X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

সাকিব কেন বারবার বিতর্কিত হন?

আমীন আল রশীদ
১৯ সেপ্টেম্বর ২০২২, ২০:২৬আপডেট : ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২২, ২১:৪৭

বাংলাদেশে ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় তারকা এবং সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশের ক্রিকেটের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবে যে দুজন মানুষের নাম সবার আগে আসে, তাদের একজন মাশরাফি, অন্যজন সাকিব। যদিও মাঠে সফলতার পাল্লা সাকিবেরটাই ভারী। তাকে বাংলাদেশের ক্রিকেটের ‘পোস্টার বয়’ বলেও অভিহিত করা হয়।

যে শিশুরা ক্রিকেট বোঝে বা বোঝার চেষ্টা করছে, খেলছে, বড় হয়ে ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন দেখছে—তাদের প্রত্যেকের মনের ভেতরে একজন সাকিব আল হাসান আছে। একজন মাশরাফি আছে। কিন্তু সাকিব নিয়মিত বিরতিতে খারাপ খবরের শিরোনাম হন। সোশাল মিডিয়ায় যে সাকিবের লাখ লাখ ফলোয়ার; যে সাকিব লাখো বা কোটি মানুষের কাছে আইডল—সেই সাকিবকে নিয়ে কিছু দিন পরপরই বিতর্ক ওঠে। সোশাল মিডিয়ায় তাকে নিয়ে বিষোদ্গারের ঝড় ওঠে। কিন্তু কেন?

অস্বীকার করার সুযোগ নেই, সাকিব একজন বিশ্বমানের অলরাউন্ডার। বাংলাদেশের ক্রিকেটে এ পর্যন্ত যত সফলতা এসেছে, সেখানে সাকিবের ভূমিকা অনন্য। বরং এটা বলা ভালো যে অনেক সফলতার পেছনে সাকিবের ভূমিকাই ছিল প্রধান। কিন্তু সেই সাকিব সম্পর্কে জনপরিসরে যেসব ধারণা বা মতামত সবচেয়ে বেশি প্রচলিত, তার মধ্যে কয়েকটি এরকম:

১. সাকিব বেয়াদব ও উদ্ধত।

২. সাকিব দেশের জন্য নয়, নিজের জন্য খেলেন।

৩. সাকিব স্বার্থপর।

৪. সাকিব টাকা ছাড়া কিছু বোঝেন না। তার কাছে বিসিবি বা দেশ নয়, বরং ব্যক্তিগত ক্যারিয়ারই মুখ্য ইত্যাদি।

সাকিবের বিরুদ্ধে ম্যাচ পাতানোর উদ্দেশ্যে জুয়াড়িদের সঙ্গে যোগাযোগের অভিযোগও উঠেছে এবং এই অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে নিষিদ্ধও করা হয়েছিল। আম্পায়ারের সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে স্ট্যাম্পে লাথি মারা কিংবা স্ট্যাম্প তুলে আছাড় মারার ঘটনাও ঘটিয়েছেন এই অলরাউন্ডার।

আমরা যখন সাকিবের এসব আচরণ নিয়ে কথা বলি তখন আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে ব্রায়ান লারা, হ্যান্সি ক্রনিয়ে কিংবা শচীন টেন্ডুলকারের বিনয়াবনত মুখ। খেলার মাঠে ও বাইরে এই মানুষগুলোর যে মার্জিত আচরণ, হাসিমুখ, আম্পায়ার ও সতীর্থ খেলোয়াড় এমনকি প্রতিপক্ষের সঙ্গেও তাদের যে এক্সপ্রেশন—সেটি নিয়ে আমাদের আরও অনেক দিন কথা বলতে হবে। অথচ সাকিব এই ব্রায়ান লারা কিংবা শচীনের চেয়ে কোনও অংশে ছোট ক্রিকেটার নন।

স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১৯ সালের অক্টোবরে সব ধরনের ক্রিকেট থেকে সাকিব আল হাসানকে দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ করেছিল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি)। তার বিরুদ্ধে তিনটি অভিযোগ এনে আইসিসি এই নিষেধাজ্ঞা দেয়। প্রধান অভিযোগ, ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব পেয়ে সেটি প্রত্যাখ্যান করলেও আইসিসি কিংবা বিসিবিকে না জানানো। যদিও দোষ স্বীকার করার কারণে তার এক বছরের শাস্তি স্থগিত করা হয়।

২০১৪ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সাকিব নিষিদ্ধ হয়েছিলেন মোট চারবার। ২০১৪ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দ্বিতীয় ওয়ানডে চলার সময় টিভি ক্যামেরায় অশালীন অঙ্গভঙ্গি করে তিন ম্যাচ নিষিদ্ধ হন। একই বছর তখনকার প্রধান কোচ চন্দিকা হাতুরুসিংহের সঙ্গে বাজে ব্যবহারের জন্য সাকিবকে ৬ মাস নিষিদ্ধ করা হয়। এরপরই ২০১৯ সালে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে (ডিপিএল) আবাহনী লিমিটেডের বিপক্ষে মেজাজ হারিয়ে ফের তিন ম্যাচ নিষিদ্ধ হন।

তবে খেলার মাঠে মেজাজ ঠিক রাখতে না পারা; উদ্ধত আচরণ করা কিংবা ম্যাচ ফিক্সিংয়ের ষড়যন্ত্রের খবর গোপন রাখার মতো বিষয়গুলোর বাইরেও সাকিব আরও যেসব কারণে সংবাদ শিরোনাম হয়েছেন, সেগুলো বাংলাদেশের আর কোনও ক্রিকেট তারকাকে নিয়ে হয়নি। মূলত তার এই সব নেতিবাচক সংবাদের পেছনে রয়েছে অর্থ।

সবশেষ খবর বলছে, পুঁজিবাজারে ব্যবসা করার জন্য সাকিব যে ব্রোকারেজ হাউজের ব্যবসা খুলেছেন, সেই কোম্পানির নিবন্ধনের সময় তার বাবার নামটিই ভুল। সাকিব আল হাসানের বাবার নাম খন্দকার মাসরুর রেজা। কিন্তু গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়া মোনার্ক হোল্ডিংস লিমিটেড কোম্পানির ফরম ১৫-তে সাকিবের বাবার নাম উল্লেখ করা হয়েছে কাজী আব্দুল লতিফ। এটি ইচ্ছাকৃত ভুল নাকি নিছকই ভুল, তা নিয়ে রবিবার (১৮ সেপ্টেম্বর) দিনভর সোশাল মিডিয়ায় নানা গুঞ্জন চলে। যদিও সাকিবের ব্রোকারেজ হাউজ মোনার্ক হোল্ডিংস লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আলমগীর হোসেনের বরাত দিয়ে দৈনিক বাংলার খবরে বলা হয়েছে, যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদফতর বা আরজেএসসি এই ভুল করেছে। কোম্পানির মেমোরেন্ডামে সব তথ্য ঠিক আছে। কিন্তু তারপরও বিষয়টি নিয়ে সাকিবের সমালোচনা শুরু হয় এবং তার অতীত কর্মকাণ্ডও সামনে চলে আসে। বিশেষ করে ‘টাকার জন্য তিনি সবই পারেন’ জাতীয় বক্তব্যই বেশি লক্ষ করা যায়।

এ মাসেই চার প্রতিষ্ঠানের শেয়ার কারসাজির তদন্তে বেরিয়ে আসে সাকিব আল হাসানের নাম। গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) গত বছরের ৫ মে থেকে চলতি বছরের ১০ মার্চ পর্যন্ত ৪টি তদন্ত চালায়। তাতে দেখা যায়, শেয়ার কারসাজির সময় সাকিব আল হাসান ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে বেশ কয়েকবার বিপুল সংখ্যক শেয়ার লেনদেন করেছেন। কারসাজির সঙ্গে যুক্ত মোনার্ক হোল্ডিংসের চেয়ারম্যান তিনি।

এছাড়া গত আগস্টে বেটিং সাইট বেটউইনারের একটি সহযোগী সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে জড়িত হওয়ায় প্রশ্নবিদ্ধ হন সাকিব আল হাসান। এ সময় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) চাপে তিনি ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করেন। ‘বেটউইনার নিউজ’ খেলাধুলার সংবাদ বিষয়ক ওয়েবসাইট হলেও এটি মূলত ‘বেটউইনার’ নামের একটি বেটিং কোম্পানির সহযোগী প্রতিষ্ঠান। যে কারণেই ক্রিকেট অনুরাগী ও সাকিবের ভক্তদের প্রশ্ন তৈরি হয়, যেহেতু বাংলাদেশে জুয়া নিষিদ্ধ এবং সাকিব জুয়া সংশ্লিষ্ট কারণে নিষিদ্ধও হয়েছিলেন, তাই তিনি কীভাবে এমন একটি কোম্পানির শুভেচ্ছাদূত হলেন? প্রসঙ্গত, সাকিব আল হাসান বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশনেরও শুভেচ্ছা দূত।

ক্রিকেটার হিসেবে বেতন ভাতা ও সম্মানি বাবদ সাকিবের আয় প্রচুর। কিন্তু তারপরও তার ব্যবসার পরিধিও বিশাল। বিভিন্ন পণ্যের দূত হিসেবে পরিচিতি ছাড়াও নানামুখী বিনিয়োগ ও ব্যবসার মাধ্যমে করপোরেট জগতে এরইমধ্যে নিজের পরিসর বড় করে তুলেছেন সাকিব।

২০২১ সালের ১৩ জুন বণিকবার্তার একটি খবরে বলা হয়, রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় বিনিয়োগের মাধ্যমে ব্যবসায়ী হিসেবে হাতেখড়ি সাকিব আল হাসানের। এরপর দ্রুতই নিজের ব্যবসায়িক পরিমণ্ডল বিস্তৃত করেছেন। শেয়ার বাজার, বিদ্যুৎকেন্দ্র, প্রসাধনী, ট্রাভেল এজেন্সি, হোটেল, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট, কাঁকড়া ও কুঁচের খামারসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ রয়েছে তার। দেশের বাইরে যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরবসহ আরও একাধিক দেশে তার বড় অংকের বিনিয়োগ রয়েছে।

সাকিবের সঙ্গে যার নামটি বেশি উচ্চারিত হয়, তিনি মাশরাফি। মাশরাফির ব্যাপারে এত বিশাল বিনিয়োগ বা অর্থের পেছনে এভাবে ছুটে চলার কোনও সংবাদ পাওয়া যায় না। যদিও তিনি রাজনীতিতে নেমে এখন সংসদ সদস্য।

কথা হচ্ছে, কে কীভাবে তার জীবনকে উপভোগ করবেন এবং কে কোনটাকে অগ্রাধিকার দেবেন, সেটি তার ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও পছন্দের বিষয়। সুতরাং সাকিব কোথায় কত টাকা বিনিয়োগ করলেন, তার বার্ষিক আয় কত, তিনি কত টাকা ট্যাক্স দেন, সেসব নিয়ে সাধারণ মানুষের যতটা না প্রশ্ন বা আগ্রহ, তার চেয়ে বেশি সাকিব আলোচনায় আসেন ব্যক্তিগত আচার আচরণের কারণে। আইপিএল খেলার জন্য তিনি যখন জাতীয় দলের হয়ে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট না খেলার সিদ্ধান্ত নিলেন, তখন তার দেশপ্রেম নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। সমালোচনা শুরু হয়।

ফলে যখনই সাকিব কোনও কারণে নেতিবাচক সংবাদ শিরোনাম হন, তখনই সামনে আসে তার আচরণের প্রসঙ্গটি। তখন সোশাল মিডিয়ায় চোখ রাখলে টের পাওয়া যায়, এই ন্যাশনাল হিরো বাংলাদেশের ক্রিকেটকে অনেক কিছু দিলেও তাকে অপছন্দকারী মানুষের সংখ্যাও কী বিপুল!

আবার এও ঠিক, এত সমালোচনার পরেও সাকিব যখন সেঞ্চুরি করেন, চারটি উইকেট নেন, যখন তার নৈপুণ্যে বাংলাদেশ জিতে যায়, তখন সমালোচকরাও তাকে প্রশংসায় ভাসান। তার মানে মানুষ আসলে সাকিবকে পছন্দই করে। পছন্দ করে বলেই তার ব্যাপারে কোনও ধরনের খারাপ খবর শুনতে চায় না। পছন্দ করে বলেই মানুষ চায় না সাকিব কোনও ধরনের অনৈতিক কাজের সঙ্গে যুক্ত হোন। পছন্দ করে বলেই মানুষ তার আচরণে কষ্ট পায়। টাকা কামানোর প্রতি তার বিশেষ দুর্বলতার সমালোচনা করে।

মানুষ মনে করে, একজন মানুষের সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা নিয়ে সর্বোচ্চ মানের জীবনযাপনের জন্যও যে পরিমাণ টাকার প্রয়োজন, তা যেহেতু সাকিব অর্জন করেছেন, ফলে শেয়ার কেলেঙ্কারির সঙ্গে সাকিবের নাম কেন আসবে? একজন মানুষের কত টাকা প্রয়োজন?

মূলত সাকিব সম্পর্কে মানুষ এই যে কথাবার্তা বলে, সেগুলো আসলে তার প্রতি অভিমান। তাকে সবাই ভালোবাসে। সুতরাং সেই ভালোবাসার মানুষটি সম্পর্কে যখন কোনও খারাপ সংবাদ আসে, কোনও অভিযোগ ওঠে, সেই ভালোবাসার মানুষটি যখন স্ট্যাম্পে লাথি মারেন, সেই ভালোবাসার মানুষটি যখন বেশি পয়সা কামানোর জন্য নিজের দেশের চেয়ে আইপিএলকে বেশি গুরুত্ব দেন বলে অভিযোগ ওঠে—মানুষ সেটি মানতে পারে না। এই মানতে না পারার যে অভিমান, যে ইমোশন থেকে মানুষ তাকে নিয়ে সোশাল মিডিয়ায় ট্রল করে বা তাঁকে নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করে, মানুষের সেই ইমোশনটা সাকিব বোঝেন কিনা—সেটিই বিরাট প্রশ্ন।

লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
একসঙ্গে ইফতার করলেন ছাত্রলীগ-ছাত্রদলসহ সব ছাত্রসংগঠনের নেতারা
একসঙ্গে ইফতার করলেন ছাত্রলীগ-ছাত্রদলসহ সব ছাত্রসংগঠনের নেতারা
শনিবার সকালে আবার অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা বুয়েট শিক্ষার্থীদের
শনিবার সকালে আবার অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা বুয়েট শিক্ষার্থীদের
ইসরায়েল যা যা অস্ত্র চেয়েছিল সব পায়নি: মার্কিন সেনাপ্রধান
ইসরায়েল যা যা অস্ত্র চেয়েছিল সব পায়নি: মার্কিন সেনাপ্রধান
ছুটির দিনে নিউ মার্কেটে জনসমুদ্র
ছুটির দিনে নিউ মার্কেটে জনসমুদ্র
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ