর্ণ। কোনও ভদ্র, মার্জিত, শিক্ষিত লোক সেতুর ওপরে প্রস্রাব করতে পারেন না; তাতে তার যতই বেগ থাকুক। যে স্থাপনাটি নিয়ে সারা দেশের মানুষ গর্ব করছে, সেখানে প্রস্রাব করে তারা যে নিজের দেশকেই অসম্মানিত করলেন, এই বোধটুকু তাদের মনে উদয় হওয়া দরকার। পদ্মা সেতুর মতো একটি স্থাপনায় প্রস্রাব করা কোনো সভ্য লোকের কাজ নয়।

ভাইরাল হওয়াই উদ্দেশ্য?

যে শিক্ষা ও কালচারের অভাব এবং শর্টকাট পন্থায় পয়সা কামানোর ধান্দায় তরুণদের বিরাট অংশ টিকটকের নামে নিম্ন মানের, নিম্ন রুচির ভিডিও তৈরি করেন, সেই একই মানসিকতার লোকই সেতুতে প্রস্রাব করেন। লাইক, শেয়ার কমেন্টের মধ্য দিয়ে পয়সা কামানোই যখন মোদ্দা কথা—তখন সেখানে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও রুচির প্রসঙ্গ অপ্রাসঙ্গিক। আবার ইউটিউব বা টিকটকের নিম্ন মানের ও নিম্ন রুচির কনটেন্ট যে লাখ লাখ ভিউ হয়, সেজন্য সাধারণ মানুষেরও দায় কম নয়। মানুষ এগুলো দেখে বলেই এসব কনটেন্ট দিয়ে প্রচুর পয়সা আয় করা সম্ভব হচ্ছে। ডিজিটাল প্লাটফর্মে একটি রুচিশীল কনটেন্টের তুলনায় অশ্লীল, অশালীন ও ভুলভাল উচ্চারণের নিম্ন রুচির কনটেন্টের ভিউ যে বেশি, সেটি প্রমাণিত। তার মানে মানুষ খারাপ জিনিসই বেশি পছন্দ করে? খারাপ জিনিসের মাধ্যমেই মানুষ বিনোদন পেতে চায়? এর মধ্য দিয়ে কি আামাদের সামগ্রিক শিক্ষা ও রুচির মান বোঝা যাচ্ছে?

মুশকিল হলো, টিকটক বা এরকম অ্যাপ যে ভেতরে ভেতরে আমাদের তারুণ্যকে ধ্বংস করে দিচ্ছে; তাদেরকে যে একটি রুচিহীন, বিকৃত ও মূর্খ প্রজন্মে পরিণত করছে এবং তারা যদি ভবিষ্যতে কোনও গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পান, তাহলে দেশের অবস্থা কী দাঁড়াবে—সেই প্রশ্নগুলো তোলা জরুরি। যেসব অ্যাপ এরকম বিকৃতিকে উসকে দেয়, সেগুলো বন্ধ করা উচিত কি না—তা নিয়েও নীতিনির্ধারকদের ভাবনার সময় এসেছে।

লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আগুন নেভাতে 'দেরি করে আসায়' ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে 'দেরি করে আসায়' ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ