X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

এসপি সুভাষ কোনও বিচ্ছিন্ন চরিত্র নন…

আমীন আল রশীদ
১৩ সেপ্টেম্বর ২০২২, ২০:২০আপডেট : ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২২, ২০:২০

‘এসপির সম্পদ ৩ কোটি টাকার, স্ত্রীর সাড়ে ১৩ কোটি’। সম্প্রতি এরকম একটি সংবাদ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ তোলপাড় হয়েছে। যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোয় যেখানে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প থেকে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে এবং ব্যাংক ও আর্থিক খাত থেকে নানা শ্রেণিপেশার মানুষের হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে; যেখানে শত কোটির নিচে কোনও ‍দুর্নীতির খবর এখন আর গণমাধ্যমের জন্যও খুব বড় খবর নয় বলে মনে করা হয়—সেখানে একজন পুলিশ সুপারের তিন কোটি বা তার স্ত্রীর নামে ১৩ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের সন্ধান পাওয়াটা খুব বিস্মিত হওয়ার মতো খবর কিনা, সেটিই প্রশ্ন।

বস্তুত একজন পুলিশ সুপার বা থানার ওসির যে ক্ষমতা ও এখতিয়ার এবং তাদের দুর্নীতি করার যে অবাধ সুযোগ রাষ্ট্রে বিদ্যমান, সেখানে একজন এসপির তিন কোটি নয়, তিনশো বা তিন হাজার কোটি টাকার সম্পদ থাকলেও এখন আর মানুষ বিস্মিত হয় না।

গত ৬ সেপ্টেম্বর সমকালে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, সুভাষ চন্দ্র সাহা নামে একজন পুলিশ সুপারের নিজের নামে প্রায় ৩ কোটি টাকার এবং স্ত্রীর নামে ১৩ কোটি ৬১ লাখ টাকার সম্পদের প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ক্ষমতার অপব্যবহার করে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে সুভাষ চন্দ্র সাহা এই সম্পদ অর্জন করেছেন। তবে দুর্নীতির দায় থেকে নিজেকে রক্ষা করতে কৌশলে সিংহভাগ সম্পদ রেখেছেন স্ত্রীর নামে। সুভাষ চন্দ্র সাহা বর্তমানে পুলিশ সদর দপ্তরে সংযুক্ত। এসপি সুভাষ আরও বছর পাঁচেক আগেই সংবাদ শিরোনাম হয়েছিলেন। মূলত তখন থেকেই তার ব্যাপারে অনুসন্ধান চালাচ্ছিলো দুদক। সম্প্রতি সেই অনুসন্ধানের প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে।  

স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১৮ সালে মীজানুর রহমান নামে আরেকজন পুলিশ সুপারের অঢেল সম্পদের রহস্য উদ্‌ঘাটন করেছিল দুদক। জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তখন মীজান ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছিল। দুদকের এজাহারে বলা হয়, মীজানুর রহমান ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ হস্তান্তর/রূপান্তর করে জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ সম্পদ অর্জন করেছেন (প্রথম আলো, ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮)।

২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজারের টেকনাফের কাছে বাহারছড়া চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান নিহত হওয়ার মামলায় ওসি প্রদীপকে গ্রেপ্তারের পরে তার বিপুল সম্পদ নিয়েও গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়। অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০২০ সালের ২৩ আগস্ট প্রদীপ ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। তাদের বিরুদ্ধে তিন কোটি ৯৫ লাখ পাঁচ হাজার ৬৩৫ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন, সম্পদের তথ্য গোপন ও মানিলন্ডারিংয়ের অভিযোগ আনা হয় (ঢাকাটাইমস, ৩১ জানুয়ারি ২০২২)।

তখনও এই প্রশ্ন উঠেছিল যে, সারা দেশের থানাগুলোয় এরকম প্রদীপের সংখ্যা কত? এরকম কত প্রদীপের নিচে অন্ধকার জমা হয়ে আছে? একজন মেজর সিনহা খুন হয়েছেন বলে একজন ওসি প্রদীপ গ্রেফতার হয়েছেন, শাস্তি পেয়েছেন। কিন্তু প্রতিদিন যে সারা দেশের আনাচে কানাচে আরও কত প্রদীপ কত লোককে নির্যাতন করেন, ভয় ভীতি দেখিয়ে টাকা আদায় করেন, সেই হিসাব কে রাখে?

২০১৯ সালের ২০ জুন বাংলা ট্রিবিউনের একটি সংবাদ শিরোনাম ছিল: পুলিশে আরও মিজান আছে! এই খবরে বলা হয়, শুধু মিজান বা এসপি সুভাষ চন্দ্র সাহাই নন, পুলিশ কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) প্রধান অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক শেখ হিমায়েত হোসেনসহ আরও অনেকের নামই আছে এই তালিকায়।

বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া সনদ জমা দেওয়া, মাদক ব্যবসা, জেল-মামলার ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়, জমি দখলে ভূমিকা রাখা, চাঁদাবাজি, নকল পণ্যের ব্যবসা ও কারখানা পরিচালনা, পরিবারের সদস্যদের নামে ব্যবসা পরিচালনাসহ নানা অভিযোগ আছে পুলিশের অনেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।

পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) ডিআইজি (প্রোটেকশন) রফিকুল ইসলামের অবৈধ সম্পদের বিষয়ে ২০১৪ সালে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। তাদের অনুসন্ধান বলছে, চাকরিতে যোগ দেওয়ার সময় ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া বাজারে সরকারি খাস জমিতে টিনশেড বাড়ি আর কিছুই ছিল না যে রফিকুলের, পরবর্তীতে তিনি বিপুল সম্পদের মালিক হয়ে যান। যার মধ্যে শুধু ময়মনসিংহের বিভিন্ন এলাকাতেই ১০ কোটি টাকার বেশি মূল্যের বিপুল জমি, রাজধানীর যাত্রাবাড়িতে তিনটি ফ্ল্যাট, উত্তরায় আরও একটি ফ্ল্যাট ইত্যাদি। অথচ একজন পুলিশ কর্মকর্তা যে বেতন ও অন্যান্য আর্থিক সুবিধা পান, তাতে এই বিপুল সম্পদের মালিক হওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

মূল সমস্যা হচ্ছে, মাদক ব্যবসা বা মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সখ্যতা, ভয়-ভীতি দেখিয়ে টাকা আদায়, বিভিন্ন কাজ করে দেওয়ার বিনিময়ে মোটা অংকের ঘুষ নেওয়াসহ নানাভাবে পুলিশ সদস্যরা বিপুল পরিমাণে সম্পদের মালিক হন। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, হাজার হাজার অভিযোগ থাকলেও কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া তাদের বিরুদ্ধে খুব বেশি শাস্তি হয় না। বিভাগীয় শাস্তি (লঘুদণ্ড ও গুরুদণ্ড) হলেও খুব একটা চাকরি যায় না। এসব কারণে এই বাহিনীতে অপরাধ ও দুর্নীতি কমছে না। বরং মাঝে মধ্যে দুয়েকটি ঘটনা কোনও কারণে প্রকাশ্যে এলে সেটি নিয়ে সংবাদ ও সোশ্যাল মিডিয়ায় তোলপাড় হয়, এই যা।   

বস্তুত পুলিশের আইনি ক্ষমতা এবং তাদের সম্পর্কে জনমনে ভীতির পরিমাণ এতই বেশি এবং রাষ্ট্রে অপরাধীর সংখ্যাও এত বেশি যে, এর সুযোগ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ওইসব অপরাধীর কাছ থেকেও বিপুল পরিমাণে টাকা আদায় করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক সদস্য এভাবে ভয় ভীতি দেখিয়ে টাকা আদায়ের বাইরেও নানা রকমের অবৈধ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত—এমন খবরও বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে।

সুতরাং একজন পুলিশ সুপার সুভাষ কিংবা একজন ওসি প্রদীপকে বিচ্ছিন্নভাবে দোষারোপ করে তাদেরকে বিচারের মুখোমুখি করাই সমস্যার সমাধান নয়, বরং পুরো সিস্টেমের কোথায় কোথায় গলদ; আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কেন অবাধ দুর্নীতির সুযোগ পায়; বাহিনীর ভেতরে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও সুশাসনের ঘাটতি রয়েছে কিনা; তাদেরকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের ফলে তারা আরও বেশি বেপরোয়া হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে কিনা; রাষ্ট্র নিজেই তাদেরকে নানারকম অপরাধের সুযোগ করে দিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলার পথ সুগম করছে কিনা—সে প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়া সুযোগ নেই।

ফলে এটি সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রের সুশাসনের প্রশ্ন এবং এটি নিশ্চিত করা হবে কিনা, সেটি যারা সরকারে থাকেন তাদের রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রশ্ন। সরকার যদি মনে করে রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীটি সত্যি সত্যিই দুর্নীতিমুক্ত থাকবে; সরকার যদি মনে করে দেশের থানা ও পুলিশ সুপারের কার্যালয়গুলো জনগণের ভরসাস্থল ও নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্রে পরিণত হবে; বিপদগ্রস্ত মানুষের নির্ভারতার কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হবে; তাহলে কোনও এসপি বা ওসির পক্ষে কোটি কোটি টাকা দুর্নীতি করা সম্ভব নয়।

কোনও বিশেষ থানায় বদলির জন্য যদি কোটি টাকা ঘুষ দিতে হয়, তাহলে বুঝতে হবে ওই কোটি টাকা তুলে আনতে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাকে আরও কয়েক কোটি টাকা ঘুষ খেতে হবে। সুতরাং পুলিশের বদলি ও পদোন্নতির এই প্রক্রিয়ায় সবার আগে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা জরুরি। কারণ যখনই বদলি ও পদোন্নতিগুলো পেশাদারি ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থাকবে, ঘুষমুক্ত থাকবে, তখন ধীরে ধীরে পুলিশ বাহিনীতে ঘুষের পরিমাণ কমে আসবে বলে আশা করা যায়।

সেইসঙ্গে রাষ্ট্রকে এমন একটি সিস্টেম গড়ে তুলতে হবে, শাস্তি ও জবাবদিহির এমন একটি কাঠামো গড়ে তুলতে হবে যাতে কেউ ঘুষ খাওয়ার কথা কল্পনাও করতে না পারে। কিন্তু রাষ্ট্র সেটি চায় কিনা; রাজনৈতিক দলগুলোর সেই কমিটমেন্ট আছে কিনা—সেটি আরও বড় প্রশ্ন। কারণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে যদি পেশাদারি রক্ষা করে আইনি কাঠামোর মধ্য থেকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া না হয় এবং তাদেরকে যদি রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়, যদি তাদেরকে ভোটের মাঠে দলীয় ক্যাডার হিসেবে ব্যবহার করা হয়, তাহলে সেই বাহিনীর দুর্নীতি ও অপরাধ নিয়ে কথা বলার অধিকার রাষ্ট্রের থাকে না। ফলে রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারকদেরকেই আগে ঠিক করতে হবে, তারা কেমন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চান?

সরকার সব সময়ই দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের কথা বলে। কিন্তু সেই জিরো টলারেন্স রাষ্ট্রের কোনও প্রতিষ্ঠান বা বাহিনীতে যে দৃশ্যমান নয় বা কার্যকর নয়, সেটি দুর্নীতিবিরোধী সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবির জরিপে প্রতি বছরই উঠে আসে। সবশেষ গত ৩১ আগস্ট টিআিইবি যে খানা জরিপের প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, সেখানেও দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে সর্বপ্রথমে আছে পুলিশ বাহিনীর নাম।

পুলিশ সম্পর্কে মানুষের এই ধারণা তৈরি হয় তাদের দৈনন্দিন নানা কাজ ও অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। সুতরাং রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সম্পর্কে মানুষের এই পারসেপশন বা ধারণা পরিবর্তন করতে হলে আগে রাষ্ট্রকে বিশ্বাস করতে হবে যে, তারাও চায় যে পুলিশ কোনও আতঙ্ক বা ভয়-ভীতির প্রতিষ্ঠান নয়, বরং তারা সত্যিই জনগণের বন্ধু হিসেবে ভূমিকা রাখবে। রাস্তায় পুলিশের পোশাক পরা কাউকে দেখলে মানুষ তাকে সালাম দেবে; কোনও পরিবারে একজন পুলিশ সদস্য থাকলে সেই পরিবারটিকে প্রতিবেশীরা শ্রদ্ধার চোখে দেখবে এবং ওই পুলিশ সদস্য বা অফিসার তার প্রতিবেশীদের জন্য নিরাপত্তার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হবেন—সেই ব্যবস্থাটি রাষ্ট্রকেই গড়ে তুলতে হবে।  

লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
লিভারপুলের নতুন কোচ স্লট!
লিভারপুলের নতুন কোচ স্লট!
ক্ষমতায় যেতে বিএনপি বিদেশি প্রভুদের দাসত্ব করছে: ওবায়দুল কাদের
ক্ষমতায় যেতে বিএনপি বিদেশি প্রভুদের দাসত্ব করছে: ওবায়দুল কাদের
লেবাননে ইসরায়েলি হামলায় নিহত ২
লেবাননে ইসরায়েলি হামলায় নিহত ২
হামলার ঘটনায় মামলা করায় এবার বোমা হামলা, আহত ১৫
হামলার ঘটনায় মামলা করায় এবার বোমা হামলা, আহত ১৫
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ