X
বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪
১৯ বৈশাখ ১৪৩১

সুইমিং পুলের বিলাসিতা

প্রভাষ আমিন
২০ অক্টোবর ২০২২, ১৮:২৪আপডেট : ২০ অক্টোবর ২০২২, ১৮:২৪

বিশ্ব এখন এক মহামন্দার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কোভিডের কারণে বিশ্ব অর্থনীতি প্রবল চাপের মুখে পড়েছিল। দিনের পর দিন লকডাউনে বিশ্ব অর্থনীতি স্থবির হয়ে গিয়েছিল। কোভিড আতঙ্ক কাটিয়ে অর্থনীতি যখন ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই করছিল, তখনই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নতুন এবং আরও শঙ্কা নিয়ে আসে। যুদ্ধ এখন আট মাসে পড়েছে এবং শিগগিরই থেমে যাবে তেমন লক্ষণও নেই। আট মাসের ধকল সামাল দিতেই বিশ্বের কয়েক বছর লেগে যাবে। যুদ্ধ যত প্রলম্বিত হবে, মন্দা তত ভয়ঙ্কর হবে।

বাংলাদেশও বিশ্বের বাইরে নয়। তাই মহামন্দার ঢেউ ধেয়ে আসছে বাংলাদেশের দিকেও। গত এক যুগে বাংলাদেশের অর্থনীতির বিস্ময়কর অগ্রগতি হয়েছে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার  যোগ্যতা অর্জন করেছে। মাথাপিছু আয় বেড়েছে। দেশেও দৃশ্যমান উন্নয়ন হয়েছে। বিশেষ করে বিদ্যুৎ এবং যোগাযোগ অবকাঠামো খাতে উন্নয়ন ছিল অভাবনীয়। প্রায় অন্ধকার একটি দেশের ঘরে ঘরে পৌঁছে গিয়েছিল বিদ্যুতের আলো। গোটা বাংলাদেশ এখন দারুণভাবে সংযুক্ত। পদ্মা সেতু তো আমাদের সক্ষমতার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। কর্নফুলী নদীর নিচে টানেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মতো বড় বড় প্রকল্প শেষ প্রান্তে। এমন অবস্থায় কোভিড এসে আমাদের উন্নয়নের গতি শ্লথ করে দেয়। আর যুদ্ধ এসে গতি থামিয়ে দিয়েছে প্রায়। হঠাৎ করেই উন্নয়নের হাওয়ায় ভাসতে বাংলাদেশ এক শঙ্কার সামনে দাঁড়িয়ে।

৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাওয়া রিজার্ভ কমতে কমতে এখন ২৮ বিলিয়ন ডলারে ঠেকেছে। বাংলাদেশে রিজার্ভের মূল উৎস রফতানি আর রেমিট্যান্স। আর রফতানি মূলত তৈরি পোশাকনির্ভর। মন্দার শঙ্কা শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বজুড়ে। তাই বাংলাদেশের প্রধান বাজার ইউরোপের মানুষকেও পোশাকের বিলাসিতা বাদ দিয়ে জ্বালানি আর খাদ্যপণ্য নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। এই ভাবনা লম্বা হলে টান পড়বে রফতানিতে, টান পড়বে রেমিট্যান্সেও। ইতিমধ্যে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় আগুন লেগেছে বাজারে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় কমাতে হয়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদন। আপাতত লোডশেডিং নিয়েই আমাদের চিন্তা। কিন্তু সময় আসছে, লোডশেডিং নিয়ে ভাবার সময় থাকবে না। আগে চাই খাবার নয়তো দিন চলে না। এখানেই একটু ভরসার জায়গা– আমাদের কৃষকরা এখনও মাথার ঘাম পায়ে ফসল ফলাতে পারছেন। প্রধানমন্ত্রী বারবার উৎপাদনে নজর দিতে বলছেন। প্রতিটি ইঞ্চি কাজে লাগাতে বলছেন, খাবার অপচয় না করতে বলছেন। আমরা যদি খাদ্য উৎপাদনে আরও মনোযোগী হই, তাহলে যত মন্দাই আসুক, অন্তত না খেয়ে থাকতে হবে না।

মন্দা বা দুর্ভিক্ষের শঙ্কা আজকের নয়। প্রধানমন্ত্রী অনেকদিন ধরেই কৃচ্ছতার কথা বলছেন। শুধু বলেই ক্ষান্ত নয়, সরকার এরইমধ্যে খরচ কমানোর নানা উদ্যোগ নিয়েছে। বিদ্যুৎ খরচ বাঁচাতে অফিস সময় বদলানো হয়েছে। অতি জরুরি প্রকল্প ছাড়া অর্থ ছাড় বন্ধ রয়েছে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বিদেশ ভ্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। যানবাহন কেনা বন্ধ রাখা হয়েছে। সামনের ভয়াবহ সময় থেকে বাঁচতে সাশ্রয়ের কোনও বিকল্প নেই। কখনও সময় আসে নাক ভাসিয়ে বেঁচে থাকতে হয় সুসময়ের আশায়। প্রধানমন্ত্রী বা সরকারকে গালি দিয়ে এই সমস্যা মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। জাতিগভাবে আমাদের সাশ্রয়ী হতে হবে এবং মত পথ ভুলে সবাই মিলে সমস্যা মোকাবিলা করতে হবে।

তবে মুখে বললেই তো আর সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে না। কিছু সমস্যা আছে, যার সমাধানে টাকা লাগে। আপনাকে বাড়ি ভাড়া দিতে হবে, খাবার কিনতে হবে, সন্তানের পড়ালেখার ব্যয় করতে হবে, চিকিৎসার জন্য ব্যয় করতে হবে। মানুষের বিলাসিতা বন্ধ হয়ে হয়ে গেছে করোনাকালেই। এখন টান পড়ছে জরুরি ব্যয়ে। মানুষের ব্যয় বেড়েছে। কিন্তু আয় তো বাড়েইনি, বরং মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিলে আয় কমে গেছে। ব্যাংকে টাকা রাখার চেয়ে ঘরে সিন্দুকে টাকা রাখা বরং লাভজনক। তবে টাকা রাখা বা সঞ্চয়ের উপায় নেই কারোই। মানুষ বরং সঞ্চয় ভেঙে জরুরি প্রয়োজন মেটাচ্ছে। শেয়ার বাজারেও পড়েছে মন্দার প্রভাব। মানুষ লসে শেয়ার বিক্রি করে সংসারের খরচ মেটাচ্ছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির জরিপ বলছে, দেশের ৬৮ ভাগ মানুষ খাদ্য কিনতে হিমশিম খাচ্ছে।

এই যখন দেশের অবস্থা, প্রধানমন্ত্রী যখন নিয়মিত সাশ্রয়ের কথা বলছেন, বৈশ্বিক দুর্ভিক্ষের শঙ্কার কথা বলছেন; তখন একটি প্রকল্প নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোলপাড়। বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে যেমন হাজার হাজার কোটি টাকার মেগা প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, যেভাবে লক্ষ কোটি টাকা পাচার হয়েছে, যেভাবে ব্যাংক আর শেয়ারবাজার লুট হয়েছে; তাতে ৪৩ কোটি টাকার একটি প্রকল্প আসলে ধর্তব্যেই আসে না। কিন্তু প্রকল্পের ধরনটাই তুলে দিয়েছে সমালোচনার ঝড়। শীর্ষ দুই আমলা মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও মুখ্য সচিবের জন্য নতুন বাড়ি বানাতে চায় সরকার, যার ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৩ কোটি টাকা। এটা ঠিক আমলাতন্ত্রের শীর্ষ এই দুই কর্মকর্তার পদের বিপরীতে নির্ধারিত বাসভবন নেই। তবে তারা সরকারি বাসভবনেই থাকেন। বর্তমান মন্ত্রিপরিষদ সচিব থাকেন মিন্টো রোডে  আর মুখ্য সচিব থাকেন গুলশানে সরকারি বাসভবনে।

দুই শীর্ষ আমলার জন্য নির্ধারিত বাসভবন বানানো হয়তো দরকার। তবে প্রশ্ন উঠেছে এর সময় এবং ব্যয় নিয়ে। দেশজুড়ে যখন সাশ্রয়ের স্লোগান, তখনই কেন এমন প্রকল্প নিতে হবে, আর দুটি বাড়ি বানাতেই কেন ৪৩ কোটি লাগবে; তা নিয়ে যত সমালোচনা। তবে এখন মনে হচ্ছে, ব্যয় ৪৩ কোটি টাকায সীমিত রাখা হয়েছে ইচ্ছা করেই। প্রকল্প ব্যয় ৫০ কোটি টাকার বেশি হলে সেটা একনেকের অনুমোদন লাগে। এর নিচে হলে পরিকল্পনা মন্ত্রীই তা অনুমোদন করতে পারেন। গত রবিবার ‘মন্ত্রিপরিষদ সচিব এবং প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের সরকারি বাসভবন নির্মাণ’ প্রকল্পটি গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। রাজধানীর অভিজাত এলাকা ইস্কাটন গার্ডেনে পাশাপাশি তিনতলা ভবন দুটি নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে সেখানে দুটি ছয়তলা ভবন রয়েছে। সে দুটি ভেঙে নতুন দুটি ভবন বানানো হবে। প্রতিটি ভবন হবে তিনতলা। সাড়ে ১৮ হাজার বর্গফুটের প্রতিটি ভবন নির্মাণে ব্যয় হবে সাড়ে ২১ কোটি টাকা করে। দুটি বাসভবনেই সুইমিংপুল থাকবে, যার নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ কোটি ১০ লাখ টাকা। তিনতলা ভবন দুটির মূল নির্মাণ ব্যয় সাড়ে ৯ কোটি টাকা করে। এ ছাড়া দুটি ভবনেই অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জাতে খরচ হবে ২ কোটি ২৫ লাখ টাকা। আসবাবের পেছনে দেড় কোটি টাকা। ভবন দুটির জন্য ৭টি করে ১৪টি এলইডি টেলিভিশন কেনা হবে। এতে ব্যয় হবে ৯ লাখ টাকা। ৬০ লাখ টাকা ব্যয়ে ৩২টি সিসিটিভি সিস্টেম কেনা। তিনতলা ভবনের জন্য লিফট কেনা হবে ১ কোটি ৫৫ লাখ টাকা দিয়ে। অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থায় খরচ হবে ১ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। আর বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ খাতে খরচ হবে ১৮ লাখ টাকা।

শীর্ষ দুই আমলার জন্য প্রস্তাবিত বাসভবনের বিবরণ পড়ে আমার লোভ হচ্ছে, ইশ একবার যদি অন্তত দেখতে পারতাম। সবচেয়ে বেশি লোভ হচ্ছে সুইমিং পুলের ব্যয়ের বিবরণ দেখে। পানি আমার খুবই প্রিয়। ছেলেবেলায় গ্রামে পুকুরে ইচ্ছামত সাঁতার কেটেছি। শহরে সেই সুযোগ নেই। ব্যাকপেইনের কারণে ডাক্তার আমাকে সাঁতারের পরামর্ম দিয়েছেন। কিন্তু ঢাকায় সাঁতার মানেই সুইমিং পুল। আর সুইমিং পুল মানেই বিলাসিতা, টাকার শ্রাদ্ধ। আমরা ঢাকার বাইরে কোথাও বেড়াতে গেলে আমি হোটেলে সুইমিং পুল আছে কিনসা সেটা আগে খোঁজ নেই। তাই মন্ত্রিপরিষদ সচিব আর মূখ্য সচিবের প্রস্তাবিত বাসভবনে সুইমিং পুল থাকছে শুনে ভালোই লাগছে।

তবে যতদূর জানি বঙ্গভবন বা গণভবনে সুইমিং পুল নেই। মন্ত্রীপাড়ার বাসভবনগুলোতেও সুইমিং পুল আছে বলে শুনিনি। তাই দুই শীর্ষ আমলার বাসভবনে ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে বানানো হলে, সেটা হবে বাংলাদেশের উন্নয়নে বড় এক লাফ। নিশ্চয়ই পর্যায়ক্রমে মন্ত্রীদের জন্যও সুইমিং পুলসহ আধুনিক বাসভবন বানানো হবে।

তবে দেশের মানুষ যখন খেতে পায় না, তখন শীর্ষ আমলাদের বাসায় ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে সুইমিং পুল বানানোর বিলাসী প্রস্তাব শুনতে খারাপ লাগে। এটুকুই যা সমস্যা। তবে আস্তে আস্তে নিশ্চয়ই আমাদের কান এসব শুনতে অভ্যস্ত হয়ে যাবে।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ভুয়া মৃত সনদ নিজেই তৈরি করতো মিল্টন: হারুন অর রশীদ
ভুয়া মৃত সনদ নিজেই তৈরি করতো মিল্টন: হারুন অর রশীদ
রাফাহতে ইসরায়েলি হামলা ঠেকাতে ডেমোক্র্যাটদের চাপের মুখে বাইডেন
রাফাহতে ইসরায়েলি হামলা ঠেকাতে ডেমোক্র্যাটদের চাপের মুখে বাইডেন
মন্ত্রী-এমপির স্বজনদের প্রার্থিতায় নিরুৎসাহের কারণ ব্যাখ্যা করলেন শেখ হাসিনা
মন্ত্রী-এমপির স্বজনদের প্রার্থিতায় নিরুৎসাহের কারণ ব্যাখ্যা করলেন শেখ হাসিনা
জাল সনদে টেলিটকে চাকরি, পদন্নোতির সময় ধরা ৪ কর্মকর্তা
জাল সনদে টেলিটকে চাকরি, পদন্নোতির সময় ধরা ৪ কর্মকর্তা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ