X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কলামিস্ট নয়, প্রয়োজন আইন বিশেষজ্ঞ

কাওসার আহ্‌মেদ
২৩ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৬:৩৮আপডেট : ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৬:৩৮

স্নাতকোত্তর পর্যায়ে শিক্ষকতার কারণে বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক আইন বিষয়ক খবরগুলোতে নিয়মিত চোখ রাখতে হয়। এ কারণে জাতিসংঘের মানবাধিকার-বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেটের বাংলাদেশ সফর সংক্রান্ত খবরগুলো নিয়মিত পড়েছি এবং অনুভব করেছি, বাংলাদেশের নীতিনির্ধারণী মহলের আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ প্রয়োজন।

বিভিন্ন কারণে বিষয়টি নিয়ে কলম ধরার সুযোগ পাইনি। কিন্তু সম্প্রতি যখন জানতে পারলাম পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্মানির বিনিময়ে সরকারের সমর্থনে ইতিবাচক প্রচারণা চালানোর জন্য কলাম লেখানোর উদ্যোগ নিচ্ছে, তখন মনে হলো বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে লেখার সময় এখনও ফুরিয়ে যায়নি। কারণ, একটু লক্ষ করলেই বেশ বোঝা যায়, বাংলাদেশের নীতিনির্ধারক অনেকের আন্তর্জাতিক আইনের গতিধারা বোঝার ক্ষেত্রে একটা ফাঁক থেকে যাচ্ছে। আর সেজন্য এই মুহূর্তে কলাম লেখকের চেয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞের সহায়তা গ্রহণ বেশি প্রয়োজন। তাতে সুফলও মিলবে অনেক বেশি।

উপরিউক্ত পর্যবেক্ষণটির সারবত্তা বোঝানোর জন্য মিশেল ব্যাচেলেটের বাংলাদেশ সফরের সময় বিভিন্ন দায়িত্বশীল মন্ত্রী যেসব বক্তব্য দিয়েছেন তা আলোচনা করাই যথেষ্ট হবে বলে মনে করি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের মন্তব্য দিয়ে শুরু করা যাক। পত্রিকায় প্রকাশ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিগত ১৪ আগস্ট মিশেল ব্যাচেলেটের সঙ্গে বৈঠকে বলেছেন, ‘গুম বলে আমাদের দেশে কোনও শব্দ নেই। তবে, কিছু কিছু লোক বলেছে যে ৭৬ জন লোক গত ১০ বছরে নিখোঁজ হয়েছেন। তারা বলছে যে সরকার নিখোঁজ করেছে। এই ৭৬ জনের মধ্যে ১০ জনকে পাওয়া গেছে, ঘোরাঘুরি করছে। বাকিগুলো আমরা ঠিক জানি না।’ (বাংলা ট্রিবিউন, ১৪ আগস্ট, ২০২২)।

একইভাবে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং নির্যাতনের অভিযোগ প্রসঙ্গে মিশেল ব্যাচেলেটের নিরপেক্ষ, স্বাধীন ও স্বচ্ছ তদন্তের পরামর্শের জবাবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ‘বাংলাদেশের আইনে যা বলা আছে, সেটাই হতে হবে।’ (প্রথম আলো,  ১৯ আগস্ট ২০২২)।

উল্লেখিত দুটো মন্তব্যই এই ইঙ্গিত দেয় যে আন্তর্জাতিক আইন সম্পর্কে আমাদের নীতিনির্ধারকদের আরও স্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার। যেমন, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে প্রমাণিত হয়, এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স বা গুম যে আন্তর্জাতিক আইনে ‘ইয়্যুস কোগেন্স’ বা অলঙ্ঘনীয় বিধান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে সে সম্পর্কে তিনি হয়তো অবহিত নন। যেহেতু গুম নিবারণ করা ‘ইয়্যুস কোগেন্স’ বা অলঙ্ঘনীয় বিধান সেহেতু এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স সম্পর্কিত কনভেনশনের সদস্য রাষ্ট্র না হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক আইনে ‘গুম’ বিষয়ক উত্থাপিত অভিযোগের জবাবদিহি থেকে অব্যাহতি পাবে না। তাই, এ বিষয়টিকে হালকা করে দেখার কোনও সুযোগ নেই। তদুপরি, স্থানীয় আইন বা আইন-ব্যবস্থার দোহাই দিয়ে আন্তর্জাতিক আইনগত দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া যায় না। বরং আন্তর্জাতিক আইনকে কার্যকর করার জন্য যথাযথ স্থানীয় আইনের অনুপস্থিতি বা অপ্রতুলতাও আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন বলে বিবেচিত হতে পারে।

আবার আইনমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে কোনও পাঠক হয়তো এরকম মনে করতেই পারেন যে বাংলাদেশের আইনের ওপরে আন্তর্জাতিক আইনের কোনও প্রাধান্য নেই। অথচ যদি স্থানীয় আইনের ওপর আন্তর্জাতিক আইনের প্রাধান্য নাই থেকে থাকে তাহলে বিভিন্ন রাষ্ট্র কর্তৃক বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চুক্তি বা দলিল অনুসমর্থন করার কী তাৎপর্য থাকতে পারে? এ কারণেই আন্তর্জাতিক আইন পরিপালনের ব্যর্থতার ক্ষেত্রে স্থানীয় আইন বা আইন ব্যবস্থার প্রাধান্য কিংবা অপ্রতুলতা কোনও গ্রাহ্য যুক্তি হিসেবে বিবেচিত হয় না।

উপরের এ কথাগুলো আন্তর্জাতিক আইনের প্রাথমিক বিষয়।  

তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায়, আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি বাংলাদেশের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে মিশেল ব্যাচেলেট এ দেশের নীতিনির্ধারকদের কাছ থেকে কী বার্তা পেলেন? সচেতন পাঠকেরা হয়তো ইতোমধ্যে এ প্রশ্নের উত্তর মিশেল ব্যাচেলেটের বিদায়ী বক্তব্য থেকে কিছুটা অনুধাবন করতে পেরেছেন। তিনি বলেছেন, “জাতিসংঘের টর্চারবিরোধী কমিটিসহ অন্যান্য মেকানিজমগুলো অনেক বছর ধরে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, টর্চার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে – যার অনেকগুলোর জন্য র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন ও জবাবদিহির অভাবকে দায়ী করা হয়েছে। আমি সরকারের মন্ত্রীদের কাছে এসব গুরুতর অভিযোগ সম্পর্কে আমার গভীর উদ্বেগ জ্ঞাপন করেছি এবং জননিরাপত্তা খাতের সংস্কারের সাথে সাথে এ অভিযোগসমূহের নিরপেক্ষ, স্বাধীন ও স্বচ্ছ তদন্তের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছি”।” (১৭ আগস্ট ২০২২)।

যদি মিশেল ব্যাচেলেট এবং বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের বক্তব্যের তুলনামূলক পর্যালোচনা করা হয় তাহলে এটাই প্রতীয়মান হয়, পররাষ্ট্র বা আইন মন্ত্রণালয়ে নিযুক্ত কর্মকর্তারা আন্তর্জাতিক আইনের একেবারে প্রাথমিক বিষয়গুলোও নীতিনির্ধারকদের যথাযথভাবে অবহিত করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয়ের চাহিদা তালিকার ওপরের দিকে কী থাকা প্রয়োজন? কলামিস্ট নাকি আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ? বর্তমান বিশ্বে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পত্রিকায় কলাম লিখে প্রভাবিত করার ভাবনা অতি সরল চিন্তার বহিঃপ্রকাশ বলেই মনে হয়।

আন্তর্জাতিক আইনের একজন শিক্ষক ও গবেষক হিসেবে আমার মূল্যায়ন হলো, মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে বাংলাদেশের উত্তরণের সাথে সাথে আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলার প্রসঙ্গটি আরও গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে আবির্ভূত হবে। সেই আভাসও ইতোমধ্যে যথেষ্ট স্পষ্ট হয়েছে।

এ অবস্থায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে আন্তর্জাতিক আইন একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে বিবেচিত না হলে বাংলাদেশের অর্থনীতির টেকসই বিকাশের পথে বাধা সৃষ্টি হতে পারে। আন্তর্জাতিক আইনের জ্ঞান ছাড়া বর্তমান সময়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সঠিকভাবে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। অতএব, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচিত হবে আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ গ্রহণ করা।

সংবিধানের ২৫ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘের সনদে বর্ণিত নীতিসমূহ হবে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভিত্তি।

লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
প্রথম ধাপে ভোটের হার ৬০ শতাংশ, সর্বোচ্চ পশ্চিমবঙ্গে
লোকসভা নির্বাচনপ্রথম ধাপে ভোটের হার ৬০ শতাংশ, সর্বোচ্চ পশ্চিমবঙ্গে
ইসরায়েলি বিমান কীভাবে এল বাংলাদেশে, প্রশ্ন নুরের
ইসরায়েলি বিমান কীভাবে এল বাংলাদেশে, প্রশ্ন নুরের
মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশি
মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশি
১৬ বছর ধরে পুনরুদ্ধার করা ‘নেপোলিয়ন’ দেখাবে কান
কান উৎসব ২০২৪১৬ বছর ধরে পুনরুদ্ধার করা ‘নেপোলিয়ন’ দেখাবে কান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ