X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

অনলাইন-অফলাইন বুলিংয়ের ক্ষতিকর প্রভাব ও প্রতিকার

সাজ্জাদ কাদির
২০ নভেম্বর ২০২২, ১৮:৫১আপডেট : ২০ নভেম্বর ২০২২, ১৮:৫১

পৃথিবীতে এমনিতেই অপরাধের শেষ নেই। তার ওপর এই শতাব্দীতে যোগ হয়েছে অনলাইন অপরাধ। আর অফলাইন তো আছেই। এরমধ্যে বর্তমান সময়ে সাইবার বুলিং একটি বহুল সংঘটিত অপরাধ। বুলিং বলতে আমরা বুঝি দুজন ব্যক্তির মধ্যে বিবাদের জের ধরে একজন ব্যক্তিকে সুনির্দিষ্টভাবে দোষারোপ বা খারাপ ভাষায় আক্রমণ করা। এই আক্রমণ মৌখিক আবার লিখিতও হতে পারে। আবার একজনের ছবি বা ভিডিও বিকৃত করে অনলাইনে তুলে ধরাও বুলিংয়ের মধ্যে পড়ে। কেউ আপনাকে হেয় করে সোশাল মিডিয়ায় কটূক্তি করা, এমনকি বর্ণবৈষম্যমূলক মন্তব্য করলেও সেটিও বুলিংয়ের আওতায় পড়ে। সহজ ভাষায় বলা যায়, ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে কারও ব্যক্তিগত দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে হেয় করা, ভয় দেখানো বা মানসিক নির্যাতন বা অন্যায় কোনও কিছুতে প্রলুব্ধ করা বা বাজে কোনও মন্তব্য করাই হলো সাইবার বুলিং বা সাইবার অপরাধ।

অনলাইন ছাড়াও নানাভাবে অফলাইনেও এমন অপরাধ সংঘটিত হয়। যেমন, আপনি যে অপরাধের সঙ্গে জড়িত নয় অথচ তেমন মিথ্যা অভিযোগ বা কটূক্তি করে লিখিত অথবা মৌখিকভাবে বলে বেড়ানোও একটি অপরাধ। তবে এসব অপরাধ দমনে প্রচলিত আইন রয়েছে দেশে। দরকার শুধু সচেতন থাকা এবং সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার আগেই প্রয়োজনে আইনের আশ্রয় নেওয়া।

অনলাইন-অফলাইন হয়রানি বা সাইবার বুলিংয়ের কারণে অনেকেরই মানসিক স্বাস্থ্য মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই ক্ষতি কখনও কখনও ভয়াবহ আকার ধারণ করে। চূড়ান্ত পরিণতিতে হতাশা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়ার মতো ঘটনাও আছে পৃথিবীতে ভূরি ভূরি। আপনি জীবনে কোনোদিন কোনও অপকর্মের সঙ্গে নিজেকে জড়াননি অথচ আপনার নামে অনলাইনে সোশাল মিডিয়ায়, মৌখিকভাবে আপনার শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছে কিংবা লিখিতভাবেও কোথাও আপনার নামে মিথ্যা, বানোয়াট, ভিত্তিহীন অভিযোগ করা হলো, তখন প্রাথমিক অবস্থায় আপনার মানসিক স্বাস্থ্য কী হতে পারে? আপনি যত দৃঢ়চেতা মনোবলসম্পন্ন মানুষ হন না কেন প্রাথমিক অবস্থায় আপনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়তে বাধ্য।

এক্ষেত্রে মানসিক সাপোর্ট নেওয়ার জন্য আপনার জন্য সবচেয়ে কার্যকর হতে পারে ভালো কোনও মনোবিদ অথবা আইনজীবী। মনোবিদ আপনার মনের অবস্থা বিশ্লেষণ করে নির্ভার হবার কলাকৌশল শিখাবেন এবং আইনজীবী আইনের নানা দিক বিশ্লেষণ করে আপনাকে নির্ভার হতে সহায়তা করতে পারেন। আর এক্ষেত্রে অপরাধীদের সরাসরি একই পন্থায় পাল্টা জবাব দেওয়া যাবে না। নীরবতা অবলম্বন করতে হবে। আপনার নীরবতা এবং নীরবে তাকে প্রতিরোধে আপনার কর্ম তার জন্য ভয়ংকর আতঙ্কের কারণ হতে পারে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে অনলাইন বা অফলাইনে বুলিং কারা করে? এককথায় যদি বলি তাহলে বলতে হবে, যার কোনও মান/সুনাম নেই সেই ব্যক্তিই সমাজে আপনার মান/সুনাম দেখে ঈর্ষান্বিত  হয়ে এসব করে থাকে। কোনও স্বনামধন্য মানুষ অন্য কারও মানহানি করেছে এমন উদাহরণ খুঁজে পাওয়া কঠিন। অতি সাম্প্রতিক এমন তিনটি ঘটনা আমার পরিচিতজনদের সঙ্গে ঘটতে দেখেছি। উদাহরণ হিসেবে সেগুলোই এখানে আনছি। প্রথম ঘটনাটি ঘটেছে একজন অশিক্ষিত নিম্নশ্রেণির লোক তার এক নিকট আত্মীয় যিনি সুশিক্ষিত এবং জাতীয়ভাবেই তার বহুমাত্রিক কর্মের মাধ্যমে বিশিষ্টতা অর্জন করেছেন তার ব্যাপারে এখানে ওখানে কটূক্তি করার মাধ্যমে। এমনকি লিখিতভাবেও এখানে  সেখানে মিথ্যা, বানোয়াট, ভিত্তিহীন অভিযোগ করার মাধ্যমে। বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, যিনি অভিযোগ করেছেন সমাজে তার অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া কঠিন। একজন দেউলিয়া টাইপের গ্রাম্য ক্ষুদ্র দোকানদার অভিযোগ করেছেন জাতীয়ভাবে বিশিষ্ট লোকের ব্যাপারে। যা রীতিমত হাস্যকর।

দ্বিতীয় ঘটনাটিতে দেখা গেছে একজন সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোকের ভুঁইফোড় ইউটিউবারদের ডেকে বিষোদগার করতে। এই ঘটনাতেও দেখা যায় যিনি বিষোদগার করেছেন তিনি নিজেই সেই অভিযোগে অভিযুক্ত; অথচ আর একজনের নামে সেসব বিষোদগার করছেন। তৃতীয় ও শেষ ঘটনাটিতে দেখা গেছে, এক উদভ্রান্ত সংসার, ধর্ম, কর্মহীন ড্রাগ আসক্ত এক মহিলা আর এক ভদ্র মহিলা এবং তার স্বামীকে নিয়ে ফেসবুকে আচ্ছা মতো কটূক্তি করে তার নিজের মনের জ্বালা মিটিয়েছেন। এক্ষেত্রেও বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বুলিংকারী সংসার-ধর্মহীন একজন মধ্যবয়স্ক মানুষ, সারা জীবন উচ্ছৃঙ্খলভাবে বেপরোয়া জীবনযাপন করেছেন। এই বয়সে এসে রীতিমত একাকিত্ব থেকে আর একজনের স্বামী-সংসার, সন্তান দেখে ঈর্ষান্বিত হয়ে সেসব মন্তব্য বা বুলিং করেছেন। ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, তিনিটি ঘটনাতেই অপরাধীদের সমাজে কোনও অবস্থান নেই। এই তারাই অন্যের মান নিয়ে টানাটানি করে। এ ধরনের অপরাধীদের মূল উদ্দেশ্যই থাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করা এবং সমাজের চোখে অন্যকে খাটো করা। এভাবে কি খাটো করা যায়? সেই জ্ঞান বা বোধ থাকে না এদের। এখানে উল্লেখিত তিনটি ঘটনাই মামলাযোগ্য এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যাদের বিরুদ্ধে অপরাধীরা এগুলো করেছে তারা প্রত্যেকেই প্রথম অবস্থায় মানসিক যন্ত্রণায় পড়েছিলেন। পরক্ষণেই যখন মনোবিদ এবং আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করেছেন, তখন মানসিকভাবে আবার চাঙা হয়ে  উঠেছেন।

অন্যদিকে বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, অপরাধীদের যখন এই তিন জন সরাসরি কোনও প্রতিক্রিয়া দেখাননি, তখন অপরাধীরাই উল্টো আতঙ্কে পড়েছে। মামলা, আইন, আদালত ইত্যাদি ঘটে কিনা এই ভয়ে তারা ভীত হয়ে পড়েছে। আসলে বিষয়গুলো এমনটাই হয়। শেষ বিচারে এ ধরনের অপরাধীরাই ভয়াবহ বিপদে পড়ে যায়।

সাইবার বা অফলাইন মানহানিকর বুলিংয়ের শিকার হলে প্রথমে নিজেকে বোঝাতে হবে, এর জন্য আপনি দায়ী নন। কোনোভাবেই আতঙ্কিত অথবা ভয় পাওয়া যাবে না। মাথা ঠান্ডা রেখে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে হবে। অনলাইন বা অফলাইন যেভাবেই মানহানিকর অপরাধের শিকার হন না কেন, কখনোই অপরাধীকে সাড়া দেওয়া যাবে না। এই সাড়া না দেওয়াটা অপরাধীর জন্য এক নীরব শাস্তি। নিজে একই পন্থায় পাল্টা আক্রমণ করা যাবে না। আক্রমণের শিকার হলে সবার আগে এর পক্ষে যথাযথ প্রমাণ সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ করতে হবে। প্রাথমিকভাবে যে বা যার দ্বারা বুলিংয়ের শিকার হচ্ছেন, প্রথমেই প্রতিপক্ষকে সতর্ক বার্তা পাঠাতে পারেন। তাকে বুঝিয়ে বলতে পারেন। আপনি নিজে না পারলে আপনার বন্ধু বা আত্মীয়কেও এই আলোচনাটুকু করতে অনুরোধ করতে পারেন। বুলিংয়ের শিকার যেহেতু নারীরা বেশি হন এবং সাধারণত তারা তাদের সমস্যাগুলো এখনও পরিবারের সঙ্গে শেয়ার করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না, তাই বুলিংয়ের শিকার হলে অবশ্যই একজন আপনজনকে জানাতে হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সব অ্যাকাউন্টেই ব্লক করার সুবিধা থাকে। প্রাথমিক বুলিং হলে বা অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও অসংলগ্ন কথা বললে তাকে ব্লক করে দিতে পারেন।

ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে দেশের কোনও নাগরিক সাইবার বুলিংয়ের স্বীকার হলে কিংবা অফলাইনে মানহানিকর অপরাধের শিকার হলে দেশের প্রচলিত আইনে তার প্রতিকারের ব্যবস্থা রয়েছে। দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ৪৯৯ থেকে ৫০২ ধারা পর্যন্ত মানহানি সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়েছে। দণ্ডবিধি অনুসারে, একজন ব্যক্তি যদি অন্য কোনও ব্যক্তির সুনাম বা মান বা খ্যাতি যেটাই বলি না কেন, যদি সেটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে বা ওই ব্যক্তির সুনাম/মান নষ্ট হবে জেনে-শুনে শব্দের দ্বারা বা চিহ্ন ব্যবহারের মাধ্যমে বা কোনও প্রতীক যা দৃশ্যমান তার মাধ্যমে নিন্দা প্রকাশ পায়, তাহলে ধরে নেওয়া হবে যে উক্ত শব্দ/চিহ্ন/প্রতীক দ্বারা ওই ব্যক্তির মানহানি করা হয়েছে। যে চুরি করেনি, তাকে আপনি চোর বললে সেটা ওই ব্যক্তির জন্য মানহানি হবে। দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ৫০০ ধারা অনুযায়ী, মানহানির অপরাধের শাস্তি হচ্ছে ২ বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড। বর্তমান সময়ে অনলাইনে আমরা অফলাইনের চেয়ে অনেক বেশি সময় কাটাই। যার কারণে এখানেও ব্যাপকভাবে অপরাধ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এই অনলাইনেও কিন্তু মানুষ একজন আরেকজনের মানহানি ঘটাতে পারে। যেটির উদাহরণ ওপরের ঘটনাগুলোর মাধ্যমে দিয়েছি। তাই আমাদের সাম্প্রতিক সময়ে হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৯ ধারায় ৩ বছরের কারাদণ্ড বা ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় বিধানই রয়েছে। তবে কেউ যদি একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি করে তাহলে ৫ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় বিধানই রয়েছে।

ফেসবুকে মানুষ না জেনে একজনকে বুলিং করে ফেলে, যদি কোনোভাবে সেটা কারে, মানহানির কারণ হয়ে যায়, তাহলে আর দেখতে হবে না, চাইলে আইনের আশ্রয় নেওয়া যাবে। একবার চিন্তা করুন তো, আপনার একটা পোস্ট বা কমেন্টের কারণে যদি কারও মানহানি হয় আর ভিকটিম মামলা করে দেয়, তাহলে আপনার ৫ লাখ টাকা জরিমানা হলো বা ৩ বছরের জেল। বিষয়টি কেমন হবে? এসব কারণে কারও মানহানি করার উদ্দেশ্যে কখনও এমন কিছু পোস্ট করা উচিত না। আর অফলাইন তো নয়ই।

অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, অনলাইন-অফলাইন বুলিং বন্ধে দরকার পারিবারিক ও সামাজিক আন্দোলন। প্রয়োজনে সামাজিক সচেতনতা তৈরিতে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে এ ব্যাপারে ব্যাপক প্রচার কার্যক্রম চালানো যেতে পারে। সাইবার বুলিং বা অফলাইন বুলিংয়ের বিষয়ে কোনও অধ্যায় পাঠ্যপুস্তকে যোগ করা যায় কিনা, সরকারকে ভেবে দেখতে হবে।

শিশুকাল থেকেই অভিভাবকদের মধ্যে সন্তানকে এসব বিষয় নিয়ে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। অন্যদিকে যারা এসব বুলিং করে তারা আমাদেরই আশপাশের কেউ। আমরা যদি তাদের বোঝাতে সক্ষম হই এটি একটি চরম অপরাধ, তাহলে বুলিং অনেকাংশে কমে আসবে। বুলিং বন্ধে সচেতনতার কোনও বিকল্প নেই। তারপরও যদি কোনও সমাধান না পান তাহলে শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারস্থ হতে পারেন। এক্ষেত্রে দেশে প্রচলিত আইনের যথাযথ প্রয়োগও একান্ত কাম্য। তবে যেভাবেই হোক, বুলিং বন্ধ হওয়াটা জরুরি। কারণ, এর ক্ষতিকর প্রভাব সুদূরপ্রসারী।

লেখক: পরিকল্পক ও উপস্থাপক, বাংলাদেশ টেলিভিশন

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘নবায়নযোগ্য জ্বালানি ৪০ শতাংশে উন্নীত করার চেষ্টা চলছে’
‘নবায়নযোগ্য জ্বালানি ৪০ শতাংশে উন্নীত করার চেষ্টা চলছে’
পুরনো লাইনআপে ফিরছে ‘ব্ল্যাক’!
পুরনো লাইনআপে ফিরছে ‘ব্ল্যাক’!
মধুমতি ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তাসহ দুজনের বিরুদ্ধে মামলার অনুমোদন দুদকের
মধুমতি ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তাসহ দুজনের বিরুদ্ধে মামলার অনুমোদন দুদকের
আইসিটি খাতে নারীদের দক্ষতা বৃদ্ধি অপরিহার্য: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী
আইসিটি খাতে নারীদের দক্ষতা বৃদ্ধি অপরিহার্য: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ